মতামত
মব সন্ত্রাস বনাম ন্যায়বিচার: জসীম-পিনাকী বয়ানের বিপজ্জনক রাজনীতি

আসিফ বিন আলী
শিক্ষক ও স্বাধীন সাংবাদিক
"আমি জুলাইয়ে পুলিশ পিটাইছি। আমি ৩২ ভাঙছি। আমি নূরুল হুদাকে জুতা মারছি। আমি জসীম, স্বৈরাচারের যেকোনো কুলাঙ্গারকে পাইলে জুতা মারবো। সাহস থাকলে আমাকে ‘মব’ বলে গ্রেফতার কর সুশীলের বাচ্চারা।"
এই লেখার একটি পোস্টার সোশ্যাল মিডিয়াতে ঘুরছে। এই কথা যিনি বলেছেন তিনি জসীম খান, নিজেকে পরিচয় দিচ্ছেন জুলাই আন্দোলনে চোখ হারানো 'যোদ্ধা' হিসেবে। অন্যদিকে পিনাকী লিখেছেন, "হাসিনার নির্বাচন কমিশনার হুদাকে যেই আপ্যায়ন করা হইছে, হুদার জন্য কান্নাকাটি করা সবাইকে একই আপ্যায়ন করা হইবে। ঘোষণাটি শেষ হলো।" এই ধরনের বক্তব্যের অন্তর্নিহিত অর্থ থাকে। সেই আলাপটাই এখানে করি।
জসীম যখন বলছে, "আমি জুলাইয়ে পুলিশ পিটাইছি। আমি ৩২ ভাঙছি। আমি নূরুল হুদাকে জুতা মারছি..." এই বাক্যগুলো নিছক আবেগ বা প্রতিবাদের ভাষা নয়; এগুলো একটি স্পষ্ট আত্মদম্ভ। তিনি সহিংসতাকে গৌরবের কাজ হিসেবে দেখছেন। (উল্লেখ্য, জুলাইতে আন্দোলনের প্রেক্ষিতে সহিংসতা হয়েছে এবং সেই সহিংসতায় দুই পক্ষই অংশ নিয়েছে, কিন্তু সেই সহিংসতার দায় আন্দোলনকারীদের নয়, কেননা সেখানে রাষ্ট্র প্রথম সহিংস আচরণ শুরু করে এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে নাগরিকদের হ।..ত্যা করতে থাকে)। জসীম খান নিজেকে ‘যোদ্ধা’ হিসেবে দাবি করছেন, তার চোখ হারানোর বেদনা এবং প্রতিবাদ অবশ্যই বিবেচনার দাবিদার। কিন্তু এই ব্যক্তিগত ক্ষতির ভিত্তিতে তিনি আইন নিজ হাতে তুলে নিতে চাইছেন। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে জসীমের এই বক্তব্য একটি বিপজ্জনক উদাহরণ। তার বক্তব্যকে প্রশংসা করার কিছু নেই। এই বক্তব্য এক ব্যক্তির দম্ভ যে নিজেকে আইনের ঊর্ধ্বে মনে করছে।
জসীম ও পিনাকীর বক্তব্যের মাধ্যমে মব সন্ত্রাসকে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে। পিনাকী এই কাজ অনেক আগে থেকেই করে আসছেন। মানবাধিকারের দোহাই দিয়ে প্রবাসে থেকে তিনি নিজেই দেশের অভ্যন্তরে মানবাধিকারের লঙ্ঘন হয় এমন কাজে নিয়মিত উসকানি দিচ্ছেন ও সংগঠনে কাজ করছেন।
জসীম যখন বলেন "সাহস থাকলে আমাকে ‘মব’ বলে গ্রেফতার কর সুশীলের বাচ্চারা", কিংবা পিনাকী যখন লেখেন, "হুদার জন্য কান্নাকাটি করা সবাইকে একই আপ্যায়ন করা হইবে", তখন এর মাধ্যমে তারা আইন ও রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করেন। এটি স্পষ্ট করে যে তারা নিজেকে আইনের ঊর্ধ্বে ভাবছেন, নিজেদের ‘ন্যায়ের প্রতীক’ হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন। তাদের এই আচরণ সমাজে বিচারবহির্ভূত শাস্তির সংস্কৃতিকে বৈধতা দেয়। এই সংস্কৃতি ভবিষ্যতে আরও সহিংসতার পথ প্রশস্ত করতে পারে।
পিনাকী ভট্টাচার্যের লেখা "হাসিনার নির্বাচন কমিশনার হুদাকে যেই আপ্যায়ন করা হইছে... সবাইকে একই আপ্যায়ন করা হইবে"— এটি একটি স্পষ্ট হুমকি তাদের প্রতি যারা ঐ মব সন্ত্রাসের প্রতিবাদ করেছেন। তিনি ব্যক্তিকে অপরাধের জন্য শাস্তি নয়, বরং পরিচয়ের ভিত্তিতে ‘একই ধরনের সহিংসতা’ করার আহ্বান করছেন তার সমর্থকদের। তার ভাষায় স্পষ্ট, যে বা যারাই তার মতের বিরুদ্ধে, তিনি তাদের প্রতি রাজনৈতিক প্রতিশোধ নিতে চান। এই ক্ষেত্রে তিনি আইন, প্রক্রিয়া ও মানবিক মর্যাদাকে অগ্রাহ্য করছেন।
আমাদের সমাজে জনগণের একাংশ মনে করছে যে আইন কাজ করছে না, আর এই ক্ষেত্রে অনেকেই সহিংসতা বা মব সন্ত্রাসের প্রতি এক ধরনের প্রচ্ছন্ন সমর্থন দিচ্ছেন। বাস্তবতা হল, এই ঘটনাগুলো শুধু বিচার ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা তৈরি করছে না, বরং রাষ্ট্রকে অকার্যকর করে তুলছে। যদি প্রতিটি ক্ষোভ বা অভিযোগের নিষ্পত্তি হয় রাস্তায়, জুতা মেরে, কিংবা ভাঙচুর করে, তবে রাষ্ট্রের অস্তিত্বই প্রশ্নবিদ্ধ হয়। আর এই কাজটাই করছেন পিনাকী, জসীম কিংবা তাদের মতন আর অনেকে যারা মব সন্ত্রাসের সমর্থনে কথা বলছেন।
তারা সুকৌশলে নিজেদের সামাজিক ক্যাপিটাল ব্যবহার করে বিচারবর্জিত সহিংসতার জন্য মানুষকে উৎসাহ দিচ্ছেন। সমাজে আইনবিরোধী মনোভাবকে চাঙ্গা করে তুলছেন। এর মূল লক্ষ্য হল রাষ্ট্রকে দুর্বল করে ‘মব-শাসন’ প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত করা। এই বয়ানগুলোকে যদি আমরা চ্যালেঞ্জ করতে না পারি তবে 'যে সবচেয়ে রাগান্বিত, তাকে ক্ষমতা দাও' ধরনের একটা ব্যবস্থার দিকে আমরা এগিয়ে যাবো।
আন্দোলন, প্রতিবাদ এবং রাষ্ট্রের অন্যায় কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে অবস্থান গণতন্ত্রের অপরিহার্য অংশ। কিন্তু সেই অবস্থান যদি সহিংসতা, অবমাননা ও বিচারবহির্ভূত আচরণের আশ্রয় নেয়, তবে তা অন্যায়ের প্রতিবাদ নয়, আরেক ধরনের অন্যায়। জুলাই ভিন্ন প্রেক্ষাপট ছিল। তখন যে সহিংসতা হয়েছে, তা ছিল রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীদের বাঁচার চেষ্টা। কিন্তু জুলাই আন্দোলনের প্রায় এক বছর পরে এসে যারা এখন মব সন্ত্রাস করছেন, তারা মূলত আলোচনায় নিজেদের প্রভাব বজায় রাখতে মানুষকে সহিংসতায় উসকানি দিচ্ছেন। এরা সমাজকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছে: 'আমরা' বনাম 'তারা'। এবং এই বিভাজন রেখায় থেকে পিনাকী কিংবা জসীম যে সহিংসতাকে বৈধতা দিচ্ছেন, তা আর প্রতিবাদ নয়, বরং এক ধরনের চরমপন্থী দমননীতি। তারা নিপীড়কের ভূমিকায় আত্মপ্রকাশ করেছেন।
আমাদের প্রয়োজন ন্যায়ের জন্য লড়াই, প্রতিশোধের জন্য নয়। এজন্য পথ হতে হবে নৈতিক, আইনসম্মত ও মানবিক।
ন্যায়ভিত্তিক ও মানবিক সমাজ গড়তে হলে রাষ্ট্রকে অবশ্যই তার সামাজিক ও নৈতিক দায়বদ্ধতা পুনরুদ্ধার করতে হবে

মো: রাকিবুল ইসলাম
সমাজবিজ্ঞান শিক্ষার্থী, গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
রাষ্ট্রের ধারণাটি একসময় কেবল প্রশাসনিক ক্ষমতা, আইনের শাসন এবং নিরাপত্তা প্রদানের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। কিন্তু আধুনিক বিশ্বে রাষ্ট্রের ভূমিকা এখন বহুমাত্রিক এবং জটিল। রাষ্ট্র কেবল শাসনের প্রতীক নয়, বরং এটি একটি সামাজিক ও নৈতিক সত্তা, যার মূল উদ্দেশ্য মানুষের কল্যাণ, মর্যাদা এবং ন্যায্যতা নিশ্চিত করা। অথচ আজ আমরা এমন এক সময় পার করছি, যখন রাষ্ট্রের এই নৈতিক দায়বদ্ধতা ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে এবং রাষ্ট্রীয় নীতিমালা ক্রমশ বাজারের যুক্তি ও পুঁজির অগ্রাধিকারের সঙ্গে অদ্ভুত এক সমঝোতায় আবদ্ধ হয়ে পড়েছে।
বিশ্বায়ন ও মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগে রাষ্ট্রের পরিমণ্ডল নাটকীয়ভাবে পাল্টে গেছে। এখন রাষ্ট্রের সফলতা মাপা হয় জিডিপি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, অবকাঠামোগত প্রকল্প বা বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ দিয়ে। কিন্তু এই তথাকথিত উন্নয়ন সূচকগুলো প্রায়ই মানবিক উন্নয়ন বা সামাজিক ন্যায়বিচারের বাস্তব প্রতিফলন ঘটায় না। যখন একজন নাগরিক মানসম্মত শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা বা নিরাপদ জীবনযাপনের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, তখন রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের যুক্তিতে রাষ্ট্র এখন প্রায়শই কর্পোরেট স্বার্থে বেশি সংবেদনশীল হয়ে পড়েছে এবং সাধারণ নাগরিকের চাহিদায় তুলনামূলকভাবে উদাসীন। এর ফলেই ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে আয়-বৈষম্য বেড়েছে, সামাজিক শ্রেণি বিভাজন গভীর হয়েছে, শ্রমজীবী মানুষ তাদের পরিশ্রমের ন্যায্য মূল্য পায় না, কৃষক উৎপাদনের দাম না পেয়ে ঋণের জালে জড়ায়, শিক্ষার্থীরা মানসম্মত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয় এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় সেবার বাইরে থেকে যায়।
এই বৈষম্য কেবল অর্থনৈতিক নয়, এটি নৈতিক বৈষম্যেরও প্রতিফলন। রাষ্ট্র যখন বাজারের যুক্তিকে মানবিক দায়বদ্ধতার ঊর্ধ্বে স্থান দেয়, তখন নাগরিকের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক দুর্বল হয়ে পড়ে। এর ফলে রাষ্ট্রীয় কাঠামো এক ধরনের নৈতিক সংকটে পড়ে যায়, যেখানে উন্নয়নের অর্থ হয়ে দাঁড়ায় কেবল ধনীদের আরও ধনী হয়ে ওঠা এবং দরিদ্রদের অদৃশ্য হয়ে যাওয়া।
