"মহামারি, দুর্ভিক্ষ ও যুদ্ধ: কীভাবে রক্ষা করা যাবে মানবসভ্যতা?"

বিশ্ব ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুলাই ৩০ ২০:২১:৪০
"মহামারি, দুর্ভিক্ষ ও যুদ্ধ: কীভাবে রক্ষা করা যাবে মানবসভ্যতা?"
গাজায় এখন যুদ্ধের নামে এখন চালাচ্ছে এক পক্ষীয় নৃশংসতাছবি: এএফপি

ইতিহাসবিদ ইউভাল নোয়াহ হারারি তাঁর আলোচিত গ্রন্থ হোমো ডিউস-এ মানবজাতির তিনটি প্রধান শত্রুর কথা বলেছেন—মহামারি, দুর্ভিক্ষ ও যুদ্ধ। তাঁর মতে, আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণে প্রথম দুটি বিপদ—মহামারি ও দুর্ভিক্ষ—মানুষ অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে এনেছে। তবে যুদ্ধ এখনো মানবসভ্যতার জন্য এক বড় আশঙ্কা হয়ে রয়ে গেছে।

হারারির ভাষ্য অনুযায়ী, ইতিহাসে মহামারি বরাবরই ভয়ংকর রূপে আবির্ভূত হয়েছে। কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারির সময় আমরা দেখতে পেয়েছি, আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান ও মাইক্রোবায়োলজি কতটা দ্রুত ও কার্যকরভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে। মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে প্রাণঘাতী এই ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে।

ম্যালেরিয়ার ইতিহাসই তার প্রমাণ। একসময় মানুষ মশার কামড় নয়, বরং সন্ধ্যার বাতাস বা অদৃশ্য শক্তিকে রোগের কারণ হিসেবে ভাবত। কিন্তু দক্ষিণ আমেরিকার সিঙ্কোনা গাছের ছাল থেকে তৈরি কুইনাইন এবং পরে মশার উৎস খুঁজে বের করে রোনাল্ড রস ও তাঁর সহকর্মীরা এই কুসংস্কার ভেঙে দেন। একইভাবে কলেরার প্রকৃত কারণ দূষিত পানি শনাক্ত করে আজ তা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে ওরস্যালাইনের মতো সহজ সমাধান দিয়ে।

বসন্ত, টাইফয়েড, ব্ল্যাক ফিভার কিংবা সিফিলিস—এসব রোগ এক সময় মানুষের জন্য মরণব্যাধি ছিল। অথচ বসন্ত এখন শুধুই গবেষণাগারের বিষয়, কারণ তা পৃথিবী থেকে নির্মূল করা সম্ভব হয়েছে।

হারারি তাঁর বইয়ে দ্বিতীয় বিপদ হিসেবে তুলে ধরেছেন দুর্ভিক্ষকে। যদিও প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছিল অনেক দুর্ভিক্ষের কারণ, তবে প্রশাসনিক ব্যর্থতা, রাজনৈতিক অবহেলা ও যুদ্ধ ছিল এর মূল চালিকাশক্তি। গত দেড় শতাব্দীতে প্রায় ৭ থেকে ১২ কোটি মানুষ দুর্ভিক্ষে মারা গেছেন। তবে আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তি, অধিক খাদ্য উৎপাদন ও উন্নত বিতরণব্যবস্থার কারণে এই বিপদও অনেকটা কমে এসেছে।

তৃতীয় ও সবচেয়ে জটিল বিপদ হলো যুদ্ধ। হারারির মতে, আধুনিক সময়ে যুদ্ধের পেছনের ঐতিহ্যবাহী কারণগুলো—যেমন জমি, সম্পদ বা সাম্রাজ্য বিস্তার—তেমন কার্যকর নেই। বরং জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো মানব মেধা, যা শক্তিপ্রয়োগে দখল করা সম্ভব নয়। উদাহরণ হিসেবে তিনি চীনের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, চীন যদি আমেরিকার সিলিকন ভ্যালি দখল করতে চায়, তাতে তার লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হবে। বিনিয়োগই সেখানে অধিক ফলপ্রসূ।

এই যুক্তি আশাব্যঞ্জক হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। হারারির বই প্রকাশের পরপরই বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে ইসরায়েল-হামাস সংঘাত ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি এখন আর কাল্পনিক নয়, বরং বাস্তব রাজনৈতিক কৌশলের অংশ। রাশিয়া সরাসরি জানিয়েছে, তাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়লে তারা পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবে।

ইরান যদি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বড় ধরনের হামলা চালায়, তখন ইসরায়েল পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবে না—এমন নিশ্চয়তা নেই। ১৯৭৩ সালের ইয়ম কিপ্পুর যুদ্ধের সময় এমন পরিস্থিতিতেই ইসরায়েল পারমাণবিক হামলার কথা ভাবছিল। সেই সময় মার্কিন কূটনীতিক হেনরি কিসিঞ্জার অস্ত্র ও বিমান পাঠিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন—যা তিনি তাঁর স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেছেন।

এছাড়া বিশ্ব রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাতেও এসেছে বড় পরিবর্তন। ৯/১১ ঘটনার পর প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ বলেছিলেন, ‘তুমি যদি আমাদের সঙ্গে না থাকো, তবে তুমি আমাদের শত্রু।’ এ বার্তা শুধু একটি রাজনৈতিক অবস্থান নয়, বরং বৈশ্বিক আধিপত্যবাদী মানসিকতারও বহিঃপ্রকাশ। আজ যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক চাপ, নেতৃত্বের দুর্বলতা ও কূটনৈতিক দক্ষতার অভাব বিশ্বব্যাপী অস্থিরতা সৃষ্টি করছে—বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউক্রেনে।

মানবজাতি মহামারি, দুর্ভিক্ষ ও যুদ্ধ—এই তিন শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করেছে দীর্ঘদিন। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা এই লড়াইকে অনেকটাই সহজ করেছে। কিন্তু বিশ্বশান্তি ও স্থিতিশীলতার প্রশ্নে এখনো আমরা ঝুঁকির মধ্যেই রয়েছি। যদি পারমাণবিক যুদ্ধের মতো ঘটনা ঘটে, তাহলে ইউভাল হারারির আশাবাদ এক গভীর ট্র্যাজেডিতে পরিণত হতে পারে।

এই প্রেক্ষাপটে মানবজাতির সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে—একটি টেকসই শান্তিপূর্ণ বিশ্ব গড়ে তোলা। নইলে একদিন হয়তো হোমো স্যাপিয়েন্সও হোমো ইরেক্টাস, নিয়ান্ডারথাল বা হোমো হ্যাবিলিসের মতোই ইতিহাসে বিলীন হয়ে যাবে।

/আশিক

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