‘দ্বিতীয় রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা

 কি আছে এনসিপির ২৪ দফা ইশতেহারে? 

রাজনীতি ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ আগস্ট ০৪ ২৩:৫১:১৪
 কি আছে এনসিপির ২৪ দফা ইশতেহারে? 
জুলাই-গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত সমাবেশে ‘নতুন বাংলাদেশের ইশতেহার’ ঘোষণা করেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। ছবি: প্রথম আলো।

২০২৪ সালের জুলাই মাসে সংঘটিত ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তিতে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম একটি বিস্তৃত ও ব্যাপক রাজনৈতিক ইশতেহার ঘোষণা করেন, যার লক্ষ্য একটি বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক, মানবিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র ‘দ্বিতীয় রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠা। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অনুষ্ঠিত এই সমাবেশে দেশজুড়ে দলীয় নেতা-কর্মী, শহীদ পরিবার ও আহতদের উপস্থিতিতে তিনি ‘নতুন বাংলাদেশের ইশতেহার’ নামে এই ২৪ দফা প্রস্তাব তুলে ধরেন।

পটভূমি ও ঘোষণার প্রেক্ষাপট

সমাবেশের সূচনায় নাহিদ ইসলাম স্মরণ করেন এক বছর আগের ঐতিহাসিক ঘোষণা—যেখানে ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্যের প্রতীক হিসেবে এক দফা দাবিতে ছাত্র-জনতা রাস্তায় নামে। তিনি স্পষ্ট করে দেন, এই আন্দোলনের নেতৃত্ব কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর নয়, বরং গোটা দেশের জনগণ ও অভ্যুত্থানকারী তরুণদের। সেই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এনসিপির জন্ম এবং আজকের এই ২৪ দফা ইশতেহার।

নাহিদ ইসলাম তাঁর বক্তব্যে বলেন, “এই ইশতেহার জনগণের স্বপ্ন ও শহীদের রক্তের ঋণ পরিশোধের প্রতিশ্রুতি। আমাদের সংগ্রাম কেবল সরকারের পরিবর্তনের জন্য নয়, বরং সেই কাঠামো বদলের জন্য, যার ভেতরে ফ্যাসিবাদ গড়ে ওঠে।”

ইশতেহারের মূল আকর্ষণ

এই ২৪ দফায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বিভিন্ন ক্ষেত্রের গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার, যেমন নতুন সংবিধান প্রণয়ন, ফ্যাসিবাদী অপরাধের বিচার, বিচার ও প্রশাসনিক সংস্কার, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, নারী-যুব-সংখ্যালঘুদের ক্ষমতায়ন, শ্রমিক-কৃষকের অধিকার, প্রযুক্তিনির্ভর গবেষণা, জলবায়ু সহনশীলতা, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, এবং জাতীয় প্রতিরক্ষা কৌশল।

প্রতিটি দফা মূলত একটি করে রাষ্ট্রীয় সংকল্প ও উন্নয়ন কর্মপরিকল্পনার ভিত্তি স্থাপন করে।

১। নতুন সংবিধান ও দ্বিতীয় রিপাবলিকের প্রবর্তন

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক পরিকাঠামো একনায়কতান্ত্রিক ও পরিবারতন্ত্রের সুবিধার্থে ব্যবহৃত হওয়ায়, এনসিপি একটি নতুন সংবিধান প্রণয়নের প্রস্তাব দিয়েছে। এই সংবিধান হবে জনগণের অংশগ্রহণে গণপরিষদের মাধ্যমে গৃহীত, যা জুলাই গণঅভ্যুত্থানের চেতনায় নির্মিত হবে। নতুন সংবিধানে ব্যক্তির মর্যাদা, মৌলিক অধিকার, গণতন্ত্র, ক্ষমতার ভারসাম্য এবং আইনের শাসন সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হবে। একনায়কতন্ত্র, দলীয়করণ, বিচারব্যবস্থার ওপর নির্বাহী হস্তক্ষেপ, ও ফ্যাসিবাদী প্রবণতাকে বন্ধ করা হবে সাংবিধানিকভাবে।

২। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের স্বীকৃতি ও বিচার নিশ্চিতকরণ