রাষ্ট্রকে কেবল প্রশাসনিক ক্ষমতার কেন্দ্র হিসেবে দেখা হলে তার প্রকৃত উদ্দেশ্য হারিয়ে যায়। রাষ্ট্র হলো এমন এক প্রতিষ্ঠান যার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা উচিত মানুষ, তার জীবন, মর্যাদা এবং ন্যায়বিচারের অধিকার। রাষ্ট্রের অস্তিত্বের মূল দর্শনই হলো জনকল্যাণ। একটি মানবিক রাষ্ট্র কেবল আইন প্রয়োগ করে না, বরং এটি নাগরিকদের জন্য আশ্রয়, নিরাপত্তা এবং সম্মানের নিশ্চয়তা দেয়। সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে রাষ্ট্রকে বলা যায় একটি নৈতিক সম্প্রদায়, যা সমাজের দুর্বলতম ও প্রান্তিক শ্রেণির প্রতি দায়বদ্ধ। কারণ একটি সমাজের সভ্যতা বিচার করা হয় তার সবচেয়ে দুর্বল মানুষটির প্রতি আচরণের মাধ্যমে।
রাষ্ট্রের নৈতিক পুনর্জাগরণ মানে হলো রাষ্ট্রীয় নীতিমালা ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে মানবিকতার চেতনায় পুনর্গঠন করা। যেখানে উন্নয়নের মানে হবে না কেবল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, বরং শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক ন্যায়, সংস্কৃতি, পরিবেশ এবং সমতার বিকাশ। এই দৃষ্টিভঙ্গির অভাবই আজকের রাষ্ট্রকে ধীরে ধীরে মানবিকতার শূন্যতায় ঠেলে দিচ্ছে।
একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের জন্য রাষ্ট্রকে তার দায়িত্ব নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে হবে। উন্নয়ন ও কল্যাণের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষায় কিছু মৌলিক দিক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোর কার্যকারিতা ও বিস্তৃতি বাড়াতে হবে। দরিদ্র, বয়স্ক, প্রতিবন্ধী, নারী ও শিশুদের জন্য কার্যকর নিরাপত্তা নেট তৈরি করা দরকার। এগুলোকে রাজনৈতিক প্রদর্শন নয়, বরং বাস্তব কল্যাণে রূপ দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষা ব্যবস্থায় মানবিকতা ও ন্যায়বোধের বিকাশ ঘটাতে হবে। মানসম্মত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা হলো মানবিক রাষ্ট্র গঠনের ভিত্তি। শিক্ষা কেবল চাকরির উপকরণ নয়, এটি মূল্যবোধ, যুক্তি, সহানুভূতি ও নৈতিকতার প্রশিক্ষণ। তাই রাষ্ট্রের উচিত গবেষণা, সৃজনশীলতা ও সামাজিক চিন্তার বিকাশে বিনিয়োগ বাড়ানো, যাতে নাগরিকরা শুধু দক্ষ নয়, সচেতনও হয়।
তৃতীয়ত, স্বাস্থ্যসেবাকে নাগরিক অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। একটি মানবিক রাষ্ট্রে স্বাস্থ্যসেবা কখনোই বাণিজ্যিক পণ্য হতে পারে না। সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে হবে, প্রান্তিক অঞ্চলে চিকিৎসক নিয়োগ ও ওষুধপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে, এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসা সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। চতুর্থত, শ্রমজীবী মানুষের জন্য ন্যায্য মজুরি, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা, সামাজিক সুরক্ষা ও সংগঠিত হওয়ার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। উন্নয়ন তখনই অর্থবহ, যখন তা শ্রমিকের ঘামে নয়, মর্যাদায় দাঁড়িয়ে থাকে।
পঞ্চমত, রাষ্ট্রের নীতি প্রণয়নে নাগরিক অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। স্থানীয় সরকার, নাগরিক ফোরাম, যুবসংগঠন ও সিভিল সোসাইটির সক্রিয় ভূমিকা নিশ্চিত করতে হবে নীতি প্রণয়ন, বাজেট বরাদ্দ ও বাস্তবায়নে। এতে জনগণ নিজেদের রাষ্ট্রের অংশ হিসেবে অনুভব করবে। ষষ্ঠত, পরিবেশ সংরক্ষণ ও জলবায়ু ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। একটি ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র মানে কেবল মানুষের ন্যায় নয়, প্রকৃতির প্রতিও দায়িত্বশীলতা।
মানবিক রাষ্ট্র কোনো আদর্শিক কল্পনা নয়, এটি টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত। একটি রাষ্ট্র তখনই স্থিতিশীল ও উন্নত হয়, যখন তার নাগরিকরা বিশ্বাস করে যে তাদের জীবন রাষ্ট্রের কাছে মূল্যবান। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি তখনই অর্থবহ, যখন তা সামাজিক সমতা ও মানবিক মর্যাদা নিশ্চিত করে। অন্যথায় রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন হয়ে ওঠে অন্যায় প্রবৃদ্ধি, যা কেবল কিছু মানুষের হাতে ক্ষমতা ও সম্পদ কেন্দ্রীভূত করে।
যখন রাষ্ট্র তার নৈতিক দায়বদ্ধতা হারায়, তখন নাগরিকের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক হয়ে যায় লেনদেনমূলক, আস্থাভিত্তিক নয়। মানুষ তখন রাষ্ট্রকে নিজের বলে অনুভব করে না। এই বিচ্ছিন্নতাই শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সামাজিক অসন্তোষ ও সহিংসতার জন্ম দেয়। তাই রাষ্ট্রের নৈতিক পুনর্জাগরণ প্রয়োজন তিনটি স্তরে। প্রথমত, নীতিগত স্তরে মানবিকতা, স্বচ্ছতা ও ন্যায়কে সর্বাগ্রে স্থান দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, প্রাতিষ্ঠানিক স্তরে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থায় জবাবদিহিতা এবং নৈতিক প্রশিক্ষণকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তৃতীয়ত, সাংস্কৃতিক স্তরে সমাজে সহানুভূতি, দানশীলতা ও সামাজিক সংহতির চর্চা বাড়াতে হবে এবং গণমাধ্যম ও সংস্কৃতির মাধ্যমে মানবিক মূল্যবোধ পুনরুজ্জীবিত করতে হবে।
ন্যায়ভিত্তিক ও মানবিক সমাজ গঠন কোনো বিলাসিতা নয়, এটি রাষ্ট্র ও সমাজের অস্তিত্বের অপরিহার্য শর্ত। রাষ্ট্র যদি তার নৈতিক দায়িত্ব ভুলে যায়, তবে তার উন্নয়ন অবশেষে হয়ে উঠবে এক নির্মম শোষণের প্রক্রিয়া। তাই এখন সময় রাষ্ট্রের আত্মসমালোচনা ও আত্মশুদ্ধির। রাষ্ট্রকে ফিরতে হবে সেই মৌলিক দর্শনে, যেখানে নাগরিকই উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু, আর শাসকগোষ্ঠী কেবল সেই উন্নয়নের তত্ত্বাবধায়ক।
একটি রাষ্ট্র তখনই প্রকৃত অর্থে সফল হয়, যখন তার প্রতিটি নাগরিক বিশ্বাস করতে পারে যে এই রাষ্ট্র আমার, এই সমাজ আমার, এবং এখানে আমার জীবনের মর্যাদা আছে। ন্যায়, সমতা এবং মানবিকতার ওপর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রই পারে দীর্ঘমেয়াদে টেকসই উন্নয়ন ও সামাজিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে। রাষ্ট্রের এই নৈতিক পুনর্জাগরণই হতে পারে আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ও নৈতিক বিজয়, একটি ন্যায়ভিত্তিক, মানবিক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশের জন্য।
গবেষণা ভিত্তিক শিক্ষা: বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য এক নতুন দিগন্ত

মো. রাকিবুল ইসলাম
সমাজবিজ্ঞান শিক্ষার্থী, গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের পাঠদান, দীর্ঘদিন ধরে পাঠ্যপুস্তকনির্ভর শিক্ষা ও পরীক্ষাকেন্দ্রিক মূল্যায়নের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এই ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা, বিশ্লেষণধর্মী চিন্তাভাবনা এবং বাস্তব জীবনে জ্ঞানের প্রয়োগের ক্ষেত্র ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। অথচ আজকের পৃথিবী জ্ঞাননির্ভর অর্থনীতি, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবননির্ভর সমাজের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, যেখানে গবেষণাভিত্তিক শিক্ষা হচ্ছে উন্নয়নের মূল চালিকা শক্তি। তাই সময় এসেছে আমাদের উচ্চশিক্ষার কাঠামো ও দর্শনকে পুনর্বিন্যাস করার, যেখানে গবেষণা হবে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দু।
বিশ্বের ইতিহাসে যেকোনো মৌলিক পরিবর্তন এসেছে গবেষণার মাধ্যমে। বিজ্ঞানের অগ্রগতি, নতুন প্রযুক্তির বিকাশ, কৃষি ও স্বাস্থ্যখাতে উদ্ভাবন, কিংবা সমাজ ও রাষ্ট্রনীতির সংস্কার—সব ক্ষেত্রেই গবেষণা জ্ঞানের উৎস হিসেবে কাজ করেছে। গবেষণা শুধু তথ্য সংগ্রহের প্রক্রিয়া নয়, এটি এক গভীর চিন্তা, অনুসন্ধান ও সৃষ্টিশীলতার যাত্রা। তাই একটি জাতিকে সত্যিকার অর্থে জ্ঞানসমৃদ্ধ করতে হলে গবেষণাকে শিক্ষার ভিত্তিতে পরিণত করা ছাড়া বিকল্প নেই।
বিশ্ববিদ্যালয় কেবল ডিগ্রি প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান নয়, বরং এটি জাতির চিন্তা, মেধা ও নেতৃত্ব গঠনের কারখানা। এখানেই গড়ে ওঠে নতুন ভাবনা, প্রশ্ন ও অনুসন্ধান। উন্নত দেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, তারা পাঠদানের পাশাপাশি গবেষণাকে মূল ভিত্তি হিসেবে নিয়েছে। হার্ভার্ড, এমআইটি, কেমব্রিজ বা অক্সফোর্ডের মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আজ যেভাবে বিশ্বজুড়ে নেতৃত্ব দিচ্ছে, তার মূল কারণ হলো তাদের গবেষণানির্ভর শিক্ষা ও উদ্ভাবনী সংস্কৃতি।
