ইসলাম, জীবন ও বিজ্ঞান

নামাজে রুকু ও সিজদাহ: ধর্মীয় গুরুত্ব ও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা

ধর্ম ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুন ২৪ ০০:১৯:২২
নামাজে রুকু ও সিজদাহ: ধর্মীয় গুরুত্ব ও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা

নামাজ কেবল ধর্মীয় কর্তব্যই নয়, এটি একজন মুসলমানের জীবনে শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক সুস্থতার একটি পরিপূর্ণ পদ্ধতি। নামাজের দুইটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ—রুকু (নত হয়ে ঝুঁকে দাঁড়ানো) ও সিজদাহ (ভূমিতে ললাট ও নাক স্পর্শ করে সেজদা)—শুধু ইবাদতের অংশ নয়, আধুনিক বিজ্ঞানের আলোয় এগুলোর রয়েছে বিস্ময়কর স্বাস্থ্যগত ও মনস্তাত্ত্বিক উপকারিতা।

ইসলামী দৃষ্টিতে রুকু ও সিজদাহর তাৎপর্য

আল-কুরআনের বহু আয়াতে এবং সহীহ হাদীসসমূহে রুকু ও সিজদাহর ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, "হে মুমিনগণ! তোমরা রুকু করো, সিজদাহ করো এবং তোমার রবের ইবাদত করো" (সূরা হজ: ৭৭)। প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, "সেজদার সময়ই বান্দা তার প্রভুর সর্বাধিক নিকটবর্তী হয়" (সহীহ মুসলিম)। ইসলামি চিন্তাবিদদের মতে, রুকু একজন মুমিনের আত্মবিনয় এবং সিজদাহ আত্মসমর্পণের সর্বোচ্চ প্রকাশ।

ইমাম গাজ্জালী, ইবনে কাইয়্যিম প্রমুখ মনীষীদের মতে, সিজদাহ মানুষের অহংকার ভেঙে তাকে পরিপূর্ণ বিনয়ের শিক্ষায় দীক্ষিত করে। রুকু হল সেই মধ্যবর্তী অবস্থা যেখানে মানুষ নিজেকে নিচু করে বিনম্রভাবে আল্লাহর সামনে দাঁড়ায়, এবং সিজদাহ হল সেই পরম বিনয়ের অবস্থা, যেখানে সে নিজের ললাট ও নাক আল্লাহর সামনে মাটিতে ঠেকিয়ে দেয়। প্রাচীনকাল থেকেই ইসলামি স্কলাররা রুকু ও সিজদাহর গুরুত্ব সম্পর্কে বলতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন যে, এই অবস্থানগুলো একজন মুমিনের অন্তরে বিনয় ও খোদার প্রতি সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণের চেতনাকে জাগ্রত করে।

শারীরিক উপকারিতা: চিকিৎসা বিজ্ঞানের আলোকে

১. পেশী ও অস্থিসন্ধির নমনীয়তা ও শক্তিশালীকরণ

রুকু ও সিজদাহ এমন দুটি ভঙ্গি যা মানুষের প্রায় সবধরনের প্রধান পেশী—ঘাড়, পিঠ, হিপ, হাঁটু ও গোড়ালির পেশীকে সক্রিয় রাখে। নিয়মিত রুকু করলে পিঠ ও মেরুদণ্ডের সোজাভাব বজায় থাকে, সিজদাহ হাঁটু ও গোড়ালির নমনীয়তা বৃদ্ধি করে এবং দেহে একধরনের স্বাভাবিক স্ট্রেচিং হয়। বিশেষ করে সিজদার সময় পেটের নিম্নাংশের পেশীগুলো সক্রিয়ভাবে সংকুচিত-প্রসারিত হয়, যা পেটের মেদ কমাতে ও কেন্দ্রীয় শরীরকে শক্তিশালী করতে সহায়তা করে। চিকিৎসাবিজ্ঞান বলছে, এই ধরণের ন্যূনতম ব্যায়াম প্রতিদিন ১৭ রাকাতের মাধ্যমে ৩৪ বার করলে তা হাড়, সন্ধি ও পেশীকে সক্রিয় ও স্বাস্থ্যবান রাখে।

২. রক্ত সঞ্চালন ও হরমোনাল ভারসাম্য

সিজদার সময় মস্তিষ্ক হৃদপিণ্ডের নিচে চলে আসে, ফলে স্বাভাবিকভাবেই মস্তিষ্কে রক্ত প্রবাহ বাড়ে। এটি অক্সিজেন সরবরাহের মাত্রা বৃদ্ধি করে এবং নিউরোট্রান্সমিটারের কার্যকারিতা বাড়ায়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই ধরনের মাথা নিচু অবস্থান cerebral blood flow বাড়ায়, যা স্মৃতি, মনোযোগ ও বিশ্লেষণক্ষমতা উন্নত করতে কার্যকর। শুধু তাই নয়, সিজদার সময় বাড়তি রক্তপ্রবাহ চোখ ও কানসহ অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের কার্যক্রমেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে বলে ধারণা করা হয়।

