মেরুদণ্ডে গুলি, সংসার ভাঙল, তবু সাহায্য মেলেনি:  ‘জুলাই যোদ্ধা’ শাকিলের  করুণ গল্প

সারাদেশ ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুলাই ১২ ১০:১৪:৫৩
মেরুদণ্ডে গুলি, সংসার ভাঙল, তবু সাহায্য মেলেনি:  ‘জুলাই যোদ্ধা’ শাকিলের  করুণ গল্প

গত বছরের ৫ আগস্ট ‘জুলাই আন্দোলনে’ গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন মো. শাকিল নামে এক তরুণ। এখনো তার মেরুদণ্ডে রয়ে গেছে সেই গুলি। ঘটনার এগারো মাস পেরিয়ে গেলেও তার উন্নত চিকিৎসা হয়নি, মেলেনি সরকারি অনুদান বা কোনও ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা। শাকিলের নাম নেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তালিকায়, নেই সরকারি গেজেটেও। নিঃস্ব হয়ে চিকিৎসা চালাতে গিয়ে তিনি এখন বিপুল ঋণে জর্জরিত। তার সংসারও ভেঙে গেছে—স্ত্রী সন্তান নিয়ে আলাদা হয়ে গেছেন।

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার বাসিন্দা শাকিল জানান, ৫ আগস্ট মাওনা চৌরাস্তায় আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলিতে আহত হন তিনি। গুলি কোমরের উপর দিয়ে ঢুকে মেরুদণ্ডে গেঁথে যায়। এখনো এক্সরে ছবিতে সেই বুলেট স্পষ্ট দেখা যায়। সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা পেলেও গুলি শরীর থেকে অপসারণ করা হয়নি। চিকিৎসকেরা বলেছেন, গুলি বের করতে গেলে শাকিল স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে যেতে পারেন। কিন্তু দিন যত যাচ্ছে, গুলির কারণে তার শারীরিক কষ্ট আরও বাড়ছে।

চিকিৎসা চালিয়ে যেতে গিয়ে ইতোমধ্যে দেড় লাখ টাকার বেশি খরচ হয়েছে শাকিলের। ব্যক্তি উদ্যোগে কিছু সহায়তা পেলেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো আর্থিক সহায়তা তিনি পাননি। ঋণের পরিমাণ এখন দাঁড়িয়েছে সাড়ে তিন লাখ টাকার মতো। শুধু আর্থিক নয়, পারিবারিক জীবনেও ভেঙে পড়েছেন তিনি। নিজের দুরবস্থা জানিয়ে শাকিল বলেন, “আমার জীবনের সব এলোমেলো হয়ে গেছে। আমার বউ-ছেলে চলে গেছে। কারণ একটাই—আমি নিজের শরীর থেকে গুলিটা বের করাতে পারিনি।”

এই প্রতিবেদনের সময় শাকিল ছিলেন শ্রীপুর উপজেলা পরিষদে, উদ্দেশ্য ছিল সরকারি সহায়তার তালিকায় নিজের নাম তোলার চেষ্টা করা। কিন্তু উপজেলা প্রশাসন বলেছে, শাকিলের সঙ্গে যোগাযোগ করা না যাওয়ায় তাকে তালিকাভুক্ত করা যায়নি। অথচ গত বছর বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে শাকিলের বিষয়টি পরিষ্কারভাবে তুলে ধরা হয়েছিল। এমনকি তখন ছাত্র প্রতিনিধিদের মাধ্যমে তিনি প্রাসঙ্গিক কাগজপত্রও জমা দিয়েছিলেন।

তালিকা প্রণয়নের দায়িত্বে থাকা রফিকুল ইসলাম রায়হান নিজেও ওই দিন গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। তিনি বলেন, শাকিল কাগজপত্র দেওয়ার পর আর যোগাযোগ রাখেননি। এ কারণে হয়তো তাকে তালিকায় রাখা হয়নি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সজীব আহমেদ জানিয়েছেন, শাকিলের কাগজপত্র নতুন করে যাচাইয়ের জন্য একজন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

সরকার জুলাই আন্দোলনে নিহতদের পরিবার এবং আহতদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার জন্য তিনটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করে সহায়তা কার্যক্রম চালু করেছে। বাজেটে ৪০৫ কোটি টাকা বরাদ্দও রাখা হয়েছে। এর মধ্যে কেউ কেউ একাধিকবার সহায়তা পেলেও শাকিলের মতো প্রকৃত ভুক্তভোগীরা রয়ে গেছেন উপেক্ষিত। জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, গেজেটভুক্ত ৪০ জন আহত এবং ৪ জন নিহতের নাম বাতিলের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে, যাদের বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগ আছে।

এদিকে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল বা পঙ্গু হাসপাতালে এখনো জুলাই আন্দোলনে আহত ১০ জন ভর্তি রয়েছেন। চিকিৎসকেরা বলছেন, তাদের শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল, তারা চাইলে বাড়ি ফিরে যেতে পারেন। তবে ভর্তিকৃতদের অভিযোগ, হাসপাতালে থাকলেই কিছু সহায়তা মেলে, বাড়ি গেলে আর কেউ খোঁজ রাখে না।

শাকিলের মতো আহতরা বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন, সরকারি সহায়তা হয়তো কেবল কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ। বহু মানুষ যেমন সাহায্য না পেয়ে দিশেহারা, আবার অনেকে সহায়তা পেতে গিয়ে সিস্টেমের ফাঁকফোকরে পড়ে গেছেন। পঙ্গু হাসপাতালের পরিচালক আবুল কেনান বলেন, “জুলাই যোদ্ধাদের প্রতি আমরা সম্মান জানাই। কিন্তু দীর্ঘদিন হাসপাতালে থেকে যারা প্রয়োজন ছাড়াই সেবা নিচ্ছেন, তা হাসপাতালের জন্যও চাপ তৈরি করছে।”

আর্থিক সংকট, চিকিৎসার অভাব ও পারিবারিক ভাঙনের পাশাপাশি ‘জুলাই যোদ্ধা’ শাকিলের জীবনের লড়াই এখন টিকে থাকার সংগ্রাম। আহতদের একজন শামীম বলেন, “একটা ওষুধ খেতেও বিশ টাকা লাগে। আমি সেই টাকা পাব কোথা থেকে?” এমন অসংখ্য প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে আহতদের একটিই অনুরোধ—তাদের পাশে যেন কেউ দাঁড়ায়, অন্তত এই যন্ত্রণার ভারটুকু ভাগ করে নিতে।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