ইরানে এত বেশি ভারতীয় নাগরিক থাকার পিছনে চাঞ্চল্যকর তথ্য

বিশ্ব ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুন ২১ ১০:৪৮:৪৮
ইরানে এত বেশি ভারতীয় নাগরিক থাকার পিছনে চাঞ্চল্যকর তথ্য

ইসরাইল ও ইরানের মধ্যকার সাম্প্রতিক সামরিক উত্তেজনার সরাসরি প্রভাব পড়েছে দেশটিতে অবস্থানরত হাজার হাজার ভারতীয় নাগরিকের জীবনে। ক্ষেপণাস্ত্রের সাইরেন, ভূগর্ভস্থ বাঙ্কারে রাত কাটানো আর প্রিয়জনের মুখ না দেখা এই বাস্তবতায় প্রতিদিনের জীবন যেন হয়ে উঠেছে এক আতঙ্কঘেরা যুদ্ধাঞ্চল।

তেল আবিবের ভারতীয় কেয়ারগিভার রাঘবেন্দ্র নাইক জানান, "আমার ছয় বছরের মেয়েটাকে বহুদিন দেখিনি। সামনের মাসে বাড়ি যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, যাওয়া আর হবে না।" দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটকের বাসিন্দা নাইক গত ১৩ বছর ধরে ইসরাইলে কর্মরত। কিন্তু সাম্প্রতিক হামলা-পাল্টা হামলার বাস্তবতায় তিনিসহ বহু ভারতীয়ই নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত।

রাতের ঘুম এখন বিলাসিতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। "সাইরেন শুনলেই দৌড়ে যাই ভূগর্ভস্থ শেল্টারের দিকে। একেক সময় মনে হয়, বাঁচব তো?" এই প্রশ্নের উত্তর নাইক জানেন না, যেমন জানেন না তাঁর মতো হাজারো প্রবাসী কর্মী। ইসরাইল-ইরান সংঘাতের তীব্রতায় তাঁদের মনে জন্ম নিচ্ছে এক অসহায় আতঙ্ক।

তেলেঙ্গানা অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সোমা রভির অবস্থাও ভিন্ন নয়। তিনি বলেন, "আমার মেয়ে আমেরিকা থেকে ভারতে এসেছে, আমি বাড়ি যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পরিস্থিতি এমন জায়গায় গিয়ে ঠেকেছে যে কবে যেতে পারব, জানি না।"

সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে ১৮,০০০–২০,০০০ ভারতীয় কর্মী ইসরাইলে আছেন, যাঁদের অধিকাংশই কেয়ারগিভার বা নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। তবে বেসরকারি হিসাবে এই সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।

ইসরাইলে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর জন্য ভারতীয় কেয়ারগিভাররা হয়ে উঠেছেন অপরিহার্য। নিসিন মোসেরির মতো বয়স্ক নাগরিক বলেন, "সাইরেন বাজলে ভূগর্ভস্থ আশ্রয়স্থলে যেতে হলেও আমার কেয়ারগিভারের সাহায্য নিতে হয়।" ইসরাইলে ভারতীয়দের কর্মক্ষমতা এবং বিশ্বস্ততা তাঁদের অপরিহার্য করে তুলেছে, বিশেষ করে স্বাস্থ্যসেবা ও নির্মাণ খাতে।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইসরাইলে আটকে পড়া ভারতীয়দের জন্য একটি নিরাপদ প্রত্যাবাসন পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে।পরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রথমে স্থলপথে সীমান্ত পার করে ভারতীয় নাগরিকদের নিরাপদ এলাকায় স্থানান্তর করা হবে, পরে বিশেষ ফ্লাইটে দেশে ফিরিয়ে আনা হবে। এ জন্য তেল আবিবে অবস্থিত ভারতীয় দূতাবাসে একটি হেল্পডেস্ক চালু করা হয়েছে এবং স্বেচ্ছায় ফিরতে ইচ্ছুকদের যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে।

