মতামত

বিশ্ববিদ্যালয় সংকট, বাজেট বৈষম্য ও শিক্ষায় ন্যায্যতার দাবি

শামসুল আরেফীন
শামসুল আরেফীন
শিক্ষক ও রাজনৈতিক গবেষক
২০২৫ জুন ১৯ ২১:৩৪:০৩

গত কয়েকদিন ধরে গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (জিএসটিইউ) শিক্ষার্থীরা পাঁচ দফা দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। ক্যাম্পাস সম্প্রসারণ, অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষক সংকট নিরসন, ছাত্র সংসদ চালু এবং শিক্ষা পরিবেশ উন্নয়ন—এসব দাবির পেছনে রয়েছে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৌলিক শর্তসমূহ। এসব দাবি নতুন নয়; বরং এ দাবিগুলো পূরণ না হলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে আদৌ “বিশ্ববিদ্যালয়” বলা যায় কি না, সে প্রশ্ন তোলা যুক্তিসঙ্গত।

দুঃখজনকভাবে, গত দেড় দশকে দেশে বহু বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা হয়েছে রাজনৈতিক স্বার্থে এবং উন্নয়ন সংস্থার সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ক্যাম্পাস নেই, ভাড়াকৃত ভবনে চলছে পাঠদান। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক নেই, আর নিয়োগপ্রক্রিয়া দলীয়করণ ও স্বজনপ্রীতির কারণে গুণগত শিক্ষা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর ফলে শিক্ষার্থীরা ক্লাসরুম, ল্যাব ও আবাসন সংকটসহ মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অভাবজনিত নানাবিধ সমস্যায় ভুগছে।

এই কাঠামোগত সংকট শিক্ষার্থীদের মধ্যে গভীর অসন্তোষের জন্ম দিয়েছে। গত ১৫ বছরে ২০টিরও বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যবিরোধী আন্দোলন হয়েছে, যা ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর ৪০ ছাড়িয়ে গেছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কিছুটা ফিরে আসায় ভবিষ্যতে আরও আন্দোলন হওয়াও স্বাভাবিক। এসব দাবিকে উপেক্ষা করা যাবে না, যদি না আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতান্ত্রিক পরিবেশ, অংশগ্রহণমূলক প্রশাসন এবং উন্নয়নের জন্য একটি সুসমন্বিত জাতীয় পরিকল্পনা গ্রহণ করি।

কিন্তু বাস্তবতা হলো, এখনো তেমন কোনো পরিবর্তনের প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। ইন্টারিম সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টার কার্যক্রম এখন পর্যন্ত উপাচার্য পরিবর্তন এবং আন্দোলন নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অথচ বাস্তব পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি কাঠামোগত সংস্কার।

২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য ১৩,২২২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত কম। গবেষণায় বরাদ্দ বেড়েছে মাত্র ২ কোটি টাকা—যা কার্যত প্রহসনের শামিল। ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফয়েজ দাবি করেছেন, অনেক বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণার অর্থ ব্যয় করতে পারে না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, গবেষণা বাধাগ্রস্ত হওয়ার পেছনে যেসব কাঠামোগত প্রতিবন্ধকতা কাজ করে—যেমন শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত, টিচিং লোড, ল্যাব ও রিসোর্স ঘাটতি—সেগুলো চিহ্নিত করে সমাধান দেওয়ার দায়িত্ব কার?

বাজেট বণ্টনেও বৈষম্য প্রকটভাবে দেখা যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, জিএসটিইউ এবার ইউজিসি থেকে মাত্র ৩ কোটি ৫ লাখ টাকা পেয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় ৩৪ কোটি টাকা কম। অথচ শুধু বেতন খাতেই প্রয়োজন ৩০ কোটি টাকা। তাহলে ক্লাস, গবেষণা বা আবাসনের বাজেট আসবে কোথা থেকে? বাজেট কমানোর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, গত বছরের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যর্থতা। যদি এই যুক্তি সঠিকও হয়, তাহলে প্রশ্ন হলো—কেন সেই প্রশাসনিক ব্যর্থতার বোঝা শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের কাঁধে চাপানো হবে?

এই বাজেট সংকটের পেছনে রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে অনেকের মতে, বিগত সরকারের সময়ে গোপালগঞ্জ বিশেষ সুবিধা পেয়েছিল, যার প্রতিক্রিয়ায় এখন উল্টো প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু একটি বিশ্ববিদ্যালয় কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলের নয়—এটি একটি জাতীয় সম্পদ। সেখানে দেশের নানা প্রান্ত থেকে মেধাবী শিক্ষার্থীরা আসে। আঞ্চলিক রাজনীতির প্রভাবে বাজেট নির্ধারিত হলে, তাতে সার্বজনীনতার নীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং বৈষম্য বাড়ে।

গণ-অভ্যুত্থানের পর “কেমন বিশ্ববিদ্যালয় চাই”—এই প্রশ্ন ঘিরে শিক্ষক নেটওয়ার্ক, সেমিনার ও আলোচনায় বহু প্রস্তাব উঠে এসেছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এখনও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়। শিক্ষা সংস্কারের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ কমিশন গঠনের দাবি বারবার উঠলেও তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন, এবং উপাচার্য নিয়োগে এখনও দলীয় পছন্দের ছাপ দেখা যাচ্ছে; নিয়োগের প্রক্রিয়া ও মানদণ্ডও অস্পষ্টই রয়ে গেছে।

