মতামত
Clash of Civilizations: মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধের নতুন রূপরেখা

ড. বাতেন মোহাম্মদ
শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
জার্মান চ্যান্সেলর মার্জ অকপটে ঘোষণা করেছেন—"ইসরায়েল যে নোংরা কাজটি করছে, সেটি আমাদের সবার জন্য।" একেবারে সরাসরি বক্তব্য, কোনো রাখঢাক নেই। এই বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি নির্দ্বিধায় ইসরায়েলকে সমর্থন জানালেন এবং ইসরায়েলের এই অন্যায্য হামলাকে গ্লোবাল ওয়েস্টের সম্মিলিত স্বার্থ হিসেবে উপস্থাপন করলেন।
ইসরায়েলকে শুধুমাত্র একটি ইহুদি রাষ্ট্র হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। বরং এটিকে ইউরোপীয়দের, সুনির্দিষ্ট করে বললে পশ্চিমাদের, উপনিবেশবাদী সম্প্রসারণের একটি অঙ্গ এবং আমেরিকার একটি কার্যত অর্ধ-রাজ্য হিসেবে বিবেচনা করাই যথাযথ। ফলে ইসরায়েল কী চায় সেটা বোঝার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—ওয়েস্ট কী চায়, আমেরিকা কী চায়—তা অনুধাবন করা।
ওয়েস্ট মধ্যপ্রাচ্যকে যেমনভাবে দেখতে চায়, তার এক প্রতিচ্ছবি হলো সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, এবং আংশিকভাবে সৌদি আরব। এইসব দেশ রাজতান্ত্রিক—একধরনের ‘ওয়েস্টার্ন-কমপ্লায়েন্ট’ শাসনব্যবস্থা। কারণ এখানে প্রকৃত গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি ওয়েস্টের সেই কল্পিত ইসলামিক শাসনের কাঠামোর সাথে মেলে না, যেটা তারা নিজেদের মূল্যবোধের সঙ্গে সহনশীলভাবে খাপ খাওয়াতে পারে।
মধ্যপ্রাচ্যে কিছু দেশ যেমন—ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া এবং ইরান—যেখানে জনগণের প্রতিনিধিত্ব (যদিও ত্রুটিপূর্ণ) আংশিকভাবে বিদ্যমান ছিল, সেগুলোকেই টার্গেট করা হয়েছে এবং নানা অজুহাতে ধ্বংস করা হয়েছে। অথচ কোনো রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে এমন আক্রমণ হয়নি। কারণ, রাজতন্ত্র ওয়েস্টের জন্য ‘ম্যানেজেবল’। পক্ষান্তরে, ইসলামিক সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণ ওয়েস্টের দৃষ্টিতে একটি কালচারাল ঝুঁকি হিসেবে বিবেচিত হয়।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে স্যামুয়েল হান্টিংটনের “Clash of Civilizations” থিসিসটি অনেকটা বাস্তবসম্মত মনে হয়। এই যুদ্ধ কেবল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের নয়; বরং এটি ইসলামিক সভ্যতার সঙ্গে পশ্চিমা জুডিও-খ্রিস্টান সভ্যতার একটি সংঘর্ষ। তবে, জুডিও-খ্রিস্টান বিশ্ব তাদের ধর্মীয় চেতনাকে লাইফস্টাইলে রূপান্তর করে নিয়েছে—তাদের রাজনৈতিক আদর্শে ধর্ম ও জীবনধারার মধ্যে একধরনের সাংস্কৃতিক অভ্যন্তরীণীকরণ ঘটে গেছে। ফলে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ইত্যাদি ওয়েস্টার্ন আদর্শ একটি কৌশলী ধর্মনিরপেক্ষ আড়ালে প্যাকেজ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
