ইহুদি জাতি: ইতিহাসের অভিশপ্ত অধ্যায়

আল্লাহর নবী হজরত ইসহাক (আ.)-এর পুত্র হজরত ইয়াকুব (আ.) ছিলেন একজন সম্মানিত নবী, যিনি “ইসরাইল” নামেও পরিচিত ছিলেন। এই “ইসরাইল” নাম থেকেই তার বংশধররা পরিচিত হয় বনি ইসরাইল নামে, যা পরবর্তীতে ইহুদি জাতিতে রূপ নেয়। ইতিহাস ও ধর্মীয় সূত্র অনুযায়ী, বনি ইসরাইল এমন এক জাতি যারা আল্লাহর নেয়ামতপ্রাপ্ত হয়েও বারবার তার অবাধ্যতা করেছে। তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত নবীদের অমান্য করেছে, অনেক নবীকে হত্যা করেছে, এবং বারবার সীমালঙ্ঘন করেছে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বনি ইসরাইলদের ব্যাপারে বারবার সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন এবং তাদের ওপর গজব, লাঞ্ছনা ও অপমান আরোপ করেছেন। সূরা আরাফের ১৬৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, কিয়ামত পর্যন্ত তিনি এমন কিছু শক্তিকে তাদের ওপর চাপিয়ে দেবেন যারা তাদের উপর কঠোর শাস্তি দেবে। সূরা বাকারা, সূরা আল ইমরান ও সূরা মায়েদার বিভিন্ন আয়াতে বনি ইসরাইলদের অপরাধ, কাফের মনোভাব ও অন্যায় আচরণের জন্য শাস্তির বিবরণ দেওয়া হয়েছে।
পবিত্র কোরআনের এসব আয়াত শুধু ঐতিহাসিক ঘটনা নয়, বরং বর্তমান এবং ভবিষ্যতের জন্য এক সতর্ক বার্তা। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বনি ইসরাইল বারবার ধ্বংস ও লাঞ্ছনার সম্মুখীন হয়েছে। ফেরআউন শাইশাক যখন মিসর থেকে জেরুসালেম দখল করে নেয়, তখন ইহুদিদের বিতাড়িত করা হয়। পরবর্তীতে ব্যাবিলনের রাজা বখতে নসর ইহুদিদের বন্দি করে নিয়ে যায় এবং তাদের দাসে পরিণত করে। জেরুসালেম বারবার ধ্বংসের সম্মুখীন হয়, এবং ইহুদি জাতি পরিচিত হয়ে ওঠে এক বিতাড়িত, লাঞ্ছিত ও শাস্তিপ্রাপ্ত জাতি হিসেবে। ৬৬ খ্রিষ্টাব্দে রোমান সম্রাট তাইতুস জেরুসালেম আক্রমণ করে ইহুদিদের ব্যাপকহারে হত্যা করেন এবং শহরটি ধ্বংস করেন। ৭০ খ্রিষ্টাব্দে রোমান বাহিনী হাজার হাজার ইহুদিকে দাস বানিয়ে রোমে নিয়ে যায়। এভাবে তাদের উপর ধারাবাহিকভাবে একের পর এক বিপর্যয় নেমে এসেছে।
ইতিহাসের আরেক ভয়াবহ অধ্যায় ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি নেতা অ্যাডলফ হিটলারের নেতৃত্বে সংঘটিত ইহুদি গণহত্যা। আনুমানিক ৬০ লক্ষ ইহুদিকে ‘হলোকস্ট’ নামক পরিকল্পিত গণহত্যায় হত্যা করা হয়, যার একটি বড় অংশ গ্যাস চেম্বার, কনসেনট্রেশন ক্যাম্প ও নাৎসি বাহিনীর নির্যাতনে নিহত হয়। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, হিটলার ইহুদিদের ঘৃণা করতেন কারণ তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ের জন্য ইহুদিদের দায়ী মনে করতেন। তবে কিছু ইতিহাসবিদ ও গবেষকের মতে, এই ঘৃণার পেছনে ছিল আরও গভীর রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র। তাদের দাবি, ইহুদি নেতারা ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে হিটলারের সঙ্গে এক গোপন চুক্তি করেন। উদ্দেশ্য ছিল, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা ইহুদিদের মধ্যে এমন ভয় ও নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করা, যাতে তারা স্বেচ্ছায় দেশত্যাগ করে ফিলিস্তিনে চলে যেতে বাধ্য হয়।
