মতামত

মব সন্ত্রাস বনাম ন্যায়বিচার: জসীম-পিনাকী বয়ানের বিপজ্জনক রাজনীতি

আসিফ বিন আলী
আসিফ বিন আলী
শিক্ষক ও স্বাধীন সাংবাদিক
২০২৫ জুন ২৪ ২১:২৭:৩৫

"আমি জুলাইয়ে পুলিশ পিটাইছি। আমি ৩২ ভাঙছি। আমি নূরুল হুদাকে জুতা মারছি। আমি জসীম, স্বৈরাচারের যেকোনো কুলাঙ্গারকে পাইলে জুতা মারবো। সাহস থাকলে আমাকে ‘মব’ বলে গ্রেফতার কর সুশীলের বাচ্চারা।"

এই লেখার একটি পোস্টার সোশ্যাল মিডিয়াতে ঘুরছে। এই কথা যিনি বলেছেন তিনি জসীম খান, নিজেকে পরিচয় দিচ্ছেন জুলাই আন্দোলনে চোখ হারানো 'যোদ্ধা' হিসেবে। অন্যদিকে পিনাকী লিখেছেন, "হাসিনার নির্বাচন কমিশনার হুদাকে যেই আপ্যায়ন করা হইছে, হুদার জন্য কান্নাকাটি করা সবাইকে একই আপ্যায়ন করা হইবে। ঘোষণাটি শেষ হলো।" এই ধরনের বক্তব্যের অন্তর্নিহিত অর্থ থাকে। সেই আলাপটাই এখানে করি।

জসীম যখন বলছে, "আমি জুলাইয়ে পুলিশ পিটাইছি। আমি ৩২ ভাঙছি। আমি নূরুল হুদাকে জুতা মারছি..." এই বাক্যগুলো নিছক আবেগ বা প্রতিবাদের ভাষা নয়; এগুলো একটি স্পষ্ট আত্মদম্ভ। তিনি সহিংসতাকে গৌরবের কাজ হিসেবে দেখছেন। (উল্লেখ্য, জুলাইতে আন্দোলনের প্রেক্ষিতে সহিংসতা হয়েছে এবং সেই সহিংসতায় দুই পক্ষই অংশ নিয়েছে, কিন্তু সেই সহিংসতার দায় আন্দোলনকারীদের নয়, কেননা সেখানে রাষ্ট্র প্রথম সহিংস আচরণ শুরু করে এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে নাগরিকদের হ।..ত্যা করতে থাকে)। জসীম খান নিজেকে ‘যোদ্ধা’ হিসেবে দাবি করছেন, তার চোখ হারানোর বেদনা এবং প্রতিবাদ অবশ্যই বিবেচনার দাবিদার। কিন্তু এই ব্যক্তিগত ক্ষতির ভিত্তিতে তিনি আইন নিজ হাতে তুলে নিতে চাইছেন। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে জসীমের এই বক্তব্য একটি বিপজ্জনক উদাহরণ। তার বক্তব্যকে প্রশংসা করার কিছু নেই। এই বক্তব্য এক ব্যক্তির দম্ভ যে নিজেকে আইনের ঊর্ধ্বে মনে করছে।

জসীম ও পিনাকীর বক্তব্যের মাধ্যমে মব সন্ত্রাসকে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে। পিনাকী এই কাজ অনেক আগে থেকেই করে আসছেন। মানবাধিকারের দোহাই দিয়ে প্রবাসে থেকে তিনি নিজেই দেশের অভ্যন্তরে মানবাধিকারের লঙ্ঘন হয় এমন কাজে নিয়মিত উসকানি দিচ্ছেন ও সংগঠনে কাজ করছেন।

জসীম যখন বলেন "সাহস থাকলে আমাকে ‘মব’ বলে গ্রেফতার কর সুশীলের বাচ্চারা", কিংবা পিনাকী যখন লেখেন, "হুদার জন্য কান্নাকাটি করা সবাইকে একই আপ্যায়ন করা হইবে", তখন এর মাধ্যমে তারা আইন ও রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করেন। এটি স্পষ্ট করে যে তারা নিজেকে আইনের ঊর্ধ্বে ভাবছেন, নিজেদের ‘ন্যায়ের প্রতীক’ হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন। তাদের এই আচরণ সমাজে বিচারবহির্ভূত শাস্তির সংস্কৃতিকে বৈধতা দেয়। এই সংস্কৃতি ভবিষ্যতে আরও সহিংসতার পথ প্রশস্ত করতে পারে।