অন্যদিকে, ইসলামিক সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রগুলো একটি গভীর দ্বন্দ্বের মধ্যে রয়েছে। এর জন্য শুধুমাত্র তাদের দায়ী করা চলে না। অধিকাংশ পোস্ট-কলোনিয়াল রাষ্ট্রের প্রাথমিক প্রতিষ্ঠানিক কাঠামো ওয়েস্ট দ্বারা গঠিত হওয়ায় তাদের আইন ও শাসনব্যবস্থা ইসলামিক রীতিনীতিকে ধারণে অসমর্থ। এর সমাধান দুটি হতে পারে: হয় রাষ্ট্রীয় কাঠামো থেকে ধর্মকে একেবারে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা, নতুবা আইন কাঠামোকে ইসলামসম্মতভাবে পুনর্গঠন করা। যেহেতু দ্বিতীয়টি প্রায় অসম্ভব, তাই অনেক রাষ্ট্রে প্রথমটির একটি হাইব্রিড সংস্করণ দেখা যাচ্ছে। ফলে এসব রাষ্ট্রকে গ্লোবাল সিস্টেমে কার্যকরভাবে পরিচালনা করাও জটিল হয়ে পড়ছে।
এই দুই সভ্যতার সংঘর্ষে একটিকে নিছক ভিকটিম ও অন্যটিকে নিছক অপরাধী হিসেবে দেখা আবেগপূর্ণ হলেও, বাস্তবসম্মত কোনো সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব নয়। পশ্চিমারা ইসলামকে একটি কালচারাল থ্রেট হিসেবে দেখে। ফলে ধর্ম যখন রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে জড়িত হয়, তখন রাষ্ট্রের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ধর্মের আদর্শের সঙ্গে মিশে যায় এবং জনগণের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আকাঙ্ক্ষাগুলো একাকার হয়ে পড়ে। এই পরিপ্রেক্ষিতে যেসব দেশে ক্ষমতার ন্যূনতম হস্তান্তর ব্যবস্থা আছে, তারা সাংস্কৃতিক অনিশ্চয়তায় পড়ে যায়—যেমন পাকিস্তান, ইরান, আফগানিস্তান—এবং এমনকি বাংলাদেশও এর বাইরে নয়।
এই বাস্তবতায় বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো—তারা ইসলামপন্থী রাজনীতিকে কোন কাঠামোতে এবং কতদূর পর্যন্ত মেনে নিতে প্রস্তুত? রাষ্ট্রের ভবিষ্যতের জন্য এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়।
ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ—এর নৈতিকতা নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়। এটি একতরফাভাবে অন্যায় এবং নিঃশর্তভাবে বলা যায়—উইদাউট ইফ অ্যান্ড বাট। তাহলে প্রশ্ন আসে—জি-৭ কেন এমন পক্ষপাতমূলক বিবৃতি দিল? জার্মান চ্যান্সেলরের বক্তব্যের ভাষাই বলে দেয়—ইসরায়েল আসলে পশ্চিমাদের হয়ে ‘ডার্টি ওয়ার্ক’ সম্পন্ন করছে। এই মনোভাবই হলো ওয়েস্টের সত্যিকারের চেহারা। এই যুদ্ধকে শুধুমাত্র মুসলিমদের সঙ্গে একটি ইহুদি রাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব হিসেবে দেখা একটি মারাত্মক সরলীকরণ হবে। এটি মূলত পূর্ব ও ইসলামিক বিশ্বের ভিতরে থাকা বিভাজন ও ভাঙনের প্রতিফলন।
ইরান আদর্শ রাষ্ট্র নয়—এটা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে আত্মরক্ষার অধিকার তার রয়েছে। সমস্যা হলো—যে মিত্রদের দিকে তাকিয়ে ছিল ইরান, তারা কেউ-ই প্রকাশ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েনি। যেটা আমেরিকা তার মিত্রদের জন্য করে। তখন প্রশ্ন আসে—চীন ও রাশিয়া কেন একইভাবে কাজ করে না?