সেখানে শিক্ষার্থীরা শুধু ক্লাসরুমের পাঠে সীমাবদ্ধ থাকে না; তারা গবেষণার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকে। কেউ গবেষণা সহকারী হিসেবে (Research Assistant) কাজ করে, কেউ শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য শিক্ষাদানে সহায়তা করে (Teaching Assistant)। এতে তারা একদিকে ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জন করে, অন্যদিকে আত্মবিশ্বাস, বিশ্লেষণক্ষমতা এবং নেতৃত্বের দক্ষতা গড়ে তোলে।
দুঃখজনকভাবে, বাংলাদেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো গবেষণানির্ভর সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। বিশেষ করে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীরা গবেষণায় সরাসরি যুক্ত হওয়ার সুযোগ পায় না। শিক্ষাদানের সহকারী হিসেবেও তাদের অংশগ্রহণের সুযোগ নেই। ফলে তারা কেবল ডিগ্রি অর্জন করলেও বাস্তব দক্ষতা, আত্মবিশ্বাস এবং সৃজনশীল চিন্তায় পিছিয়ে থাকে। এই ঘাটতি শুধু ব্যক্তিগত নয়, বরং পুরো উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতাকে প্রকাশ করে।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য উচ্চশিক্ষায় কাঠামোগত সংস্কার অপরিহার্য। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণাভিত্তিক শিক্ষা চালু করতে হবে এবং শিক্ষার্থীদের রিসার্চ ও টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে যুক্ত হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। এজন্য দরকার সুনির্দিষ্ট নীতিমালা, আলাদা বাজেট, প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা এবং নিয়মিত মূল্যায়ন। শুরুতে কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে এটি চালু করে ফলাফল বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। সফল হলে তা ধাপে ধাপে জাতীয় পর্যায়ে বিস্তৃত করা সম্ভব।
আজকের শিক্ষার্থীকে কেবল পাঠ্যপুস্তকের মধ্যে আবদ্ধ রেখে গড়ে তোলা সম্ভব নয়। তাকে হতে হবে অনুসন্ধিৎসু, চিন্তাশীল ও উদ্ভাবনী। গবেষণাভিত্তিক শিক্ষা সেই পথই তৈরি করতে পারে, যেখানে শিক্ষার্থী কেবল তথ্যের ভান্ডার নয়, বরং নতুন জ্ঞানের স্রষ্টা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে।
আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত এমন একটি শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যা শুধু সনদপ্রাপ্ত কর্মী তৈরি করবে না, বরং সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে নেতৃত্ব দিতে পারবে এমন চিন্তাশীল নাগরিক তৈরি করবে। কারণ গবেষণানির্ভর শিক্ষাই একমাত্র পথ, যা বাংলাদেশকে বিশ্বমানের উচ্চশিক্ষার নতুন দিগন্তে পৌঁছে দিতে পারে।
সংষ্কারের নামে বিরাজনীতিকরণ: বিএনপির বাস্তববাদী অবস্থান ও এন্টি পলিটিক্সের ফাঁদ

ড. বাতেন মোহাম্মদ
শিক্ষক ও রাজনৈতিক গবেষক
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় সংষ্কার প্রসঙ্গটি এখন এক ধরনের নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় বিএনপির অবস্থান নিয়ে আমার ব্যক্তিগত দ্বিমত থাকলেও, পুরো প্রক্রিয়ায় দলটি অন্তত সৎ থাকার চেষ্টা করেছে—এ কথাটি অস্বীকার করার উপায় নেই। বিএনপি সে মাত্রায়ই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থেকেছে, যতটা তার মতো একটি বুর্জোয়া ড্রিভেন ও পার্টি ক্যাপিটালিস্ট দলের পক্ষে বাস্তবিকভাবে সম্ভব। বিএনপি কখনোই আদর্শবাদী দল নয়, বরং এটি বাস্তববাদী দল, যে দল রাজনৈতিক তত্ত্বের চেয়ে রাজনৈতিক বাস্তবতাকে বেশি গুরুত্ব দেয়।
চাইলেই বিএনপি সব সংষ্কার প্রস্তাবে “হ্যাঁ” বলে ক্ষমতায় গিয়ে নিজের সুবিধামতো যা পারত বাস্তবায়ন করত, আর যা পারত না সেটাকে নানা যুক্তি ও ব্যাখ্যার ভেতর লুকিয়ে রাখত। অর্থাৎ সুযোগ ছিল সহজ পথে হেঁটে লোকদেখানো সংস্কারে অংশ নেওয়ার। কিন্তু দলটি সেই ইজি রাউট নেয়নি। রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি মূলত “ইন্সট্রুমেন্টাল র্যাশনাল” অর্থাৎ যে যুক্তিবোধ ক্ষমতার ব্যবহার ও রিসোর্স একুমুলেশনকেই কেন্দ্রে রাখে।
বাংলাদেশের মতো ইনফরমাল অর্থনীতিনির্ভর রাষ্ট্রে এমন দলের কাঠামোতে র্যাডিকাল বা গভীর সংস্কারে রাজি হওয়া শুধু কঠিনই নয়, অনেক ক্ষেত্রেই প্রায় অসম্ভব। তবু বিএনপি তার সামর্থ্যের চেয়ে বেশি এগিয়েছে। একটা বিশাল দল, যার এখনো দলীয় পরিচালনার জন্য সংগঠিত কোনো অর্থনৈতিক কাঠামো নেই, সেই দলের কাছ থেকে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের পূর্ণ প্রতিশ্রুতি আশা করাটা অবাস্তব। তার ওপর দেশের ভঙ্গুর প্রাতিষ্ঠানিক উত্তরাধিকারের প্রেক্ষাপটে ক্ষমতার অতিরিক্ত বিকেন্দ্রীকরণ নতুন ক্ষমতাকেন্দ্র বা পকেট তৈরি করতে পারে, এটাও এক বাস্তব ঝুঁকি।
এই ঝুঁকি জেনেও বিএনপি সংষ্কারে যতটুকু রাজি হয়েছে, সেটিকে যদি কেবল পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মনের প্রত্যাশার ভিত্তিতে বিচার না করে, বরং এক গড়পড়তা শিক্ষিত, নিরাপত্তাহীন ও অনিশ্চিত চাকরিজীবী বা দলীয় কর্মীর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, তাহলে বোঝা যাবে বিএনপি আসলে নিজের সামর্থ্যের চেয়েও বেশি অগ্রসর হয়েছে। তবু যারা সংষ্কারভীতি ছড়িয়ে দলটিকে দুর্বল করতে চাইছে, তাদের আচরণ শেষ পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়ারই ক্ষতি করছে।
বিএনপি ক্ষমতাকেন্দ্রিক দল, এটা নতুন কিছু নয়। তবে এই সংষ্কার আলোচনায় তার ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা অন্য যেকোনো দলের তুলনায় বহুগুণ বেশি ছিল। সাধারণত যার পাওয়ার এসেন্ডিং প্রোবাবিলিটি বেশি, সে নিজের শর্তে দরকষাকষি করে, আর যাদের সম্ভাবনা কম তারা দরকষাকষি করে যতটা আদায় করা যায় সেই যুক্তিতে। এই বাস্তবতা মাথায় রেখেও বিএনপি সংষ্কারের আলোচনাকে এগিয়ে নিয়েছে, এটিই তার বড় রাজনৈতিক পরিণতিবোধের পরিচায়ক।
অবশ্যই আমাদের প্রত্যাশা ছিল বিএনপি আরও উদার হবে। কিন্তু যতটুকু উদার হয়েছে, সেটিও স্বীকার করতে হবে। বিএনপি যদি সত্যিই রিজিড হতো, তবে সংষ্কার প্রক্রিয়া এত দূর অগ্রসর হতো না। এই প্রেক্ষিতে দলটির “নোট অব ডিসেন্ট” বা ভিন্নমত প্রকাশের বিষয়টি যদি রাজনৈতিক অহংকার হিসেবে দেখা হয় এবং সেই সুযোগটিও না দেওয়া হয়, তবে সেটি হবে একপ্রকার এন্টি পলিটিক্স ট্রিক, যেখানে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকেই অকার্যকর করে ফেলা হয়। কারণ নির্বাচনী রাজনীতিতে ইগো ও রেটরিক অনেক সময় রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবেই ব্যবহৃত হয়।
আজকের সংষ্কার প্রক্রিয়া যে অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে, সেটাকে রাজনীতি বলা যাচ্ছে না। এটা এখন হয়ে উঠছে এক ধরনের বিরাজনীতিকরণ বা এন্টি পলিটিক্স। বিএনপির মতো একটি ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল যদি নিজেও এই ধরনের এন্টি পলিটিকাল টুল প্রয়োগ শুরু করে, তাহলে যতটুকু সংষ্কার অগ্রগতি হয়েছে বলে মনে হচ্ছে, ঠিক ততটাই পেছনে চলে যাবে। এর লাভ কারো হবে না, বরং দেশের রাজনৈতিক কাঠামো ও গণতন্ত্রেরই ক্ষতি হবে শেষ পর্যন্ত।
এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন জাগে, আমরা আসলে রাজনীতি করছি, নাকি রাজনীতিকে ধ্বংস করছি? যে সংষ্কার কার্যক্রমকে এতদিন রাজনৈতিক পুনর্গঠন বলে গলা ফাটানো হলো, সেটাই কি শেষ পর্যন্ত এক এন্টি পলিটিক্স মেশিন হয়ে উঠছে না? সমাজবিজ্ঞানী জেমস ফার্গুসনের ভাষায়, যে প্রক্রিয়া রাজনীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক করার কথা ছিল, সেটিই যখন রাজনীতিকেই নির্বিষ ও অচল করে তোলে, তখন সেটি আর সংষ্কার নয়, এক ধরনের নীরব বিরাজনীতিকরণ।
এটাই আজকের বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংষ্কারের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। সংষ্কারের নামে রাজনীতির মৃত্যু, আর রাজনীতির নামে সংষ্কারের অনন্তঅপূর্ণতা।
লেখক: ড. মোহাম্মদ আব্দুল বাতেন, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড সোসিওলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক।
বিএনপি ও সংস্কারের রাজনীতি: ম্যান্ডেট, কূটচাল ও টেকসই বৈধতার পরীক্ষায় বাংলাদেশ

আসিফ বিন আলী
শিক্ষক ও স্বাধীন সাংবাদিক