ইন্ডিয়ান ইকোনমিক ট্রেড অর্গানাইজেশনের সভাপতি ড. আসিফ ইকবালের মতে, ইসরাইলের প্রবীণ জনগণের একটি বড় অংশ কেয়ারগিভার হিসেবে ভারতীয়দের উপর নির্ভর করে। "মেল নার্স, নার্সিং অ্যাসোসিয়েট থেকে শুরু করে নির্মাণ শ্রমিক সবখানেই ভারতীয়দের চাহিদা বেশি।"

নির্মাণ খাতেও ভারতীয়দের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি রয়েছে, বিশেষ করে কাঠামো নির্মাণ, লোহা বাঁকানো ও প্লাস্টারিং কাজে। ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবন পুনর্গঠনে ভারতীয়দের অবদানও চোখে পড়ার মতো।

ম্যাঙ্গালোরের পিএন লরেন্সের মতো অনেকেই মনে করেন, যুদ্ধের আশঙ্কা মাথায় রেখেও ইসরাইলে কাজ করা লাভজনক ছিল। "এখানে বেতন ভালো, সুবিধাও বেশি। কিন্তু এখন আর কিছুই নিশ্চিত নয়।"

তিনি আরও বলেন, "যেখানে আমরা যা আয় করি, তার উপর ভারতে থাকা আমাদের পরিবারের জীবন নির্ভর করে। কিন্তু চতুর্দিকে এখন শুধু মৃত্যু আর ধ্বংস। কোথায় যাব?"

তেল আবিবের ব্যবসায়ী বেনি নাইডু বলেন, "আমরা আগে উৎসব একসঙ্গে করতাম, আড্ডা দিতাম। এখন সবাই ঘরেই থাকি শেল্টারে। অনেকেই বাড়ি ফিরে যেতে চাইছে।"

ইসরাইলি নাগরিকত্ব নেওয়া ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের সন্তানরাও আজ সামরিক বাহিনীতে নিযুক্ত। নাইডুর দুই ছেলে ইতিমধ্যেই বাহিনীতে কাজ করছেন।

ওয়াস্কার নামে এক প্রবীণ নেতা জানান, সাম্প্রতিক হামলায় তিনি একাধিক পরিচিতজনকে হারিয়েছেন। "যাঁদের হারিয়েছি, তাঁদের মধ্যে অনেকেই তরুণ। তাদের স্বপ্ন ছিল, জীবন ছিল। আজ সব শেষ।"

তার নাতনি স্তাভ বলেন, "দুই বছর আগে সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়েছি। কিন্তু যুদ্ধের এই পরিস্থিতিতে আবারও হয়তো যোগ দিতে হবে।"

রাঘবেন্দ্র নাইক শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। "পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলেই দেশে ফিরে যাব। এভাবে আর থাকা যাবে না।" আগে বছরে অন্তত একবার দেশে যেতে পারতেন। এখন সেটাও অসম্ভব।

ইসরাইলের প্রবাসী ভারতীয় সমাজ আজ দোদুল্যমান একদিকে জীবিকার টান, অন্যদিকে জীবনের ভয়। যুদ্ধক্ষেত্র আর কর্মক্ষেত্র এক হয়ে যাওয়ায় তাঁরা আজ প্রশ্ন করছেন “কোথায় যাব? কোথায় নিরাপদ?”

-ইসরাত, নিজস্ব প্রতিবেদক

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

স্টারমারের নীরবতা: কূটনৈতিক শিষ্টাচার বনাম রাজনৈতিক সংকোচ

স্টারমারের নীরবতা: কূটনৈতিক শিষ্টাচার বনাম রাজনৈতিক সংকোচ

একজন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ, সামাজিক ব্যবসার পথপ্রদর্শক এবং গণতান্ত্রিক উত্তরণের নেতৃত্বদানকারী রাষ্ট্রনায়ক—এই তিনটি পরিচয়ই এখন সমভাবে প্রযোজ্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের... বিস্তারিত