২০২৪ সালের জুলাই মাসে ছাত্র-শ্রমিক-জনতা কর্তৃক পরিচালিত গণঅভ্যুত্থান ছিল ফ্যাসিবাদবিরোধী এক ঐতিহাসিক রূপান্তর। এনসিপি এই অভ্যুত্থানের শহীদদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদানের পাশাপাশি শাপলা গণহত্যা, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত ও বিচারের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে চায়। পাশাপাশি আহতদের পুনর্বাসন ও আজীবন রাষ্ট্রীয় সহায়তা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।

৩। গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের পূর্ণ সংস্কার

জনগণের প্রকৃত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে এনসিপি এমন একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠন করতে চায়, যেখানে সংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো নির্বাহী বিভাগের অধীনস্থ না হয়ে স্বতন্ত্র ও কার্যকর হবে। নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে কালো টাকার প্রভাব দূর করার জন্য রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে নির্বাচনী ব্যয় বহনের পরিকল্পনা রয়েছে। গণতন্ত্র শুধু ভোটাধিকারেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রতিটি স্তরে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে।

৪। বিচারব্যবস্থার ন্যায়ভিত্তিক রূপান্তর

এনসিপি চায় এমন এক বিচারব্যবস্থা, যা ক্ষমতাবানদের রক্ষা না করে, মজলুমদের পক্ষে দাঁড়াবে। ঔপনিবেশিক যুগের অসামঞ্জস্যপূর্ণ আইন সংস্কার করে মানবাধিকারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিচারনীতি চালু করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ডিজিটাল ফাইলিং, অনলাইন ট্র্যাকিং, আলাদা সচিবালয়, বিচারক নিয়োগে স্বচ্ছতা ইত্যাদির মাধ্যমে বিচারপ্রক্রিয়া দ্রুত ও কার্যকর হবে।

৫। দুর্নীতিমুক্ত ও জনসেবামূলক প্রশাসন

আমলাতন্ত্রকে রাজনৈতিক দলগুলোর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের বিপরীতে এনসিপি দক্ষ, নিরপেক্ষ ও সেবামুখী প্রশাসন গড়ে তোলার অঙ্গীকার করেছে। সরকারি নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতিতে স্বচ্ছতা বজায় রাখা হবে। ডিজিটাল গভর্ন্যান্স চালু করে জনসেবার গতি বাড়ানো হবে এবং দুর্নীতির দ্রুত বিচার ও সর্বোচ্চ শাস্তির নিশ্চয়তা থাকবে। Whistleblower Protection আইন প্রণয়ন করে দুর্নীতিবিরোধী সাহসী নাগরিকদের সুরক্ষা দেওয়া হবে।

৬। মানবাধিকার রক্ষায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সংস্কার

র‌্যাব বিলুপ্তিসহ পুলিশ ব্যবস্থার রাজনৈতিক অপব্যবহার রোধে স্থায়ী কমিশন গঠন করা হবে। গ্রেপ্তারে ওয়ারেন্ট বাধ্যতামূলক করা, বডি ক্যামেরা চালু, কমিউনিটি পুলিশিং চালু, এবং মানবাধিকারভিত্তিক প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা হবে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে আইনি কাঠামোর আওতায় আনা হবে যাতে রাজনৈতিক নির্যাতন বন্ধ হয়।

৭। গ্রাম পার্লামেন্ট ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ

শুধু শহরকেন্দ্রিক নয়, উন্নয়ন ছড়িয়ে দিতে গ্রামে 'গ্রাম পার্লামেন্ট' গঠন করা হবে যাতে স্থানীয় সমস্যা, উন্নয়ন ও সরকারি সেবার বিষয়গুলো জনগণের অংশগ্রহণে নির্ধারিত হয়। সংসদ সদস্যদের ক্ষমতা ছাঁটাই করে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কার্যকর করা হবে। স্থানীয় সরকারকে একটি স্বাধীন কমিশনের মাধ্যমে পরিচালনা করে তা শক্তিশালী করা হবে।