বিএনপির অনেক নেতা–কর্মী মনে করছেন জামাত, সরকার ও এনসিপি মিলে তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে তিন ধরনের দল আছে, A, B ও C। A বড় দল, এই গ্রুপে আছে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ। B মাঝারি দল, এই গ্রুপে আছে জামাত ও জাতীয় পার্টি। C হলো বাকি দল—যেমন এনসিপি, এবি পার্টি, ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ ও অন্যান্য বামপন্থি দল। সাম্প্রতিক সময়ে যে সার্ভেগুলো হয়েছে তাতে যদিও দেখা যাচ্ছে জামাতের অবস্থান আওয়ামী লীগের থেকে ভালো, তবু আওয়ামী লীগ যদি ভয়হীন পরিবেশে নিজের মতামত দিতে পারে, নিঃসন্দেহে তাদের অবস্থান জামাতের থেকে বেশি হবে। যাই হোক, সেই বিতর্কে না যাই। এই শক্তির মাত্রা মাথায় রেখেই বিএনপি গুড ফেইথে রাজনৈতিক ঐকমতের আলোচনায় অংশ নিয়েছে, অন্তত বিএনপি তাই মনে করে বলে আমার মনে হয়েছে। এবং আমরা দেখেছি, জুলাই সনদ ও ঘোষণা নিয়ে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল এক ধরনের ঐকমতে এসেছে, যদিও এনসিপি তার বাইরে থেকেছে।
বাস্তবতা হলো, দেড় বছর ধরে সরকারের এই পরীক্ষামূলক সংস্কারে বিএনপি অংশ নিয়েছে মূলত গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় ফেরার আশায়। ঠিক এই প্রত্যাশাকেই বিএনপির দুর্বলতা ভেবে জামাত, এনসিপি ও নব্য এলিটরা দরকষাকষি করেছে, বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে আলাপে এমন ধারণাই পাওয়া যায়। কিন্তু এই দরকষাকষির সীমানা কোথায়? সীমানা ছিল, নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্র না করা, নির্বাচন না পেছানো এবং জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটের আয়োজন না করা। বিএনপি বারবার বলেছে, সংবিধান সংস্কার হবে নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে। যে কোনো সভ্য দেশে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাই সংসদের মাধ্যমে সংবিধান সংস্কার করেন। অনির্বাচিত কোনো সরকার, তা যেভাবেই আসুক, এই অধিকার রাখে না। জোর করে করা যায়, কিন্তু জোর কেটে গেলে সেই সংস্কার টেকে না, তা যতই মহৎ হোক। জনগণের ম্যান্ডেট অপরিহার্য, আর সেই ম্যান্ডেট পাওয়ার পথ হলো নির্বাচন।এখন যে সব সংস্কার প্রস্তাব উঠছে, সেগুলোর প্রতিটিতে হ্যাঁ–না ভোটে জনমত নেওয়া একদিকে কষ্টসাধ্য, অন্যদিকে ত্রুটিপূর্ণ। প্রশ্ন কীভাবে ফ্রেম হবে, তথ্য কে দেবে, প্রশাসন কতটা নিরপেক্ষ থাকবে, সবকিছুই বিতর্কিত হতে পারে। এমন অবস্থায়, যেখানে আওয়ামী লীগ–সমর্থক ভোটাররা এই সংস্কারে তেমন সমর্থন দেবেন না, সেখানে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ ছিল বাকিদের সমর্থন নিশ্চিত করা, খানিকটা ছাড় দিয়ে হলেও যেন সংখ্যাগরিষ্ঠতার ম্যান্ডেট দাঁড়ায়। নিঃসন্দেহে জামাত, বিএনপি, এনসিপি ও বামপন্থি দলগুলো মিলে এমন একটি সংখ্যাগরিষ্ঠতা তৈরি হতে পারত, যা এই ধরনের সাংবিধানিক পরিবর্তনকে জনগণের ম্যান্ডেটের বৈধতা দিত। কিন্তু সেই পথে না হেঁটে সংস্কার কমিশন যে পথে হাঁটলেন, তা রাজনৈতিক ভুল বলেই মনে হতে পারে। এর ফলে হয়তো তারা বিএনপির সমর্থন হারানোর পথে।
আরও স্পষ্ট করে বলি, বাংলাদেশের বৈধতার কেন্দ্র A গ্রুপে। B–C গ্রুপ চাপ দিতে পারে, কিন্তু টেকসই বৈধতা বানাতে পারে না। তাই বিএনপি যদি সনদ থেকে সমর্থন ফিরিয়ে নেয়, জামাত–এনসিপি–সরকার মিলে চেষ্টা করলেও গণভোটে “জনগণের রায়” বলে যা দেখাতে চাইবেন, তা বাস্তবে টেকসই বৈধতা তৈরি করবে না। বিএনপি নব্য এলিট ও বিপ্লবীদের কাছে “সংস্কার–বিরোধী” তকমা পেতেই পারে; কিন্তু গণভোটের হার–জিতের ক্ষেত্রে সেই ফ্রেমিং বড় ভূমিকা নাও রাখতে পারে। কারণ, ম্যান্ডেটের রাজনীতি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের রাজনীতি, এটি পাশ কাটানো যায় না।
আবার, রাজনৈতিক দল ও সরকারের ভেতরের যে অংশ নির্বাচন পিছিয়ে দিয়ে ক্ষমতায় থাকা নিশ্চিত করতে চায়, তাদের পক্ষে দীর্ঘদিন এই প্রক্রিয়া ধরে রাখা সম্ভব নয়। আজকের পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে কোনো শক্তিই তা রাজনৈতিক দল, আর্মি কিংবা অন্য কেউ, নির্বাচন ছাড়া সরকার গঠন করে টেকসই থাকতে পারবে না। এর শেষ পরিণতি ভয়াবহ। এই জটিল পরিস্থিতিতে সংস্কার কমিশনের উচিত ছিল রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দেখানো, সম্মতি জোগাড় করা, সীমা ঠেলে দেখা নয়। তারা উল্টোটা করেছেন, কতটা বাউন্ডারি পুশ করা যায়, বিএনপিকে কতটা বাঁধা দেওয়া যায়, এটাই যেন পরীক্ষা, অন্তত বিএনপির নেতা কর্মীরা তাই মনে করছেন।
প্রশ্ন এখন স্পষ্ট, এই রাজনৈতিক খেলায় বিএনপি কি পারবে নিজের অবস্থান শক্তভাবে জানাতে, না কি আরও ক্ষতির শিকার হবে? বিএনপি যদি আরও ছাড় দিতে থাকে, তৃণমূল এটাকে ভালোভাবে নেবে না; বরং একে দুর্বলতা হিসেবে পড়বে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগও বিএনপির দুর্বলতা নিয়ে মজা নেবে। রাজনীতিতে ইমেজ খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাই এখানে বিএনপির দায়িত্ব, রেডলাইন স্পষ্ট করা: নির্বাচন পেছানো যাবে না; সংবিধান–সংস্কার নির্বাচিত সংসদের ম্যান্ডেটে হবে। ইস্যুর ক্রম ঠিক করা: আগে নির্বাচন, তারপর সংসদীয় প্রক্রিয়ায় সংস্কার; প্রয়োজনে সীমিত, নির্দিষ্ট ধারায় গণভোট। এবং জোটের অঙ্ক কংক্রিট করা: বিচারব্যবস্থা, ইসি–রিফর্ম, মৌলিক অধিকার, ৩–৫টি কমন–মিনিমাম বিষয়ে সমঝোতা, বাকিগুলো সংসদে।
শেষ কথা, বিএনপি আজ ভেটো প্লেয়ার। বিএনপি আউট থাকলে গণভোটের রাস্তা বৈধতা আনতে পারবে না; বরং অনিশ্চয়তা বাড়াবে। তাই বিএনপির এখন দরকার পরিষ্কার সিগনাল, এক লাইনের বার্তা: আগে ম্যান্ডেট, পরে সংস্কার, কিন্তু আরও ভালোভাবে। নির্বাচন ছাড়া এই সঙ্কটের টেকসই সমাধান নেই; এবং নির্বাচন–পূর্ব যেকোনো শর্টকাট শেষতক নিজেই নিজের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়।
(আমি শুরু থেকেই নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছি। আমি মনে করি না, নির্বাচনের মাধ্যমে দেয়া জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া কারও সংবিধান সংস্কারের অধিকার আছে। তাই এই লেখায় আমার অবস্থানগত পক্ষপাত থাকতে পারে।)
রাজনীতি, নির্বাসন ও নৈতিকতা: শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার দক্ষিণ এশিয়ার বাস্তবতাকে কোথায় নিচ্ছে

মো. অহিদুজ্জামান
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও গবেষক
বাংলাদেশের রাজনীতিতে আবারও এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে। নির্বাসনে থাকা সাবেক প্রধানমন্ত্রী দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকাকে দেওয়া সেই সাক্ষাৎকারে তিনি ছাত্র আন্দোলনে নিহতদের বিষয়ে ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্ন সরাসরি নাকচ করেছেন। তাঁর ভাষায়, “The question of apology does not arise. My government acted to preserve order and stability.” এই বক্তব্য শুধু একটি রাজনৈতিক মন্তব্য নয়, বরং এটি তাঁর সমগ্র নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক দর্শনের প্রতিফলন।
শেখ হাসিনার এই বক্তব্য প্রকাশের সময় এবং প্রেক্ষাপট একে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। কারণ জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনারের ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে তাঁর সরকারের সময় ঘটে যাওয়া দমননীতিকে “brutal and systematic repression” বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, বিক্ষোভ দমনে এক হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে এবং নিহতদের প্রায় ৭৮ শতাংশ গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারিয়েছে। জাতিসংঘের হাইকমিশনার ভলকার টার্কের ভাষায়, “Top echelons of the previous government were aware and involved in very serious violations, including enforced disappearances, arbitrary detentions and violent suppression of protests.” এই মন্তব্যগুলো আন্তর্জাতিকভাবে ইঙ্গিত দিচ্ছে যে শেখ হাসিনার সরকারের সময় সংঘটিত ঘটনাগুলো মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
এই দুই বাস্তবতা এখন দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে একটি বড় প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। একজন অভিযুক্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী, যিনি মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচিত, তিনি এখন ভারতের আশ্রয়ে অবস্থান করছেন এবং সেখান থেকেই রাজনৈতিক বক্তব্য দিচ্ছেন। ভারত কি কেবল মানবিক কারণে তাঁকে আশ্রয় দিয়েছে, নাকি এটি বাংলাদেশের ওপর কৌশলগত চাপ প্রয়োগের একটি নতুন পদ্ধতি?