কারণ আমেরিকা আসলে জুডিও-খ্রিস্টান সভ্যতার একটি সম্প্রসারণ, তাই তাদের মধ্যে একটি মানসিক ঐক্য ও সাংস্কৃতিক বোঝাপড়া আছে। পক্ষান্তরে ইরান, চীন ও রাশিয়ার সম্পর্ক কেবলমাত্র কৌশলগত এবং স্বার্থনির্ভর—আত্মিক নয়। ইরান আরব নয়, আবার এই শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর সাংস্কৃতিক অক্ষেও পড়ে না—সে পার্সিয়ান। এই জাতিগত ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য তাকে আরবদের সাথেও সম্পূর্ণভাবে যুক্ত হতে দেয় না।
তবুও, ইরানই হয়তো একমাত্র ইসলামিক রাষ্ট্র, যার উপস্থিতি ওয়েস্টকে এখনো রাজনৈতিক ইসলাম নিয়ে চিন্তিত করে রাখে। যদি ইরানকে ম্যানেজ করা যায়, তাহলে ওয়েস্ট "Clash of Civilizations"-এ বিজয়ের এক প্রতীকী তৃপ্তি পাবে।
কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়—এই সংঘর্ষ কি আদৌ শেষ হবে? ধর্ম ও সভ্যতা ধ্বংস করে কি স্থায়ী শান্তি আনা যাবে? যদি ইরান ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে পুরো মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বিভিন্ন রূপে বিদ্রোহ ও চরমপন্থার বিস্তার ঘটবে—এই আশঙ্কা একেবারে অমূলক নয়।
এই যুদ্ধ সহসাই শেষ হওয়ার নয়। এটা সম্ভবত রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের যুদ্ধ নয়—এটি দুইটি সভ্যতা, দুইটি আদর্শ ও ঐতিহ্যের মধ্যে সংঘর্ষ। এটি সম্ভবত একটি বাস্তব ‘Clash of Civilizations’।
পাঠকের মতামত:
আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ
- ভবিষ্যতের গণতন্ত্র না পুরাতনের পুনরাবৃত্তি? ইউনুস-তারেক সাক্ষাৎ পর্যালোচনা
- শেয়ারবাজারে এল বড় সুখবর!
- জুলাই চার্টার ও জাতীয় ঐকমত্য: জামায়াতের অনুপস্থিতি কতটা যুক্তিসঙ্গত?
- স্টারমারের নীরবতা: কূটনৈতিক শিষ্টাচার বনাম রাজনৈতিক সংকোচ
- রিজার্ভের দাপট: বিদ্যুৎ খাতের ১৪ কোম্পানি বিনিয়োগের নতুন ঠিকানা
- ইউনূস-তারেক ঐতিহাসিক ও সফল বৈঠক: সংস্কার, একতা ও ন্যায়বিচার— এই তিন স্তম্ভে গড়ে উঠুক নতুন বাংলাদেশ
- উৎসব: ঈদের পর্দায় অনবদ্য এক উদযাপন
- মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ভূ-রাজনৈতিক আধিপত্যের নতুন কৌশল: চীন ও রাশিয়া কী করবে?
- তিন মাসেই যে ১০ বেসরকারি ব্যাংকে ৩২ হাজার কোটি টাকার আমানত বৃদ্ধি!
- লন্ডনে তারেক-ইউনূসের বৈঠকের পরে পর পর ২টি স্ট্যাটাসে কি বললেন পিনাকী?
- তুরস্ক, সৌদি, ইরান-পাকিস্তানের হাতে ‘ইসলামিক আর্মি’ গঠন! কি হতে যাচ্ছে?
- ইসরায়েলে ইরানি মিসাইল, নিহত অন্তত ৭
- ইসরায়েল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে রাশিয়ার সতর্কবার্তা
- ২৮ জুন ঢাকায় জনতার ঢল: সোহরাওয়ার্দী উদ্যান হবে মহাসমুদ্র!
- নির্বাচিত নারী, অলঙ্কার নয়: গণতন্ত্রে নারীর শক্তির সন্ধান