৮। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও শক্তিশালী নাগরিক সমাজ

গণমাধ্যম যেন কোনো কর্পোরেট বা রাজনৈতিক গোষ্ঠীর কণ্ঠস্বর না হয়ে জনগণের পক্ষ হয়ে কথা বলে, তার জন্য মালিকানার বৈচিত্র্য ও আইনি কাঠামো নিশ্চিত করা হবে। প্রেস কাউন্সিলকে সক্রিয় করা হবে এবং মিথ্যা তথ্য বা গুজব রোধে নিরপেক্ষ তথ্য যাচাই ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা হবে। নাগরিক সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণে নীতিনির্ধারণে গণতান্ত্রিক চর্চা জোরদার করা হবে।

৯। সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা

জিপিএস-চালিত অ্যাম্বুলেন্স, ইলেকট্রনিক হেলথ রেকর্ড, ইউনিক হেলথ আইডি, মানসিক স্বাস্থ্যসেবার সম্প্রসারণ, অঞ্চলভিত্তিক বিশেষায়িত হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য নারী-সহায়ক পরিবেশ গড়ে তোলা হবে। প্রাথমিক চিকিৎসাকে মূল ভিত্তি হিসেবে ধরে একটি শক্তিশালী জাতীয় স্বাস্থ্য কাঠামো গঠন করা হবে।

১০। অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ন্যায্য শিক্ষানীতি

সকল শিক্ষার ধারা যেমন বাংলা, ইংরেজি, মাদ্রাসা ইত্যাদির মধ্যে সমন্বয় করে জাতীয় পাঠ্যক্রম আধুনিকায়ন করা হবে। শিক্ষা হবে অধিকার, পণ্য নয়। বিজ্ঞান-প্রযুক্তিভিত্তিক, নৈতিকতা ও নাগরিক চেতনা সম্পন্ন শিক্ষার মাধ্যমে উদ্ভাবনক্ষম নাগরিক তৈরি করা হবে। শিক্ষক সমাজের মর্যাদা ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে।

১১। গবেষণা, উদ্ভাবন ও তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লব

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর সমাজ গঠনের লক্ষ্যে এনসিপি গবেষণা খাতে বিপ্লব ঘটানোর ঘোষণা দিয়েছে। সরকার, বিশ্ববিদ্যালয় ও বেসরকারি খাতের মধ্যে সমন্বয় ঘটিয়ে ৫০ বছরের দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প হাতে নেওয়ার প্রস্তাব রাখা হয়েছে, যার আওতায় থাকবে মহাকাশ প্রযুক্তি, রাডার, AI, কোয়ান্টাম প্রযুক্তি, ন্যানোটেক, নিউক্লিয়ার সায়েন্স, সেমিকন্ডাক্টর, বায়োটেকনোলোজি প্রভৃতি ক্ষেত্রে গবেষণা ও ল্যাব প্রতিষ্ঠা। বিশ্বমানের গবেষণাগারের সঙ্গে সহযোগিতা করে দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দেওয়া হবে। কম্পিউটেশনাল গবেষণার জন্য ন্যাশনাল কম্পিউটিং সার্ভার গঠন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক ক্লাস্টার তৈরি করা হবে। সাইবার নিরাপত্তা রক্ষায় আলাদা কমিশন গঠন করা হবে।

১২। ধর্ম, সম্প্রদায় ও জাতিসত্ত্বার মর্যাদা

বাংলাদেশের বহুজাতিক, বহু ভাষাভিত্তিক ও বহু সংস্কৃতির সমাজে ধর্ম বা জাতিগত পরিচয়ের কারণে নিপীড়নের বিরুদ্ধে এনসিপির অবস্থান দৃঢ়। তারা প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক অধিকার, মাতৃভাষায় শিক্ষার অধিকার ও ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে। হিন্দুদের জমি দখলের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা, দলিত ও তফসিলি সম্প্রদায়ের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানে বিশেষ বরাদ্দ এবং সকল ধর্মে বিদ্বেষমূলক আচরণের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মানবাধিকার কমিশনের অধীনে একটি স্বতন্ত্র সেল গঠন করা হবে যা এসব নিপীড়নের তদন্ত ও পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হবে।