ভারত দীর্ঘদিন ধরে শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ মিত্র। তাঁর সময়েই ভারত সীমান্তনিরাপত্তা, ট্রানজিট, নদী ব্যবহার, জ্বালানি বাণিজ্য ও সংযোগনীতিতে বড় ধরনের সুবিধা পেয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবের পর এই ভারসাম্য ভেঙে যায়। শেখ হাসিনার পতনের সঙ্গে সঙ্গেই দিল্লি তাঁকে আশ্রয় দেয় এবং দ্রুত একটি বিশেষ সুরক্ষিত ভবনে তাঁর জন্য রাজনৈতিক সচিবালয় গঠন করে। এই সচিবালয়ের কার্যক্রম এখন ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ও কিছু কূটনৈতিক উপদেষ্টার তত্ত্বাবধানে চলছে। সেখানে নিয়মিতভাবে শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক হয় এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি নিয়ে নানামুখী আলোচনা চলে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। দিল্লি কি শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশের ওপর একধরনের নরম রাজনৈতিক চাপ বজায় রাখতে চাইছে? বিশেষ করে যখন বাংলাদেশের নতুন অন্তর্বর্তী সরকার ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি স্বাধীন ও ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেছে, তখন দিল্লির উদ্বেগ আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ভারত মনে করছে, হাসিনার পতনের ফলে তারা বাংলাদেশের ওপর আগের মতো প্রভাব বিস্তার করতে পারছে না। তাই শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে তারা একদিকে নিজেদের পুরোনো মিত্রকে ধরে রাখছে, অন্যদিকে বাংলাদেশের নতুন নেতৃত্বের ওপর কূটনৈতিক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে।
দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্টে দেওয়া শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকারটি তাই কেবল তাঁর ব্যক্তিগত মত নয়, বরং এটি একটি রাজনৈতিক বার্তা। তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগ ছাড়া কোনো নির্বাচন বৈধ নয় এবং বর্তমান সরকারের মেয়াদে তিনি দেশে ফিরবেন না। এই বক্তব্য স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দিচ্ছে যে তিনি এখনো নিজেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অপরিহার্য ব্যক্তি হিসেবে উপস্থাপন করতে চান। তবে এই বক্তব্যের সময়কাল এবং ভারতের সক্রিয় ভূমিকা ইঙ্গিত করছে যে এটি একটি পরিকল্পিত প্রচারণার অংশ। ভারত হয়তো চায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক অবস্থানকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করতে, যাতে বাংলাদেশের নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়।
অন্যদিকে, বাংলাদেশের বর্তমান সরকার মানবাধিকার, ন্যায়বিচার ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতাকে কেন্দ্র করে একটি নতুন কূটনৈতিক মডেল গড়ে তুলছে। জাতিসংঘের সহযোগিতায় গঠিত ট্রুথ অ্যান্ড জাস্টিস কমিশন ইতিমধ্যেই জুলাই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত শুরু করেছে। সরকার ভুক্তভোগী পরিবারের জন্য পুনর্বাসন কর্মসূচি এবং প্রশাসনিক সংস্কারের পরিকল্পনা নিয়েছে। এই উদ্যোগগুলো আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ওআইসি বাংলাদেশকে একটি নতুন গণতান্ত্রিক দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচনা করছে।
এই পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনার ক্ষমা অস্বীকারের বক্তব্য তাঁর নৈতিক অবস্থানকে আরও দুর্বল করেছে। এটি তাঁকে একটি অপ্রায়শ্চিত্ত রাজনৈতিক চরিত্রে পরিণত করেছে, যার কাছে মানবিক সংবেদনশীলতা ক্ষমতার চেয়ে ছোট হয়ে গেছে। ভারত এই অবস্থানকে রাজনৈতিকভাবে কাজে লাগাতে চাইছে কিনা, সেটিই এখন মূল প্রশ্ন। যদি সত্যিই দিল্লি মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত এক সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে আশ্রয় দিয়ে কূটনৈতিক প্রভাব বজায় রাখতে চায়, তবে এটি দক্ষিণ এশিয়ার নীতিগত রাজনীতির জন্য একটি বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত হয়ে উঠবে।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাস প্রমাণ করেছে, জনগণের ইচ্ছাশক্তি যেকোনো কূটনৈতিক চাপে বেশি শক্তিশালী। শেখ হাসিনার ক্ষমা অস্বীকৃতি ও ভারতের কৌশলগত দ্বৈততা হয়তো সাময়িক প্রভাব ফেলতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা এখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যেখানে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে ন্যায়, গণতন্ত্র ও মানবিক মূল্যবোধ।
দক্ষিণ এশিয়ার সামনে এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা আছে। কোনো রাষ্ট্র বা নেতা যদি জনগণের আস্থা হারায়, তবে তাকে আশ্রয় বা সমর্থন দিয়ে কৌশলগত প্রভাব বজায় রাখা কখনো স্থায়ী হয় না। শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার ও ভারতের বর্তমান ভূমিকা সেই সত্যটিকেই আবারও স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।
অভিভাবকতন্ত্রের প্রলোভন: জেনারেল ভূঁইয়ার বয়ান ও গণতন্ত্রের ঘড়ি থামানোর বিপদ

আসিফ বিন আলী
শিক্ষক ও স্বাধীন সাংবাদিক
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া সম্প্রতি তাঁর ফেসবুক পেজে লিখছেন ধারাবাহিক রাজনৈতিক বিশ্লেষণধর্মী পোস্ট, যার শিরোনাম “আগামী পাঁচ বছরে আমরা কোথায় যাচ্ছি?” এর পঞ্চম অংশে তিনি আলোকপাত করেছেন “বিএনপি ক্ষমতায় এলে সম্ভাব্য চিত্র” বিষয়ে। অভিজ্ঞ সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে তাঁর পর্যবেক্ষণ নিঃসন্দেহে মনোযোগ দাবি করে। তবে তাঁর লেখার রাজনৈতিক ফ্রেমিং ও বিশ্লেষণের অন্তর্নিহিত ধারা নিয়ে গভীরভাবে ভাবার প্রয়োজন আছে, বিশেষ করে যখন সেই বয়ানে নির্বাচিত রাজনীতিকদের “সমস্যা” এবং অ-নির্বাচিত এলিট বা উপদেষ্টাদের “সমাধান” হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।
এই ফ্রেমটি প্রথমেই একটি মৌলিক অস্বস্তি তৈরি করে, কারণ এটি প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নকে পাশ কাটিয়ে কার্যকারিতাকে একমাত্র গুণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। যেন গণতন্ত্রের মূল যুক্তি, অর্থাৎ ভোটের মাধ্যমে ম্যান্ডেট অর্জন, অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে এবং তার জায়গা নেয় “যোগ্য” অ-নির্বাচিত অভিভাবকদের শাসন। এটি একটি বিপজ্জনক স্লিপারি স্লোপ, যেখানে জনগণের ভোটাধিকার ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণের পরিবর্তে অভিভাবকতন্ত্রকে বৈধতা দেওয়া হয়। ইতিহাস বলছে, একবার যদি এই পথে যাত্রা শুরু হয়, নির্বাচনী রাজনীতির প্রাণশক্তি ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যায়।
জেনারেল ভূঁইয়ার লেখায় একটি স্পষ্ট কৌশল দেখা যায়, সেটি হলো ভয়কে রাজনৈতিক মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করা। তিনি ভারতীয় চাপ, অর্থনৈতিক সংকট, পুলিশের অকার্যকারিতা, রাস্তার সহিংসতা ইত্যাদি উদাহরণ টেনে এনে বলেছেন যে এসব কারণেই হয়তো অন্তর্বর্তী সরকারকে সময় বাড়াতে হবে বা “বিশেষ ব্যবস্থা” নিতে হতে পারে। এই ভয়নির্ভর বয়ান জনমনে এমন ধারণা তৈরি করে যে নির্বাচন অনিশ্চিত, ঝুঁকিপূর্ণ এবং বিলম্বই নিরাপদ পথ। ফলত একটি “ইলেকশন-অপশনাল” মানসিকতা জন্ম নেয়, যেখানে নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা ধীরে ধীরে ঐচ্ছিক হয়ে ওঠে। এটি গণতন্ত্রের শিকড় ক্ষয়ে দেওয়ার এক নীরব উপায়।
যখন তিনি লেখেন “রিফর্ম আগে, নির্বাচন পরে”, সেটি আসলে এক বিপরীত রাজনৈতিক সিকোয়েন্সের প্রচলন। টেকসই গণতন্ত্রে সংস্কারের বৈধতা আসে নির্বাচনের ম্যান্ডেট থেকে, কিন্তু তিনি উল্টো বলছেন নির্বাচনের আগেই সংস্কার হোক। বাস্তবে এর অর্থ দাঁড়ায় জনগণের ম্যান্ডেটহীন শক্তির হাতে রাজনৈতিক সংস্কারের দায়িত্ব তুলে দেওয়া। “রিফর্ম-ফার্স্ট” চিন্তাধারা অচিরেই “ইলেকশন-লেটার” হয়ে যায়, আর পিছিয়ে দেওয়া ভোট খুব কম ক্ষেত্রেই ফিরে আসে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসই তার প্রমাণ।
আরও উদ্বেগজনক হলো, জেনারেল ভূঁইয়া তাঁর লেখায় নিরাপত্তা কাঠামোকে এক ধরনের “নিরপেক্ষ ম্যানেজার” হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। পুলিশকে “অলস ঘোড়া” আখ্যা দিয়ে সেনাকে মাঠে রাখার বিষয়টি তিনি নিছক ম্যানেজমেন্ট ইস্যু হিসেবে দেখেছেন। এই দৃষ্টিভঙ্গি বেসামরিক জবাবদিহির প্রশ্নকে আড়াল করে এবং নিরাপত্তা সংস্থাগুলোকে ডি-ফ্যাক্টো রাজনৈতিক রেফারিতে রূপান্তরিত করে। গণতন্ত্রে নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা কখনোই রাজনীতির ভারসাম্যরক্ষাকারী হতে পারে না, কারণ তাতে নির্বাচিত নেতৃত্বের জবাবদিহি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ সরে যায় অদৃশ্য ব্যবস্থাপক মহলের হাতে।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, জেনারেল ভূঁইয়া সম্ভাব্য বিএনপি সরকারের প্রতি আগেভাগেই অবিশ্বাস প্রকাশ করেছেন। তাঁর পূর্বাভাসে দেখা যায়, বিএনপি ক্ষমতায় এলে দুর্নীতি বাড়বে, ভারতীয় সম্পর্কের অবনতি ঘটবে, রাস্তায় সহিংসতা হবে। এই ধরনের পূর্বাভাস আসলে রাজনৈতিক আগাম অবমূল্যায়ন, যা একটি বিপজ্জনক বার্তা দেয় যে “ভুল দল” জিতলে সেটিকে “ম্যানেজ” করা ন্যায্য। এতে নির্বাচনী গণতন্ত্রের মৌলিক শর্ত, অর্থাৎ শান্তিপূর্ণ ক্ষমতার পালাবদল, শর্তাধীন হয়ে পড়ে।
তাঁর বয়ানে নাগরিকরা নায়ক নয়, বরং “ঝুঁকি”। সমাধান খোঁজা হয় এলিট মহলের ভেতরে, “যোগ্য উপদেষ্টা” বা “সমঝোতার সরকার”-এর মধ্যে। এটি একধরনের ক্লাসিক এলিট সাবস্টিটিউশন, যেখানে জনসম্মতি সরিয়ে পেছনের দরজার চুক্তি সামনে আনা হয়। এতে রাজনৈতিক দল, ভোটার ও নীতির স্বাভাবিক সংযোগ দুর্বল হয়ে পড়ে; আস্থা কমে, অংশগ্রহণও হ্রাস পায়। ফলত গণতন্ত্র কেবল আনুষ্ঠানিক কাঠামোয় সীমিত থেকে যায়।
আরেকটি বিষয় হলো, তাঁর লেখায় বারবার “বহির্দেশের ভেটো”, বিশেষ করে ভারতের প্রভাব, একটি অনিবার্য বাস্তবতা হিসেবে হাজির হয়। এতে ইঙ্গিত মেলে যে নীতি-প্রসঙ্গগুলোতে বাইরের “রেড লাইন” অতিক্রম করা যায় না। এটি আসলে সার্বভৌম ভোটের অস্বীকৃতি, যেখানে জনমতকে আগে থেকেই সঙ্কুচিত বৃত্তে বন্দি করে ক্ষমতাবান এলিটরা সিদ্ধান্ত নেন কী সম্ভব আর কী নয়।
সব মিলিয়ে, জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়ার লেখার অন্তর্নিহিত বার্তা হলো ভয়নির্ভরতা, “রিফর্ম-ফার্স্ট” সিকোয়েন্স, এলিট ও টেকনোক্র্যাটিক সমাধান, এবং নিরাপত্তা কাঠামোর রাজনৈতিক ভূমিকার স্বাভাবিকীকরণ। এগুলো মিলে এক নতুন প্রকারের অভিভাবকতন্ত্রের ধারণা তৈরি করে, যেখানে জনগণ নয়, “দক্ষ ব্যবস্থাপক”-ই রাজনীতির নিয়ামক।
কিন্তু রাষ্ট্র কোনো ম্যানেজমেন্ট প্রকল্প নয়, এটি জনগণের সম্মিলিত ইচ্ছার প্রতিফলন। প্রজাতন্ত্র স্থিতি পায় ব্যালটের ঘড়িতে, যে ঘড়ির কাঁটা কারও ইচ্ছেমতো থামানো যায় না। নির্বাচনের সময়, গতি বা ফলাফল নিয়ে ভয় দেখানোর পরিবর্তে আমাদের দায়িত্ব হলো সেই ঘড়িটিকে সচল রাখা, যাতে জনগণই হয় ক্ষমতার একমাত্র উৎস।
জেনারেল ভূঁইয়ার প্রস্তাবিত “প্রাগম্যাটিক” পথটি যতই বাস্তবসম্মত মনে হোক, তার ভেতরে নিহিত আছে গণতন্ত্রের স্থবিরতার বীজ। আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো সেই স্থবিরতা থেকে মুক্ত থাকা, ব্যালটের ঘড়িকে চালু রাখা, এবং সব রাজনৈতিক শক্তিকে সেই সময়ের অধীন আনতে সক্ষম হওয়া। কারণ শেষ পর্যন্ত জনগণের ভোটই এই প্রজাতন্ত্রের প্রাণ, আর সেটিকে স্থগিত রাখা মানেই জাতির হৃদস্পন্দন থামিয়ে দেওয়া।
নেপালের গণঅভ্যুত্থান থেকে বাংলাদেশের শিক্ষা: বৈধতার সংকট, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আগামীর চ্যালেঞ্জ

আসিফ বিন আলী
শিক্ষক ও স্বাধীন সাংবাদিক
সাম্প্রতিক সময়ে দক্ষিণ এশিয়ায় একের পর এক গণঅভ্যুত্থান আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে যে রাষ্ট্রীয় শাসন কাঠামো দুর্বল হলে জনগণই চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা নিতে পারে। প্রথমে শ্রীলঙ্কা, পরে বাংলাদেশ এবং সবশেষে নেপাল—তিন দেশেই জনবিস্ফোরণ ঘটল। তিন ক্ষেত্রেই লক্ষ্য করা গেল ক্ষমতার কেন্দ্র, রাজনৈতিক নেতাদের সম্পত্তি ও বাসভবন জনগণের আক্রমণের মুখে পড়েছে। মূল অভিযোগ ঘুরপাক খাচ্ছে দুর্নীতি, দমন–পীড়ন এবং ক্ষমতার অপব্যবহারকে ঘিরে। শ্রীলঙ্কায় তরুণ প্রজন্ম আন্দোলনের মুখ হয়ে উঠেছিল, বাংলাদেশ ও নেপালে ছাত্র–যুবকরাই নেতৃত্ব দিয়েছে। এ অভিজ্ঞতাগুলো প্রমাণ করে যে যুবসমাজ যখন সামনে আসে, তখন আন্দোলন কেবল রাজনৈতিক স্লোগান নয়, বরং একটি অস্তিত্ববাদী প্রশ্নে রূপ নেয়—রাষ্ট্র কার জন্য?