৩. স্নায়ুতন্ত্রে প্রশান্তি ও হৃদপিণ্ডে ভারসাম্য

সিজদা করার সময় শরীর parasympathetic nervous system সক্রিয় করে—যেটি শান্তি, বিশ্রাম ও পুনরুদ্ধারের জন্য দায়ী। নামাজের এই অংশে হার্ট রেট ও রক্তচাপ কমে আসে, স্নায়ুব্যবস্থায় স্বস্তি ফিরে আসে। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব ব্যক্তিরা নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন, তাদের স্ট্রেস হরমোন কর্টিসল-এর মাত্রা তুলনামূলকভাবে কম থাকে।

৪. হজমতন্ত্র ও অন্ত্রের কার্যক্রম

সিজদার সময় পেটের উপর সামান্য চাপ পড়ে, যার ফলে হজমতন্ত্রে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক থাকে এবং অন্ত্রের গতি নিয়মিত হয়। চিকিৎসাবিজ্ঞান বলছে, পেটের এই হালকা সংকোচন কোষ্ঠকাঠিন্য, অম্বল ও বদহজমের মতো সমস্যা দূর করতে সহায়তা করতে পারে।

মানসিক ও স্নায়ুবৈজ্ঞানিক প্রভাব

১. মনোযোগ ও একাগ্রতা বৃদ্ধি

সালাত পড়ার সময় কুরআন তিলাওয়াত, প্রার্থনা ও ধারাবাহিক দেহভঙ্গিমা মস্তিষ্ককে প্রশিক্ষিত করে মনোযোগ ধরে রাখার জন্য। বিশেষ করে সিজদাহ ও বৈঠকের সময় মনোযোগ সম্পূর্ণরূপে কেন্দ্রীভূত হয়, যা কার্যত mindfulness মেডিটেশনের মত কাজ করে।

২. উদ্বেগ ও মানসিক চাপ হ্রাস

নামাজ আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণের মাধ্যম। সিজদায় একজন মানুষ তার লজ্জা, দুঃখ, কৃতজ্ঞতা ও প্রার্থনা প্রকাশ করে—যা একটি মানসিক ভারমুক্তির অভিজ্ঞতা তৈরি করে। অনেক গবেষণা বলছে, নিয়মিত নামাজ মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে কার্যকর এবং এটি উদ্বেগ, বিষণ্নতা ও অতিরিক্ত চিন্তা দূর করতে সহায়তা করে।

৩. আত্মনিয়ন্ত্রণ ও মানসিক শৃঙ্খলা

পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের নির্দিষ্ট সময়ে রুকু ও সিজদার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি তার দৈনন্দিন জীবনকে একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ কাঠামোয় আনেন। এতে করে তার আচরণ, আবেগ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ভারসাম্য তৈরি হয়।

আধুনিক গবেষণায় রুকু-সিজদাহ

ইউনিভার্সিটি অব মালয়েশিয়া, কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়, এবং ইরানের ইসলামি মেডিকেল ইউনিভার্সিটির গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে সালাত একটি পূর্ণাঙ্গ বডি-মাইন্ড ব্যালেন্সিং পদ্ধতি। এতে হৃদপিণ্ড, স্নায়ু, পেশী, হরমোন ও মস্তিষ্ক একসঙ্গে সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং শরীর-মনকে একটি প্রশান্ত ও ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে যায়।

যোগব্যায়াম ও মেডিটেশনের সঙ্গে তুলনা

সিজদাহ যোগব্যায়ামের “বালাসন” বা “চাইল্ড পোজ”-এর মতো। রুকু অনেকটা “আর্ধ উত্তানাসন”-এর মতো। কিন্তু পার্থক্য হল, নামাজে এই ভঙ্গিমাগুলো আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণ ও আধ্যাত্মিক মনোযোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত, যেখানে যোগ বা মেডিটেশনে সাধারণত আত্মনির্ভরতার চর্চা হয়। এই অবস্থানগুলি মস্তিষ্কের সম্মুখপ্রান্ত (প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স) উদ্দীপিত করে এবং শরীর-মনের উপর এক ধরনের গ্রাউন্ডিং বা শান্ত প্রভাব ফেলে। ফলস্বরূপ শরীর থেকে মানসিক টক্সিন বা চাপ দূর হতে সাহায্য করে এবং অস্থিসন্ধির নমনীয়তা বৃদ্ধি, পেশীর দৃঢ়তা অর্জন, উচ্চ রক্তচাপ হ্রাসের পাশাপাশি স্ট্রেস-উদ্বেগ- মাথা ঘোরা ও ক্লান্তি কমাতেও অবদান রাখে। অর্থাৎ সালাতের শারীরিক ব্যায়ামপ্রধান দিকটি যোগব্যায়ামের মতোই দেহকে নমনীয়, দৃঢ় ও সুস্থ রাখতে পারে। মানসিক স্বাস্থ্যের দিক থেকেও নামাজ ও মেডিটেশনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মিল রয়েছে। নামাজে খুশু (পূর্ণ মনোযোগ ও বিনয় সহকারে প্রার্থনা) ধারণাটি mindfulness ধ্যানের অনুরূপ, যেখানে মন একাগ্র হয়ে যায় এবং বাহ্যিক চিন্তা দূরে সরে যায়। নামাজ পড়ার সময় কুরআন তিলাওয়াত ও নিরবচ্ছিন্ন ধ্যানে মগ্ন হওয়া মূলত একজন মুসল্লিকে ধ্যানস্থ অবস্থার মতোই নির্দেশনা ও প্রশান্তি দেয়।