এছাড়া ছাত্র সংসদ এখনও চালু হয়নি। নিরাপদ ও নারীবান্ধব ক্যাম্পাস গঠনের কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ নেই। বরং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক দুটি হত্যাকাণ্ড আবারও সহিংসতার আতঙ্ককে সামনে এনেছে। এমনকি বর্তমান সরকারের আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত কিছু উপাচার্যকেও আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করতে হয়েছে—যেমন কুয়েট ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা।

তবে সবকিছুর মাঝেও কিছু ইতিবাচক পরিবর্তনের আভাস মিলছে। বিভিন্ন ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থী সংগঠন ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর সহাবস্থান এখন চোখে পড়ে, যা আগের শাসনামলে সম্ভব ছিল না। উপাচার্য নিয়োগে প্রথমবারের মতো সার্চ কমিটি গঠিত হয়েছে, যদিও এর কাঠামো নিয়ে সমালোচনার অবকাশ রয়েছে। কিছু বিশ্ববিদ্যালয় পিএইচডি শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তি ঘোষণা করেছে। ইউজিসি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়কে পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তি করার অনুমতি দিয়েছে এবং ব্র্যাক ও যুক্তরাজ্যের সোয়াস বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ পিএইচডি প্রোগ্রামও চালু হয়েছে—যা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে।

তবুও বড় প্রশ্ন থেকেই যায়—উচ্চশিক্ষা ও বিশ্ববিদ্যালয় উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি, ন্যায্য ও কার্যকর পরিকল্পনা কোথায়? এই প্রেক্ষিতে আমার কিছু প্রস্তাব :

  • পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শতভাগ শিক্ষার্থীর আবাসন নিশ্চিত করতে হবে
  • বাজেট বণ্টনে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও ন্যায্যতা বজায় রাখতে হবে
  • ছাত্র সংসদ অবিলম্বে চালু করে অংশগ্রহণমূলক প্রশাসন গড়ে তুলতে হবে
  • গবেষণার জন্য সহায়ক পরিবেশ ও পর্যাপ্ত তহবিল নিশ্চিত করতে হবে
  • শিক্ষকদের বেতন ও মর্যাদা বৃদ্ধি করতে হবে
  • প্রান্তিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সংকট নিরূপণ করে দ্রুত সমাধান দিতে হবে

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—কোনো বিশ্ববিদ্যালয় যেন জাতীয় বা আঞ্চলিক রাজনীতির বলি না হয়। একাডেমিক সুযোগ-সুবিধা থেকে কেউ যেন বঞ্চিত না হয়, সেটিই হওয়া উচিত রাষ্ট্রের ন্যূনতম দায়িত্ব। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয় শুধু উচ্চশিক্ষা অর্জনের স্থান নয়; এটি একটি জাতির নৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক এবং গণতান্ত্রিক চেতনার ভিত্তি নির্মাণের প্রধান ক্ষেত্র।

অতএব, বিশ্ববিদ্যালয়ের সংকট মানে শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতা নয়—এটি আমাদের পুরো সমাজব্যবস্থা, বিশেষত গণতন্ত্র, সাম্য এবং সামাজিক ন্যায়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে এক গভীর সতর্ক সংকেত। গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলন সেই সতর্ক সংকেতেরই বহিঃপ্রকাশ—যা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, এখনই সময় মৌলিক চাহিদা পূরণ, স্বচ্ছ বাজেট বণ্টন এবং অংশগ্রহণমূলক প্রশাসন নিশ্চিত করার।

এই প্রেক্ষাপটে, আমাদের অবশ্যই আঞ্চলিক পক্ষপাত, দলীয় নিয়ন্ত্রণ এবং প্রশাসনিক ব্যর্থতা পরিহার করে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, ন্যায্য এবং টেকসই উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এটি কেবল শিক্ষার্থীদের জন্য নয়, বরং একটি ন্যায্য রাষ্ট্র ও মানবিক সমাজ নির্মাণে আমাদের সবার স্বার্থেই অত্যন্ত জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয় যেন সত্যিকার অর্থে হয়ে উঠতে পারে জ্ঞান, স্বাধীনতা এবং ন্যায়ের আলোকবর্তিকা—এই হোক আমাদের সম্মিলিত অঙ্গীকার।

- লেখক শামসুল আরেফীন গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবং বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষণা করছেন।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

স্টারমারের নীরবতা: কূটনৈতিক শিষ্টাচার বনাম রাজনৈতিক সংকোচ

স্টারমারের নীরবতা: কূটনৈতিক শিষ্টাচার বনাম রাজনৈতিক সংকোচ

একজন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ, সামাজিক ব্যবসার পথপ্রদর্শক এবং গণতান্ত্রিক উত্তরণের নেতৃত্বদানকারী রাষ্ট্রনায়ক—এই তিনটি পরিচয়ই এখন সমভাবে প্রযোজ্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের... বিস্তারিত