নেপালের অভ্যুত্থান একটি বিশেষ শিক্ষা দেয়। সেখানে সংসদ গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ছিল এবং সরকার গণভোট ও নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে। তবু জনরোষে ভেসে যায়। আন্দোলনের কেন্দ্রে ছিল দুর্নীতি, এবং ক্ষোভের শিকার হয়েছে সরকার ও বিরোধী—উভয় শিবির। অর্থাৎ এটি শুধু regime change নয়, বরং পুরো রাজনৈতিক শ্রেণির প্রতি এক ধরণের অবিশ্বাস। রাজনৈতিক বিজ্ঞানে একে বলা হয় anti-establishment mobilization। এখানে আমরা Lipset-এর legitimacy theory প্রয়োগ করতে পারি। জনগণ যখন দুর্নীতি ও অদক্ষতার কারণে রাষ্ট্রের ওপর আস্থা হারায়, তখন সরকার গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হলেও তার বৈধতা নষ্ট হয়। বৈধতা হারানো সরকার কাগজে কলমে টিকে থাকে, কিন্তু রাজনৈতিক বাস্তবতায় মৃতপ্রায় হয়ে যায়।
বাংলাদেশে ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থান চূড়ান্ত সমাপ্তি নয়, বরং একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা। বিএনপি আশা করছে তারা নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করবে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ আপাতত রাজনীতির বাইরে থাকলেও সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। ইতিহাস বলে, সংগঠিত রাজনৈতিক দলগুলোকে দীর্ঘমেয়াদে রাজনীতি থেকে বাদ রাখা যায় না। Samuel Huntington-এর Political Order in Changing Societies এ প্রসঙ্গেই সতর্ক করেন—ফিরে আসার পথ রুদ্ধ করলে ভবিষ্যতে আবার সহিংস বিস্ফোরণ ঘটে। অতএব, আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ফেরাটা সময়ের ব্যাপার মাত্র। যদি গণতান্ত্রিক পথে তা সম্ভব না হয়, তবে সহিংসতার মাধ্যমে ফেরার চেষ্টা করবে—এমন সম্ভাবনাকে খাটো করে দেখা যাবে না।
বাংলাদেশের আরেক বাস্তবতা হলো ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক ব্লকের উত্থান। এখানে মওদুদপন্থী দল থেকে শুরু করে কট্টরপন্থী খিলাফতবাদী গোষ্ঠী পর্যন্ত সক্রিয়। তবে সবচেয়ে সংগঠিত শক্তি হলো জামায়াতে ইসলামি। সংগঠন, অর্থ, রাজনৈতিক ভিত্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতায় তারা অন্যদের চেয়ে এগিয়ে। এখনই হয়তো তাদের জাতীয় ক্ষমতা দখলের সামর্থ্য নেই, কিন্তু আগামী কয়েক বছরে শক্তি বহুগুণে বাড়তে পারে। তখন প্রশ্ন থাকবে—তারা গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে সম্মান করবে, নাকি Charles Tilly-এর contentious politics তত্ত্বের মতো বিপ্লবী পথে হাঁটবে? নেপাল–স্টাইলে বিপ্লবী পথে হেঁটেও তারা বিস্ময় তৈরি করবে না।
বর্তমানে বিএনপি–বিরোধীরা সফলভাবে জনগণের মনে প্রতিষ্ঠা করেছে যে বিএনপি একটি দুর্নীতিবাজ দল। এখানে কার্যকর হয়েছে labeling theory। যখন কোনো সংগঠনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির লেবেল একবার বসে যায়, তখন তা সত্য বা মিথ্যা যাই হোক না কেন, সামাজিক বাস্তবতায় প্রভাব বিস্তার করে। সরকারে গেলে এই ধারণা আরও তীব্র হতে পারে, কারণ বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামো দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে দুর্বল। এই প্রেক্ষাপটে আগামী সরকারকে দুটি অস্তিত্বমূলক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। প্রথমত, প্রতিবেশী দেশের সহায়তায় আওয়ামী লীগ আবার রাজনীতিতে ফিরতে চাইবে। এখানে power transition theory প্রযোজ্য—প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি দীর্ঘমেয়াদে পুনঃপ্রবেশের চেষ্টা করে এবং সেটি স্থিতিশীলতা নষ্ট করে। দ্বিতীয়ত, ক্রমবর্ধমান ইসলামপন্থী চাপ ইসলামি রাষ্ট্র প্রকল্পকে আরও শক্তিশালী করবে। এ প্রেক্ষাপটে social movement theory-এর radical flank effect ব্যাখ্যা করে কীভাবে মাঝারি ইসলামপন্থীরা ধীরে ধীরে চরমপন্থীদের দিকে ঝুঁকতে পারে।
এই দুই চাপে দুর্বল সরকারের পক্ষে টিকে থাকা কঠিন। নেপাল আমাদের শিক্ষা দেয় যে দুর্নীতি, বৈধতা সংকট এবং জনগণের আস্থা হারানো একটি গণতান্ত্রিক সরকারকেও ধ্বংস করে দিতে পারে। বাংলাদেশও এখন এক অস্বাভাবিক সময়ে দাঁড়িয়ে। বিএনপি যদি ভাবে সরকার গঠন করলেই সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে, তবে তা হবে ভয়ঙ্কর ভ্রান্তি। প্রশ্ন হলো—বিএনপি কি এই দ্বৈত চাপে (আওয়ামী লীগের প্রত্যাবর্তন ও ইসলামপন্থী উত্থান) টিকে থাকার মতো রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রস্তুতি নিচ্ছে? নাকি আমরা আবারও দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক চক্রে প্রবেশ করতে যাচ্ছি, যেখানে অস্থিরতা শেষে সামরিক শাসনই হয়ে ওঠে শেষ অবলম্বন? বাংলাদেশের গণতন্ত্র এখন এক সন্ধিক্ষণে। আর এখানেই মূল প্রশ্ন—আমরা কি নেপালের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেব?
তারেক জিয়ার কেন দেশে ফেরা কেন জরুরি?