গবেষণায় দেখা গেছে যে, নামাজ আদায়ের সময় মস্তিষ্কে আলফা তরঙ্গের মাত্রা বৃদ্ধি পায় যা সচরাচর গভীর প্রশান্তি ও ধ্যানের সাথে সংশ্লিষ্ট (প্যারাসিম্পেথেটিক সক্রিয়তার ইঙ্গিত)। আসলে, যোগাসন ও মেডিটেশনের যেসব সুফল হাজার বছর ধরে পরিচিত – যেমন শারীরিক ফিটনেস, মানসিক প্রশান্তি ও আত্মিক উন্নতি – সেগুলোর অনেকটাই নামাজের মাধ্যমে দৈনন্দিন জীবনে সংযোজিত হয়ে যায়। একজন গবেষক তাই প্রস্তাব করেছেন, মুসলিম রোগীদের চিকিৎসায় মানসিক-শারীরিক থেরাপি হিসেবে সালাত ও যোগব্যায়ামের সমন্বয় একটি নবতর দৃষ্টিকোণ হতে পারে। তবে মুসলমানদের জন্য অতিরিক্ত কোন কৌশলের প্রয়োজন নেই – সঠিক নিয়মে নামাজ আদায়ই তাদের জন্য অন্তর্নিহিত ধ্যান ও যোগব্যায়ামের সুবিধা এনে দিতে সক্ষম। একই সঙ্গে শুদ্ধ সালাতে “স্ট্রেস হরমোন” বা উত্তেজক স্নায়ুবিক সক্রিয়তা হ্রাস পায় এবং হৃদযন্ত্রের ধকল কমে – ঠিক যেমনটি সুচিন্তিত মেডিটেশনের মাধ্যমে ঘটে থাকে। ফলে রুকু ও সিজদাহ শুধুই শরীর চর্চা নয়—এটি আত্মার প্রশান্তি ও আত্মিক শুদ্ধির পন্থা।

রুকু ও সিজদাহ নামাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ—যেখানে একদিকে লুকিয়ে আছে আত্মিক পরিশুদ্ধির উৎস, অন্যদিকে রয়েছে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের অনন্য উপকারিতা। ইসলামের প্রতিটি নির্দেশনার মধ্যে যে বিজ্ঞান লুকিয়ে রয়েছে, রুকু ও সিজদাহ তার জ্বলন্ত উদাহরণ। আধুনিক গবেষণা এই প্রাচীন ইবাদতের মধ্যে লুকিয়ে থাকা বিস্ময়কর স্বাস্থ্যসুবিধাকে বৈজ্ঞানিকভাবে ব্যাখ্যা করছে। তাই রুকু ও সিজদাহ কেবল ইবাদত নয়—এটি মানুষের জীবনে আত্মশুদ্ধি, স্বাস্থ্য ও মানসিক শান্তির এক অমূল্য উপায়। নামাজের প্রতিটি রুকু ও সিজদাহ যেন হয় আমাদের আত্মশুদ্ধি, স্বাস্থ্য ও সুখের চাবিকাঠি—এটি শুধু আখিরাতের নয়, ইহজাগতিক কল্যাণেরও চাবিকাঠি।

তথ্যসূত্র: উপরের তথ্যাবলী IslamWeb এর প্রবন্ধ, জার্নাল অব অল্টারনেটিভ অ্যান্ড কমপ্লিমেন্টারি মেডিসিন, ইন্ডিয়ান জার্নাল অব সাইকিয়াট্রি, জার্নাল অব পাকিস্তান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন এবং আন্তর্জাতিক যোগ ও ক্রীড়াবিজ্ঞান জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য নেয়া হয়েছে। '

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

আমেরযত কাহিনি

আমেরযত কাহিনি

নিজস্ব প্রতিবেদক: স্বাদ, গন্ধ ও পুষ্টিগুণে পরিপূর্ণ ‘আম’ শুধু একটি ফল নয়, বরং এটি ইতিহাস, সংস্কৃতি ও অর্থনীতিতে গভীরভাবে প্রোথিত এক... বিস্তারিত