১৩। নারীর নিরাপত্তা, অধিকার ও ক্ষমতায়ন

নারী অংশগ্রহণের সত্যিকার নিশ্চয়তা দিতে সংসদে ১০০টি সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি নির্বাচনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে নারীর অংশ, কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষ সমবেতন, গৃহিনীর অবদানকে জিডিপির অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে। প্রতিটি থানায় নারী সহিংসতা প্রতিরোধ সেল, নারী পুলিশের সংখ্যা বৃদ্ধি, ধর্ষণ মামলার ফাস্ট ট্র্যাক ট্রায়াল এবং গণমাধ্যমে ভিকটিমের পরিচয় গোপনের বিধান কার্যকর করা হবে। মাতৃত্বকালীন ও পিতৃত্বকালীন ছুটি নিশ্চিত, ব্রেস্টফিডিং রুম, বয়স্ক ও শিশু সেবা কেন্দ্র এবং নিরাপদ যাতায়াতের জন্য নারীবাস চালু করা হবে।

১৪। মানবকেন্দ্রিক ও কল্যাণমুখী অর্থনীতি

এনসিপি চায় এমন একটি অর্থনীতি যেখানে ব্যক্তি নয়, সমাজ ও রাষ্ট্র হবে কেন্দ্রীয়—যেখানে মানুষ, পরিবেশ, এবং সামাজিক ন্যায়বিচার থাকবে মূলধারায়। জিডিপি প্রবৃদ্ধি নয়, মানুষের জীবনমান উন্নয়ন হবে উন্নয়নের সূচক। বেকার, প্রবীণ, বিধবা, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের ভাতা নাগরিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত হবে। কর কাঠামো হবে প্রগতিশীল; ধনীদের কাছ থেকে বেশি কর আদায় করে গরিবদের জন্য উন্নয়ন বরাদ্দ নিশ্চিত করা হবে। ব্যাংক, পুঁজিবাজার, সঞ্চয়পত্র ও ঋণনীতির পূর্ণ সংস্কার ঘটানো হবে।

১৫। তারুণ্য ও কর্মসংস্থান

বাংলাদেশের তরুণ জনগোষ্ঠীকে দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তরের লক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারি ইন্টার্নশিপ সম্প্রসারণ, প্রশ্নফাঁস রোধে স্বচ্ছ নিয়োগ পরীক্ষা ব্যবস্থা, উদ্যোক্তাদের জন্য প্রণোদনা ও ফ্রিল্যান্স হাব গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে। প্রবাসে কাজের জন্য IT, নার্সিং, হসপিটালিটি ইত্যাদি খাতে ট্রেনিং সেন্টার স্থাপন, বিদেশি সনদপ্রাপ্তি এবং জেলা পর্যায়ে ক্রীড়া কমপ্লেক্স নির্মাণের প্রতিশ্রুতি রয়েছে।

১৬। বহুমুখী বাণিজ্য ও শিল্পায়ন নীতি

গার্মেন্টসনির্ভরতা কমিয়ে চামড়া, আসবাব, হালকা প্রকৌশল, কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য ইত্যাদি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো হবে। ওষুধ শিল্পের সুরক্ষা, ICT খাত সম্প্রসারণ, চট্টগ্রাম-মংলা-মাতারবাড়িকে লজিস্টিক হাবে রূপান্তর এবং শিল্প উন্নয়নে ৫০ বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনার জন্য জাতীয় কমিশন গঠন করা হবে।

১৭। টেকসই কৃষি ও খাদ্য সার্বভৌমত্ব

প্রচলিত কৃষি ব্যবস্থা আধুনিকীকরণ, উৎপাদনশীলতা বাড়াতে প্রযুক্তি ও ভর্তুকি, বিষমুক্ত ও পুষ্টিকর খাদ্য উৎপাদন, কৃষকদের সরাসরি বিক্রয়ের সুযোগ এবং ফসলের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করতে অঞ্চলভিত্তিক তথ্যভাণ্ডার গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় বীজ উৎপাদনে স্বনির্ভরতা অর্জন ও কৃষি রপ্তানির উপযোগিতা বৃদ্ধির পরিকল্পনা রয়েছে।