আসিফ বিন আলী
শিক্ষক ও স্বাধীন সাংবাদিক
বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে একধরনের আত্মতুষ্টিতে ছিল যে তারা সহজেই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে। এই আত্মতুষ্টি তাদের রাজনৈতিক কৌশলকে দুর্বল করেছে। রাজনীতি বিজ্ঞানে একে বলা হয় “Overconfidence Trap”—যেখানে দল মনে করে জনসমর্থন এতটাই শক্ত যে সাংগঠনিক দুর্বলতা তাদের ক্ষতি করবে না। বাস্তবে দেখা গেল, তৃণমূলের অনেক নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠল, আর এই অভিযোগকে কেন্দ্র করে বিএনপি ৪ হাজারেরও বেশি নেতাকে পদ থেকে সরিয়ে দেয়। যদিও এটিকে “accountability politics”-এর উদাহরণ বলা যায়, তবে একই সঙ্গে এটি দলের ভেতরের অস্থিরতা ও সাংগঠনিক দুর্বলতাকেও সামনে এনেছে। অন্যদিকে মাঠে যেহেতু “মাইনাস বিএনপি” প্রোজেক্ট চলমান, সেই প্রেক্ষিতে বিএনপি-বিরোধী শিবির বিএনপির বিরুদ্ধে প্রচারণা বেশ ভালোভাবেই এগিয়ে নিতে থাকে। মানুষের মনে এক ধরনের ধারণা তৈরি করে যে বিএনপির নেতারা দুর্নীতিবাজ, চোর এবং অসৎ।
ডাকসু নির্বাচনের পর বিএনপির হয়তো বোধোদয় হয়েছে যে জামাতকে তারা যতটা দুর্বল ভেবেছিল, তারা ততটা দুর্বল নয়। জামাত সাংগঠনিকভাবে গুছানো, পরিকল্পনামূলক এবং দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে। অন্যদিকে ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদল-সমর্থিত প্যানেল যদিও পরাজিত হয়েছে, মাত্র চার সপ্তাহের প্রস্তুতি নিয়েও তারা অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। শিবির যেমন তাদের নিজস্ব সাংগঠনিক সক্ষমতা ও জামাতের সহায়তা কাজে লাগিয়েছে এবং ২০২৪ সালের ডিসেম্বর থেকেই ডাকসু নিয়ে প্রস্তুতি শুরু করেছে। Michels-এর Iron Law of Oligarchy এর সাথে যারা পরিচিত তাড়া জানেন যে সংগঠন টিকে থাকতে হলে নেতৃত্ব ও কাঠামোগত শৃঙ্খলা জরুরি। জামাত সেই শৃঙ্খলা ধরে রেখেছে। অন্যদিকে ছাত্রদল এক ধরনের সমন্বয়হীনতার মুখোমুখি হয়েছিল এবং মাত্র চার সপ্তাহের প্রস্তুতি নিতে পেরেছিল। ছাত্রদলের নির্বাচনী সাফল্যের পেছনে দলের কোনো বিশেষ অবদান নয়, বরং ছাত্রদলের কর্মীদের ব্যক্তিগত পরিশ্রমই বড় কারণ ছিল। কিন্তু আমরা ভালো করেই জানি, নির্বাচনের মতো ঘটনায় শুধু ব্যক্তিগত বা গ্রুপভিত্তিক পরিশ্রম যথেষ্ট নয়, এখানে দরকার পড়ে সাংগঠনিক সক্ষমতা।
ডাকসুর এই পরাজয়ে বিএনপির মধ্যে একটি উপলব্ধি তৈরি হয়েছে বলে মনে হয়—নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতিতে তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ জামাত। আর এই প্রতিপক্ষের সাংগঠনিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা মোকাবেলা করার মতো প্রস্তুতি বিএনপি নিতে পারেনি। কেন পারেনি? এর অন্যতম কারণ হলো, বিএনপি মূলত একটি জনভিত্তিক দল, সংগঠনভিত্তিক দল নয়। এখানেই আসল টুইস্ট। জামাত যেমন নিজেদের সংগঠনকে শক্তিশালী করেছে, পাশাপাশি বিএনপির জনভিত্তিকে দুর্বল করতে গুছানো রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়েছে। বিএনপি বিরোধী ব্লক মানুষের মনে বিএনপিকে দুর্নীতিবাজ, চোর বা টেম্পু-স্ট্যান্ড পার্টি হিসেবে উপস্থাপন করতে তুলনামূলকভাবে সফল হয়েছে।
তাহলে বাকি থাকে সংগঠন। আপাতদৃষ্টিতে বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা নাজুক। আওয়ামী লীগ আমলে বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতাকে অনেকে সহানুভূতির চোখে দেখত—ভাবত, আওয়ামী লীগের দমন-নিপীড়নের কারণে বিএনপি দাঁড়াতে পারছে না। কিন্তু ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর আর এই সহানুভূতির সুযোগ নেই। এখন বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতা মানুষ নিপীড়নের ফল হিসেবে নয়, বরং organizational incompetence হিসেবে দেখছে। এটি একধরনের legitimacy crisis—যেখানে মানুষ দলকে অযোগ্য হিসেবে দেখা শুরু করে। আর যদি এই ধারণা স্থায়ী হয়ে যায়, তবে মানুষ বিএনপিকে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় ফেরার উপযুক্ত দল হিসেবে বিবেচনা করবে না। এই অনাস্থা ভবিষ্যতের নির্বাচনে বিএনপির জন্য ভয়াবহ বিপদের কারণ হতে পারে। ডাকসু নির্বাচন দেখিয়েছে যে শুধু আবেগ নয়, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার। Samuel Huntington-এর মতে, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান টিকে থাকতে হলে institutionalization of politics প্রয়োজন। বিএনপি তার রাজনীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারছে না।
বিএনপির এই সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটানোর জন্য দলের প্রধান নেতাকে মাঠে নেমে আসতে হবে, কর্মীদের মাঝে অবস্থান নিতে হবে। নিঃসন্দেহে তিনি প্রবাসে থেকে দীর্ঘ ১৫ বছর দলকে একত্রিত করার যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছেন। তখন তাঁর পক্ষে মানুষের সহানুভূতি ছিল। কিন্তু এখন আর সেই সহানুভূতি আগের মতো নেই। ডাকসু নির্বাচন বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর চরম মানসিক চাপ তৈরি করেছে।
ডাকসু নিয়ে সিনিয়র নেতৃবৃন্দের নীরবতা কি কোনো বিশেষ বার্তা বহন করছে? এই নীরবতার কারণ কী? দলের ভেতরে কি কোনো অভিমান তৈরি হচ্ছে যা অবশিষ্ট সংগঠনকেও অকার্যকর করে দিচ্ছে? অথবা দলের ভেতরে কি কোনো সিন্ডিকেট তৈরি হচ্ছে যারা রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে? এই প্রশ্নগুলো এখন মানুষকে ভাবাচ্ছে। আর এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য মানুষ যখন নেতৃত্বের উপস্থিতি দেখতে চাইবে, তখন তা কেবল ফেসবুক পোস্ট বা ভিডিও বক্তৃতার মাধ্যমে সম্ভব নয়। এর জন্য দরকার শারীরিক উপস্থিতি—মাঠে যাওয়া, শহরের গলিতে গলিতে যাওয়া, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যাওয়া, কৃষকের সাথে হাত মেলানো, মসজিদে নামাজ পড়া, পূজার মণ্ডপে গিয়ে শুভেচ্ছা জানানো। এক কথায় একে বলে “proximity effect”। এর ফলে জনগণের সাথে সরাসরি যোগাযোগ রাজনৈতিক বৈধতা বাড়ায়। কৃষকের সাথে হাত মেলানো, ক্যাম্পাসে যাওয়া, পূজার মণ্ডপে যাওয়া—এসব কেবল প্রতীকী কাজ নয়, বরং রাজনৈতিক বৈধতা পুনর্গঠনের হাতিয়ার।
বিএনপি যেহেতু এক নেতা-ভিত্তিক দল, সেই নেতার দেশে ফেরা দেরি হলে তা আসলে বিএনপির রাজনৈতিক দুর্বলতাকেই স্পষ্ট করে। তারেক জিয়া হলেন বিএনপির “charismatic authority” (Max Weber)। যদি দীর্ঘদিন তিনি মাঠে অনুপস্থিত থাকেন, তবে দলের ভেতরে গেটকিপার তৈরি করে যারা মূলত সংগঠন ভেতরে বিভক্ত করে ফেলে। এই বিভক্তি শেষ পর্যন্ত charismatic authority কে চ্যালেঞ্জ এর মুখে ফেলে। বাস্তবতা হল, বিএনপি ভুল করবে যদি তারা ভাবে—সিভিল সোসাইটি, ক্ষমতার কেন্দ্রগুলো বা সাধারণ মানুষ অবিরামভাবে শুধু জামাতের রাজনীতির বিরুদ্ধে তাদের সমর্থন দিয়ে যাবে। বিএনপি একমাত্র বিকল্প নয় ক্ষমতার রাজনীতিতে।
এই সত্য উপলব্ধি করেই তারেক জিয়ার দেশে আসা, দেশের মাটিতে সেজদা করা এখন বিএনপির জন্য সবচেয়ে জরুরি কাজ। প্রশ্ন হলো, বিএনপি কি এই পথে হাঁটবে?
উন্নয়ন, নিরাপত্তা ও ভূরাজনীতি: জাপান–বাংলাদেশ সম্পর্কের ভবিষ্যৎ সমীকরণ

মো. অহিদুজ্জামান
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও গবেষক
ঢাকার ব্যস্ত সড়কে মেট্রোরেল ছুটে যায় দ্রুতগতিতে। হাজারো মানুষের কর্মজীবন বদলে দিচ্ছে প্রতিদিন। অনেকে হয়তো জানেন না, এই আধুনিক ব্যবস্থার পেছনে সবচেয়ে বড় সহায়তা এসেছে দূরপ্রাচ্যের দেশ জাপান থেকে। আবার কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে যে গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে উঠছে, সেটিও জাপানের বিনিয়োগ ও কারিগরি সহায়তার ফসল। বলা চলে, বাংলাদেশের প্রতিটি উন্নয়ন অধ্যায়ের পেছনে একবার তাকালে দেখা যাবে—জাপানের নিঃশব্দ অথচ দৃঢ় উপস্থিতি।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে যখন বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য অপেক্ষা করছিল, তখন জাপান দ্রুত এগিয়ে আসে। মাত্র এক বছরের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক টোকিও সফর দুই দেশের বন্ধুত্বকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠনে সেতু, রাস্তা, বিদ্যুৎকেন্দ্র, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য—প্রতিটি খাতেই জাপানের সহায়তা বাংলাদেশের জন্য ছিল জীবনদায়ী। আস্থা, সহানুভূতি ও উন্নয়ন সহযোগিতার এই ভিত্তি আজও দুই দেশের সম্পর্কে এক অটুট বন্ধনের প্রতীক।
অতীতের সেই আস্থার উপর দাঁড়িয়ে সম্পর্কের চরিত্র আজ বদলে গেছে। বাংলাদেশ আর শুধু সহায়তার গ্রহীতা নয়; এখন এটি জাপানের কৌশলগত অংশীদার। বিশেষ করে ২০২৪ সালের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্বে পররাষ্ট্রনীতিতে নতুন দিশা এসেছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস “৩৬০ ডিগ্রি কূটনীতি”র যে ধারণা দিয়েছেন, তাতে বহুমুখী সম্পর্ককে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। তার কূটনৈতিক অগ্রাধিকারের তালিকায় জাপান শীর্ষে উঠে এসেছে—কারণ জাপান শুধু উন্নয়ন সহযোগী নয়, ভবিষ্যতের বৈশ্বিক ভূরাজনীতিতে বাংলাদেশের জন্য এক নির্ভরযোগ্য মিত্র।
২০২৫ সালের মে মাসে ড. ইউনূসের টোকিও সফর এই সম্পর্কের নতুন অধ্যায় রচনা করে। প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবার সঙ্গে বৈঠকে জাপান শুধু বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তরকে স্বাগত জানায়নি, বরং ১.০৬৩ বিলিয়ন ডলারের ঋণ ও অনুদান সহায়তা ঘোষণা করেছে। নতুন রেলপথ, জলবায়ু সহনশীলতা এবং শিক্ষাবৃত্তির জন্য এই অর্থ ব্যয় হবে। একই সঙ্গে সাতটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে—যার মধ্যে বিনিয়োগবান্ধব One Stop Service, ডিজিটাল নিরাপত্তা, জাপানি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে নতুন কারখানা স্থাপন এবং দক্ষ কর্মী উন্নয়ন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
