ইরান- ইসরায়েল সংঘাত

যুদ্ধের নামে ব্যর্থ কৌশল: বিশ্লেষকদের চোখে নেতানিয়াহু

বিশ্ব ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুন ২৫ ১৬:৩২:২০
যুদ্ধের নামে ব্যর্থ কৌশল: বিশ্লেষকদের চোখে নেতানিয়াহু

দীর্ঘ ১২ দিনের টানা বিমান হামলার পরও ইরানের বিরুদ্ধে ইসরাইলের ঘোষিত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে বলে অভিমত দিয়েছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। যুদ্ধবিরতির পর ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিজয় দাবি ইতোমধ্যেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বিভিন্ন পর্যালোচনায়। আল-জাজিরায় প্রকাশিত বিশ্লেষণমূলক একটি প্রবন্ধে ইসরাইলি রাজনৈতিক ভাষ্যকার অরি গোল্ডবার্গ সরাসরি তুলে ধরেছেন, কিভাবে ইসরাইলের কৌশলগত ব্যর্থতা এবং ইরানের দৃঢ় প্রতিরোধ ক্ষমতা গোটা সংঘাতের গতিপথকে বদলে দিয়েছে।

ঘোষিত লক্ষ্য বনাম বাস্তব অর্জন: বিভ্রান্তি নাকি স্ববিরোধ?

ইসরাইল এই যুদ্ধ শুরু করেছিল অন্তত তিনটি বড় লক্ষ্য সামনে রেখে:১. ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস২. ইসলামিক প্রজাতন্ত্রে সরকার পরিবর্তনের পথ প্রশস্ত করা৩. আন্তর্জাতিকভাবে ইরানকে একঘরে করা

কিন্তু গোল্ডবার্গের ভাষায়, "ইসরাইল যা চেয়েছিল, বাস্তবতা হয়েছে তার উল্টো।"

পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংসের প্রচেষ্টা কার্যত ব্যর্থ হয়েছে। কারণ, ইরান যুক্তরাষ্ট্রের হামলার আগেই ফোর্ডো পারমাণবিক স্থাপনা থেকে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান সরিয়ে ফেলেছিল। এই পদক্ষেপ ইঙ্গিত দেয়, ইরান ছিল আগাম প্রস্তুত। এ ছাড়া, মার্কিন বাঙ্কার-বাস্টার বোমা ব্যবহার করেও ইরানকে নির্মূল করা যায়নি, যা ইসরাইলের অন্যতম কৌশলগত ব্যর্থতা হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে।

রাজনৈতিক পরিবর্তনের লক্ষ্যে ‘টার্গেটেড অ্যাসাসিনেশন’: কার্যকারিতা না বরং প্রতিক্রিয়া?ইসরাইল ইরানি বিপ্লবী গার্ড (IRGC)-এর শীর্ষ নেতাদের টার্গেট করে হত্যার মাধ্যমে ইরানে সরকারবিরোধী বিদ্রোহ উসকে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে যা ঘটেছে তা হলো বিপরীত প্রতিক্রিয়া।

যেসব ইরানিরা পূর্বে সরকার ও IRGC-এর বিরোধিতা করতেন, তারাও এ হামলাকে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের উপর আঘাত হিসেবে দেখেছেন। ফলে অভ্যন্তরীণ ঐক্য আরও সুদৃঢ় হয়েছে। নেতানিয়াহুর সরকার যেমন রাজনৈতিক দুর্বলতা আশা করেছিল, তেমন কোনো ঘটনাই ঘটেনি।

মনস্তাত্ত্বিক ও প্রতীকী কৌশলের ব্যর্থতা

ইসরাইল এভিন কারাগারে এবং রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার কেন্দ্র আইআরআইবি-তে হামলা চালিয়ে ইরানিদের মাঝে সরকার বিরোধী আবেগ উসকে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু এতে ইরানিদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টায়নি; বরং বন্দীদের অবস্থা আরও শোচনীয় হওয়ায় সরকারকে সমর্থনের ক্ষেত্রই তৈরি হয়েছে।

এই কৌশল মূলত তথাকথিত 'ইমেজ ওয়ার' বা মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে ইসরাইলকে সুবিধা দেয়নি; বরং ইরানকে হামলার শিকার হিসেবে উপস্থাপন করেছে বিশ্বদৃষ্টিতে।