এই তথাকথিত গোপন পরিকল্পনা অনুযায়ী, ৪,৫০,০০০ ইহুদির মধ্যে মাত্র ৭,০০০ জনকে ইসরাইল পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয় এবং অবশিষ্টদের হত্যার নীলনকশা করা হয়। গ্যাস চেম্বারে গণহত্যা মূলত একটি কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হয় যাতে বিশ্বব্যাপী ইহুদিদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। এমনকি হাইফা বন্দরে ইহুদি বোঝাই এক জাহাজ পৌঁছানোর পরও যাত্রীরা জাহাজ থেকে নামতে রাজি না হওয়ায়, তাদের নেতা ডেভিড বেন গুরিওন নিজেই সেই জাহাজে বোমা মেরে সাগরে ডুবিয়ে দেন—এমন অভিযোগ রয়েছে। যদিও এসব তথ্য ঐতিহাসিকভাবে বিতর্কিত, তবে এতে বোঝা যায় ইসরাইল রাষ্ট্রের পেছনে শুধু নিপীড়ন নয়, বরং সুপরিকল্পিত আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পদক্ষেপও কাজ করেছে।
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ভবিষ্যতের একটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধের ইঙ্গিত পাওয়া যায় হাদিসে। নবী করিম (সা.) হাদিসে বলেছেন, কিয়ামতের পূর্বে মুসলিমরা ইহুদিদের সঙ্গে যুদ্ধ করবে। সে যুদ্ধে ইহুদিরা পাথর ও গাছের পেছনে লুকিয়ে পড়বে। তখন গাছ ও পাথর বলবে, “হে মুসলিম, হে আল্লাহর বান্দা! এ তো একজন ইহুদি, এসো তাকে হত্যা করো।” (সহিহ মুসলিম)। এ হাদিস থেকে বোঝা যায়, ভবিষ্যতে এক চূড়ান্ত যুদ্ধ হবে, যা আল্লাহর গজবের একটি দৃশ্যমান বাস্তবায়ন হিসেবে বিবেচিত হবে। তবে সেই যুদ্ধ কখন সংঘটিত হবে তা স্পষ্ট করে বলা হয়নি।
আজকের বাস্তবতায় দেখা যায়, সেই ইহুদি জাতি যারা এক সময় ধ্বংসপ্রাপ্ত, বিতাড়িত ও গজবগ্রস্ত ছিল তারা এখন মধ্যপ্রাচ্যে একটি শক্তিশালী, অস্ত্র-সমৃদ্ধ রাষ্ট্র ইসরাইল প্রতিষ্ঠা করেছে, যা পারমাণবিক শক্তিধর এবং পশ্চিমা পরাশক্তির মিত্র। তারা ফিলিস্তিনের মুসলিম জনগণকে দীর্ঘদিন ধরে দমন, দখল ও গণহত্যার মাধ্যমে জর্জরিত করে রেখেছে। এই বাস্তবতা অনেকের মনে প্রশ্ন তোলে কোরআনের গজব কি এখনও চলছে, নাকি তার চূড়ান্ত রূপ দেখা বাকি?
মুসলমানদের জন্য এখানে শিক্ষা নেওয়ার বিষয় হলো, আল্লাহর গজব কখন, কীভাবে এবং কোন রূপে নেমে আসে, তা সবসময় মানুষের দৃষ্টিতে দৃশ্যমান হয় না। কিন্তু আল্লাহর প্রতিশ্রুতি অটল এবং চূড়ান্ত ন্যায়বিচার অনিবার্য। আমাদের করণীয় হলো ঈমানের ওপর অটল থাকা, সত্যের পক্ষে থাকা এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া। এই দুঃসময় আমাদের জন্য ধৈর্যের পরীক্ষা। আল্লাহর কাছে দোয়া করতে হবে যেন তিনি আমাদের ধৈর্য দান করেন, নেতৃত্ব দান করেন এবং সহসাই বিজয় ও মুক্তির চূড়ান্ত সূর্য উদিত করেন।
পাঠকের মতামত:
আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ
- ভবিষ্যতের গণতন্ত্র না পুরাতনের পুনরাবৃত্তি? ইউনুস-তারেক সাক্ষাৎ পর্যালোচনা
- জুলাই চার্টার ও জাতীয় ঐকমত্য: জামায়াতের অনুপস্থিতি কতটা যুক্তিসঙ্গত?
- রিজার্ভের দাপট: বিদ্যুৎ খাতের ১৪ কোম্পানি বিনিয়োগের নতুন ঠিকানা
- ইউনূস-তারেক ঐতিহাসিক ও সফল বৈঠক: সংস্কার, একতা ও ন্যায়বিচার— এই তিন স্তম্ভে গড়ে উঠুক নতুন বাংলাদেশ
- উৎসব: ঈদের পর্দায় অনবদ্য এক উদযাপন
- Clash of Civilizations: মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধের নতুন রূপরেখা
- মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ভূ-রাজনৈতিক আধিপত্যের নতুন কৌশল: চীন ও রাশিয়া কী করবে?
- লন্ডনে তারেক-ইউনূসের বৈঠকের পরে পর পর ২টি স্ট্যাটাসে কি বললেন পিনাকী?
- তুরস্ক, সৌদি, ইরান-পাকিস্তানের হাতে ‘ইসলামিক আর্মি’ গঠন! কি হতে যাচ্ছে?
- ইসরায়েলে ইরানি মিসাইল, নিহত অন্তত ৭
- ইসরায়েল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে রাশিয়ার সতর্কবার্তা
- ভোক্তার কষ্ট বুঝছে সরকার:বাণিজ্য উপদেষ্টা
- ২৮ জুন ঢাকায় জনতার ঢল: সোহরাওয়ার্দী উদ্যান হবে মহাসমুদ্র!
- নির্বাচিত নারী, অলঙ্কার নয়: গণতন্ত্রে নারীর শক্তির সন্ধান
- ইরানের কাছে বর্তমানে পরমাণু অস্ত্র নেই:নেতানিয়াহু