সবচেয়ে বড় আলোচনার বিষয় ছিল একটি Economic Partnership Agreement (EPA)। ২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তীর্ণ হবে, তখন শুল্ক সুবিধা হারানোর ঝুঁকি তৈরি হবে। EPA হলে সেই সুবিধা বজায় থাকবে, রপ্তানি বৈচিত্র্য ঘটবে এবং বাংলাদেশ জাপানি বাজারে প্রতিযোগিতা ধরে রাখতে পারবে। বিশ্লেষকদের মতে, এটি বাংলাদেশের জন্য এক ঐতিহাসিক সুযোগ, যাকে কাজে লাগাতে পারলে দেশের অর্থনীতিতে বড় পরিবর্তন ঘটবে।
তবে জাপান–বাংলাদেশ সম্পর্ক এখন শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা বিস্তৃত হচ্ছে নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক কৌশলগত সহযোগিতায়। জাপান প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের নৌবাহিনীকে টহল নৌযান সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি হস্তান্তরের বিষয়ে নীতিগত ঐকমত্যও হয়েছে। এটি ইঙ্গিত দেয় যে জাপান বাংলাদেশকে শুধু উন্নয়ন সহযোগী নয়, বরং আঞ্চলিক নিরাপত্তা অংশীদার হিসেবেও দেখতে শুরু করেছে।
মানবসম্পদ উন্নয়ন এই অংশীদারিত্বের আরেকটি বড় দিক। আগামী পাঁচ বছরে অন্তত এক লক্ষ দক্ষ বাংলাদেশি কর্মী জাপানে যাবে—নার্সিং, কেয়ারগিভিং, আইটি, মেকাট্রনিক্সসহ বিভিন্ন খাতে। এতে একদিকে বাংলাদেশের তরুণরা কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবে, অন্যদিকে রেমিট্যান্স ও জ্ঞান-প্রবাহ উভয় দেশকেই সমৃদ্ধ করবে। এছাড়া উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় জাপানি বৃত্তি এবং যৌথ কর্মসূচি বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের জন্য নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে।
তবে সামনে কিছু চ্যালেঞ্জও আছে। বাংলাদেশের প্রশাসনিক জটিলতা ও দুর্নীতি বিনিয়োগকারীদের জন্য বড় বাধা। প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব ও ব্যয়বৃদ্ধি জাপানি আস্থাকে ক্ষুণ্ণ করতে পারে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং নীতির ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করা না গেলে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। অন্যদিকে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার কারণে বাংলাদেশকে সতর্কভাবে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। চীন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের টানাপোড়েনের মাঝে জাপানের সাথে সম্পর্ক গভীর করতে গেলে দক্ষ কূটনীতির প্রয়োজন হবে।
অন্যদিকে, সুযোগও সীমাহীন। মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, মেট্রোরেল, তৃতীয় টার্মিনাল—এসব মেগা প্রকল্প বাংলাদেশকে আঞ্চলিক লজিস্টিক্স হাবে পরিণত করবে। EPA কার্যকর হলে রপ্তানি বাজার বহুমুখী হবে। জাপানের সবুজ প্রযুক্তি ও জলবায়ু সহায়তা বাংলাদেশের জন্য টেকসই উন্নয়নের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। আর মানবসম্পদ উন্নয়ন ও দক্ষ কর্মী প্রেরণ দীর্ঘমেয়াদে দেশের অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করবে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, জাপান–বাংলাদেশ সম্পর্ক আজ একটি উইন–উইন অংশীদারিত্ব। অতীতের আস্থার ভিত্তি, বর্তমানের কৌশলগত সাযুজ্য এবং ভবিষ্যতের অসীম সম্ভাবনা—সবকিছু মিলিয়ে এ সম্পর্ক শুধু দুই দেশের জনগণের জন্য নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের জন্য এটি কেবল অর্থনৈতিক উন্নয়ন নয়, বরং একটি মর্যাদাপূর্ণ ভবিষ্যতের পথ। আর জাপানের জন্য বাংলাদেশ আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও প্রবৃদ্ধির এক নির্ভরযোগ্য মিত্র।
পাঠকের মতামত:
- টানাপোড়েনের মধ্যেও সুখবর নভেম্বরের শুরুতে রেমিট্যান্সে বড় উল্লম্ফন
- ভারত বধের ছক চূড়ান্ত সেরা ১৭ জনকে পরখ করবেন কাবরেরা
- ইউনেস্কোর সভাপতি নির্বাচিত হওয়া আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে বাংলাদেশের বড় অর্জন: শিক্ষা উপদেষ্টা
- আইনস্টাইনও কি ভুল ব্ল্যাক হোলের ছায়া নিয়ে নতুন তত্ত্বে চাঞ্চল্য
- বিপ্লবী জনতার ধোলাই খেলে নেতা দেখতে আসবে না নূর আওয়ামী লীগ কর্মীদের সতর্ক করলেন
- শীতে অতিরিক্ত শীত লাগে কোন ভিটামিন কম থাকলে এই সমস্যা বাড়ে জানেন কি
- বিএনপি গণতন্ত্রের চ্যাম্পিয়ন ৭ নভেম্বরের চেতনায় ৫ আগস্ট অর্জিত: রিজভী
- বগুড়া-২ আসনে ধানের শীষ নিয়ে জল্পনা জোটের মাহমুদুর রহমান মান্না বনাম নতুন মুখ স্নিগ্ধ
- রাজধানীতে ফের বাসে আগুন মালঞ্চ পরিবহনের বাস পুড়ল সূত্রাপুরে
- রাজধানীতে ফের বাসে আগুন মালঞ্চ পরিবহনের বাস পুড়ল সূত্রাপুরে
- সংবিধান কোনো ম্যাজিক নয় সব সংস্কার এখনই করা সম্ভব না আসিফ নজরুল
- থাইরয়েড নিয়ন্ত্রণে ৫টি ঘরোয়া পানীয় ক্লান্তি দূর করে ওজন রাখবে স্বাভাবিক
- গণভোট নিয়ে টালবাহানা যারা করছেন তারা পালাবেন কোথায়: চরমোনাই পীর
- ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিপক্ষে জোট এনসিপি : হাসনাত আব্দুল্লাহ
- ইসলামাবাদে ভয়াবহ আত্মঘাতী হামলা অভিযোগ ভারতের বিরুদ্ধে
- ক্ষমতায় গেলে আওয়ামী লীগের সব মামলা তুলে নেব মির্জা ফখরুল
- শীতের বাতের ব্যথা কমাতে ৫ খাবার রাখুন পাতে
- আগে গণভোট চাই জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি ছাড়া নির্বাচন অসম্ভব জামায়াত আমির
- শীতকালে কেন স্ট্রবেরি খাবেন জানেন কি ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়াতে এটি জরুরি
- নির্বাচন সামনে বিশেষ ক্ষমতা পেলেন সামরিক কর্মকর্তারা
- মুশফিক-তামিমদের ক্লাবে ঢোকার অপেক্ষায় লিটন দাস আজই কি গড়বেন রেকর্ড
- হাসিনার সাক্ষাৎকারগুলো ‘সাজিয়ে রাখা’, আরো নতুন পর্ব আসবে
- ১১ নভেম্বর ডিএসই লেনদেনের সারসংক্ষেপ
- ১১ নভেম্বর ডিএসই লেনদেনে শীর্ষ গেইনার তালিকা প্রকাশ
- ১১ নভেম্বর ডিএসই লেনদেনে শীর্ষ গেইনার তালিকা প্রকাশ
- ঢাকা কাঁপল ১১ বিস্ফোরণে গ্রামীণ ব্যাংক এবং এনসিপি কার্যালয়েও হামলা
- জুলাই সনদের বাইরে কোনো সিদ্ধান্ত মানা হবে না দায় বর্তাবে সরকারের ওপর হুঁশিয়ারি বিএনপির
- আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসী কার্যক্রম করছে তারা নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করছে: প্রেস সচিব
- ভয় পাচ্ছে জামায়াত ভোট হলে অস্তিত্ব থাকবে না সাফ জানালেন ফখরুল
- দুই দিন ৯ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকবে না যেসব এলাকায়
- ধর্মেন্দ্রর মৃত্যু নিয়ে এশা দেওলের স্পষ্ট বার্তা
- "জিয়াউর রহমানের আদর্শে বিশ্বাসীরা চাঁদাবাজ হতে পারে না"
- স্টার্লিং-ক্যাডের জুটিতে দাপট আয়ারল্যান্ডের
- জুট স্পিনার্সের প্রথম প্রান্তিক আর্থিক প্রতিবেদন
- জিবিবি পাওয়ারের Q1 ফলাফল প্রকাশ
- বাজুসের নতুন ঘোষণা: ইতিহাসে সর্বোচ্চ দামে পৌঁছালো স্বর্ণ
- ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্সের লভ্যাংশ বিতরণ সম্পন্ন
- দিনের শুরুতেই পুঁজিবাজারে প্রাণচাঞ্চল্য, বেড়েছে তিন সূচকই
- চীন–যুক্তরাষ্ট্র প্রতিযোগিতার ভেতরে লুকানো নতুন ভারসাম্য
- খালি পেটে খেজুর খাওয়ার ৭টি অসাধারণ উপকারিতা
- দুই পারমাণবিক কেন্দ্রে রুশ ড্রোন হামলা
- আজ বিশ্ব ব্যাচেলর দিবস: একাকীত্ব নয়, স্বাধীনতার উৎসব
- আজ রাজধানীতে রাজনৈতিক যেসব কর্মসূচি, কোথায় কী হচ্ছে জেনে নিন
- যুদ্ধবিরতির এক মাস পরও গাজায় ত্রাণে ইসরাইলের বাধা
- বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতের সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি
- আওয়ামী লীগারদের উদ্দেশ্যে নুরের বিস্ফোরক ফেসবুক স্ট্যাটাসে তোলপাড়
- রাজধানীর তিন এলাকায় আরও বাসে আগুন এক দিনে ছয় বাসে অগ্নিসংযোগ
- জুলাই সনদ জট রাজনৈতিক দলগুলো অটল অবস্থানে অনিশ্চয়তা কাটাতে সরকারের শেষ চেষ্টা
- ট্রাম্পের ঘোষণার পরই সরে দাঁড়াল স্থিতিশীলতা বাহিনী গাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন
- দিল্লিতে শক্তিশালী বিস্ফোরণ আতঙ্ক লালকেল্লা এলাকায় উচ্চ সতর্কতা জারি
- গবেষণা ভিত্তিক শিক্ষা: বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য এক নতুন দিগন্ত
- ন্যায়ভিত্তিক ও মানবিক সমাজ গড়তে হলে রাষ্ট্রকে অবশ্যই তার সামাজিক ও নৈতিক দায়বদ্ধতা পুনরুদ্ধার করতে হবে
- দেউলিয়া পাঁচটি ইসলামি ব্যাংক একীভূত
- রপ্তানি আয়ে বড় ধস; যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কে চাপে পোশাক শিল্প
- কোরিয়ান ড্রামায় মুগ্ধ বিশ্ব: মিস্ট্রি থ্রিলার থেকে টাইম ট্রাভেল, দেখুন সেরা ১০ সিরিজ!
- বুক ধড়ফড়ের নেপথ্যে পানিশূন্যতা: হৃদস্পন্দন দ্রুত হলে যা করবেন, জানালেন বিশেষজ্ঞরা
- ঘরে বসেই বানান ডিজিটাল NID: সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া জানুন ধাপে ধাপে
- কালো মুরগি কেন এত দামি: জেনেটিক বিস্ময়, ঐতিহ্য ও বিলাসিতার এক অনন্য সংমিশ্রণ
- ০৫ নভেম্বর ডিএসই লেনদেনে শীর্ষ লুজার তালিকা প্রকাশ
- পপুলার ওয়ান মিউচুয়াল ফান্ডের দ্বিতীয় প্রান্তিক প্রকাশ
- গোলের রাজা কে, মেসি না রোনালদো? সংখ্যার হিসাবে কে এগিয়ে, কে পিছিয়ে!
- চেঙ্গিস খানের অজানা গল্প: এক গরীব বালক যেভাবে পৃথিবীর ৪০% মানুষের যমদূত হয়ে উঠেছিল!
- কারা পাবেন বিনা হিসাবে জান্নাত? হাদিসের আলোকে জানুন সৌভাগ্যবানদের বিশেষ গুণাবলী
- জয়–হাসিনা সাক্ষাৎ: দিল্লির নীলনকশার প্রথম ধাপ?
- যুদ্ধ ও মহানুভবতা: সুলতান সালাউদ্দিন যেভাবে জেরুজালেম জয় ও শত্রুর মন জিতেছিলেন