১৮। শ্রমিক-কৃষকের অধিকার

শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি কাঠামো, সামাজিক সুরক্ষা, বাধ্যতামূলক কর্ম-সুরক্ষা-বীমা, পেনশন তহবিল, শ্রম ট্রাইব্যুনালের বিস্তৃতি এবং শিশুশ্রম নির্মূলে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। কৃষকদের ফসলের ন্যায্য দামে বিক্রির জন্য হিমাগার, কৃষি বীমা, আবহাওয়া ও বাজার সম্পর্কিত জাতীয় মোবাইল প্ল্যাটফর্ম গঠনের কথা বলা হয়েছে।

১৯। জাতীয় সম্পদ ব্যবস্থাপনা

গ্যাস, খনিজ, কয়লা, পাথরসহ প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠা এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করা হবে। পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রেখে টেকসই খনন নীতি প্রণয়ন, আন্তর্জাতিক চুক্তির পুনর্বিন্যাস এবং সুন্দরবনের সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি রয়েছে।

২০। পরিকল্পিত নগরায়ন ও পরিবহন ব্যবস্থা

রাজধানীকেন্দ্রিক কেন্দ্রীয়করণ বন্ধ করে অন্যান্য শহরে সরকারি সেবা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করা হবে। সামাজিক আবাসন, বাড়িভাড়া নীতিমালা, নদী খাল ভিত্তিক নগরায়ন, পরিবেশবান্ধব গণপরিবহন, সবুজ উন্মুক্ত স্থান সংরক্ষণ এবং সাশ্রয়ী ও গতিশীল আন্তঃজেলা যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে।

২১। জলবায়ু সহনশীলতা ও নদী-সমুদ্র রক্ষা

জলবায়ু বিপর্যয়ের ঝুঁকি মোকাবিলায় বনায়ন, নদী সংরক্ষণ, সমন্বিত পানি ব্যবস্থাপনা, খনন নিয়ন্ত্রণ, নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিস্তার, আবহাওয়া পূর্বাভাস ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং জলবায়ু ক্ষতিপূরণের দাবিতে আন্তর্জাতিক ফোরামে সক্রিয় কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টির ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

২২। প্রবাসী বাংলাদেশির মর্যাদা ও অধিকার

প্রবাসীদের শুধু রেমিট্যান্স উৎস না ভেবে রাষ্ট্রের অংশীদার হিসেবে দেখার কথা বলা হয়েছে। দূতাবাসে হয়রানিমুক্ত সেবা, ভোটাধিকার, বিনিয়োগ সহায়তা, প্রবাসে মৃত্যুর পর মরদেহ ফেরত আনা এবং প্রবাসী নীতিনির্ধারণে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে।

২৩। বাংলাদেশকেন্দ্রিক পররাষ্ট্রনীতি

বাংলাদেশের স্বার্থকে সর্বোচ্চে রেখে দলনিরপেক্ষ, সার্বভৌম, স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণের কথা বলা হয়েছে। সীমান্ত হত্যা বন্ধ, রোহিঙ্গা সংকটের মানবিক সমাধান, মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্ব, আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও পাবলিক ডিপ্লোম্যাসির বিস্তার হবে এই নীতির মূল লক্ষ্য।

২৪। জাতীয় প্রতিরক্ষা কৌশল

সক্ষমতা ও শৃঙ্খলাভিত্তিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গঠনের লক্ষ্য নিয়ে সারফেস-টু-এয়ার মিসাইল, UAV ব্রিগেড, সাবমেরিনভিত্তিক নৌবাহিনী, সেকেন্ড স্ট্রাইক সক্ষমতা এবং জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ গঠন করা হবে। প্রতিরক্ষা হবে সংসদীয় নজরদারিতে পরিচালিত, যা আঞ্চলিক শান্তি ও কূটনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখবে।

ইশতেহার ঘোষণার শেষ মুহূর্তে নাহিদ ইসলাম আবারও জনগণকে স্মরণ করিয়ে দেন শহীদ মিনার থেকে শুরু হওয়া শপথের কথা—এই দেশকে স্বৈরতন্ত্রের কবল থেকে মুক্ত করার। তিনি বলেন, “আপনারা সাড়া দিয়েছেন, ফ্যাসিবাদকে পরাজিত করেছেন। এখন সময় এসেছে নতুন বাংলাদেশ গড়ার।”

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