আন্তর্জাতিক সমর্থন: বিভাজন ও কৌশলগত নিঃসঙ্গতা

যুদ্ধ শুরু করার পেছনে ইসরাইলের আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল বৈশ্বিক সহানুভূতি অর্জন ও গাজায় আগ্রাসনের ইস্যু থেকে বিশ্বমানসকে অন্যদিকে সরিয়ে নেওয়া। যদিও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সীমিতভাবে হামলায় অংশ নেন এবং হামলার মাধ্যমে নীতিগত সমর্থন দেন, তবুও তিনি সরাসরি যুদ্ধে জড়াননি।

সরাসরি অংশগ্রহণের পরিবর্তে ট্রাম্প আগাম বার্তা দিয়ে ইরানকে উত্তেজনা প্রশমনে বাধ্য করার পথ বেছে নেন, যাতে কাতারে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি রক্ষা পায়। জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মের্জ ও কিছু পশ্চিমা নেতৃত্ব হামলার পক্ষে কথা বললেও, ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ পুরোপুরি নিষিদ্ধ করার দাবিকে কেউই সমর্থন করেনি।

বিশ্ব এখন ‘পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ’ নীতিতে ফিরে যেতে আগ্রহী, যেখানে ইরান আলোচনার ভিত্তিতে অংশীদার হতে রাজি বলেও জানিয়েছে।

যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যর্থতা ও প্রতিরোধের সফলতা

যুদ্ধের ব্যয় ইসরাইলের জন্য আর্থিক ও কৌশলগত দুই দিক থেকেই বিপর্যয়কর ছিল। ইরান একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র হামলার মাধ্যমে ইসরাইলের প্রতিরক্ষা ব্যূহ ভেদ করতে সক্ষম হয়েছে। এটি ছিল অভূতপূর্ব। এর ফলে শুধু সামরিক নয়, অর্থনৈতিকভাবেও ইসরাইল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ইন্টারসেপ্টর ক্ষেপণাস্ত্রের ঘাটতি এবং উৎপাদন ব্যয় ইসরাইলি অর্থনীতিতে নতুন করে চাপ সৃষ্টি করেছে। একই সঙ্গে ইসরাইলের জনগণের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নেতানিয়াহুর নেতৃত্বের প্রতি আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে।

ইরানের জয়: বাস্তবতা, ছায়াযুদ্ধ ও ভবিষ্যতের কৌশল

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ইরান যুদ্ধ থেকে শুধু অক্ষত নয়, বরং কৌশলগতভাবে আরও শক্তিশালী হয়ে বের হয়েছে। বিশ্ব ইরানকে এখন আরও বাস্তবধর্মী, স্থিতিশীল ও আঞ্চলিকভাবে প্রয়োজনীয় শক্তি হিসেবে বিবেচনা করছে।

ইরান নিজেদের ভূখণ্ডে হামলার শিকার হিসেবে চিত্রায়িত করতে পেরেছে, যা তাকে বৈশ্বিক সহানুভূতি ও কূটনৈতিক মঞ্চে সুবিধা এনে দিয়েছে। এ ছাড়া, যুদ্ধবিরতি ভেঙে আবারও হামলার হুমকিতে ইসরাইলকে প্রকাশ্যে সতর্ক করার মতো সাহসিক অবস্থানে দেখা গেছে ইরানকে।

ইসরাইল ও ইরানের মধ্যে সাম্প্রতিক এই সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যের কৌশলগত শক্তির ভারসাম্যে এক নতুন রূপরেখা তৈরি করেছে। ইসরাইলের সামরিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও প্রচারভিত্তিক অভিযান বাস্তবতার কষ্টিপাথরে ব্যর্থ হয়েছে। অন্যদিকে, ইরান তার প্রতিরোধ, কৌশলগত দূরদর্শিতা এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতি দিয়ে যুদ্ধের ময়দান ছাড়াও একটি কৌশলগত বিজয় অর্জন করেছে।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

আমেরযত কাহিনি

আমেরযত কাহিনি

নিজস্ব প্রতিবেদক: স্বাদ, গন্ধ ও পুষ্টিগুণে পরিপূর্ণ ‘আম’ শুধু একটি ফল নয়, বরং এটি ইতিহাস, সংস্কৃতি ও অর্থনীতিতে গভীরভাবে প্রোথিত এক... বিস্তারিত