পিনাকী ভট্টাচার্যের লেখা "হাসিনার নির্বাচন কমিশনার হুদাকে যেই আপ্যায়ন করা হইছে... সবাইকে একই আপ্যায়ন করা হইবে"— এটি একটি স্পষ্ট হুমকি তাদের প্রতি যারা ঐ মব সন্ত্রাসের প্রতিবাদ করেছেন। তিনি ব্যক্তিকে অপরাধের জন্য শাস্তি নয়, বরং পরিচয়ের ভিত্তিতে ‘একই ধরনের সহিংসতা’ করার আহ্বান করছেন তার সমর্থকদের। তার ভাষায় স্পষ্ট, যে বা যারাই তার মতের বিরুদ্ধে, তিনি তাদের প্রতি রাজনৈতিক প্রতিশোধ নিতে চান। এই ক্ষেত্রে তিনি আইন, প্রক্রিয়া ও মানবিক মর্যাদাকে অগ্রাহ্য করছেন।

আমাদের সমাজে জনগণের একাংশ মনে করছে যে আইন কাজ করছে না, আর এই ক্ষেত্রে অনেকেই সহিংসতা বা মব সন্ত্রাসের প্রতি এক ধরনের প্রচ্ছন্ন সমর্থন দিচ্ছেন। বাস্তবতা হল, এই ঘটনাগুলো শুধু বিচার ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা তৈরি করছে না, বরং রাষ্ট্রকে অকার্যকর করে তুলছে। যদি প্রতিটি ক্ষোভ বা অভিযোগের নিষ্পত্তি হয় রাস্তায়, জুতা মেরে, কিংবা ভাঙচুর করে, তবে রাষ্ট্রের অস্তিত্বই প্রশ্নবিদ্ধ হয়। আর এই কাজটাই করছেন পিনাকী, জসীম কিংবা তাদের মতন আর অনেকে যারা মব সন্ত্রাসের সমর্থনে কথা বলছেন।

তারা সুকৌশলে নিজেদের সামাজিক ক্যাপিটাল ব্যবহার করে বিচারবর্জিত সহিংসতার জন্য মানুষকে উৎসাহ দিচ্ছেন। সমাজে আইনবিরোধী মনোভাবকে চাঙ্গা করে তুলছেন। এর মূল লক্ষ্য হল রাষ্ট্রকে দুর্বল করে ‘মব-শাসন’ প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত করা। এই বয়ানগুলোকে যদি আমরা চ্যালেঞ্জ করতে না পারি তবে 'যে সবচেয়ে রাগান্বিত, তাকে ক্ষমতা দাও' ধরনের একটা ব্যবস্থার দিকে আমরা এগিয়ে যাবো।

আন্দোলন, প্রতিবাদ এবং রাষ্ট্রের অন্যায় কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে অবস্থান গণতন্ত্রের অপরিহার্য অংশ। কিন্তু সেই অবস্থান যদি সহিংসতা, অবমাননা ও বিচারবহির্ভূত আচরণের আশ্রয় নেয়, তবে তা অন্যায়ের প্রতিবাদ নয়, আরেক ধরনের অন্যায়। জুলাই ভিন্ন প্রেক্ষাপট ছিল। তখন যে সহিংসতা হয়েছে, তা ছিল রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীদের বাঁচার চেষ্টা। কিন্তু জুলাই আন্দোলনের প্রায় এক বছর পরে এসে যারা এখন মব সন্ত্রাস করছেন, তারা মূলত আলোচনায় নিজেদের প্রভাব বজায় রাখতে মানুষকে সহিংসতায় উসকানি দিচ্ছেন। এরা সমাজকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছে: 'আমরা' বনাম 'তারা'। এবং এই বিভাজন রেখায় থেকে পিনাকী কিংবা জসীম যে সহিংসতাকে বৈধতা দিচ্ছেন, তা আর প্রতিবাদ নয়, বরং এক ধরনের চরমপন্থী দমননীতি। তারা নিপীড়কের ভূমিকায় আত্মপ্রকাশ করেছেন।

আমাদের প্রয়োজন ন্যায়ের জন্য লড়াই, প্রতিশোধের জন্য নয়। এজন্য পথ হতে হবে নৈতিক, আইনসম্মত ও মানবিক।

পাঠকের মতামত:

ট্যাগ: মব

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

আমেরযত কাহিনি

আমেরযত কাহিনি

নিজস্ব প্রতিবেদক: স্বাদ, গন্ধ ও পুষ্টিগুণে পরিপূর্ণ ‘আম’ শুধু একটি ফল নয়, বরং এটি ইতিহাস, সংস্কৃতি ও অর্থনীতিতে গভীরভাবে প্রোথিত এক... বিস্তারিত