ইতিহাস ও দর্শন

শিক্ষার শক্তিতে রাষ্ট্রের রূপান্তর: মেইজি জাপানের অনন্য অভিজ্ঞতা ও বাংলাদেশের সম্ভাবনা

ইতিহাস ও দর্শন ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুন ১৮ ২৩:০০:৪০
শিক্ষার শক্তিতে রাষ্ট্রের রূপান্তর: মেইজি জাপানের অনন্য অভিজ্ঞতা ও বাংলাদেশের সম্ভাবনা

ইতিহাসে এমন কিছু সময় আসে, যখন একটি জাতিকে নিজ অস্তিত্ব রক্ষার জন্য আত্মসমালোচনা করে নতুনভাবে নিজেদের গড়ে তুলতে হয়। জাপানের মেইজি পুনঃস্থাপন (Meiji Restoration) ছিল তেমনই এক ঐতিহাসিক পর্ব—যেখানে জাতিগত সংকট থেকে উত্তরণের পথ হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছিল শিক্ষা, জ্ঞান ও পরিকল্পিত রাষ্ট্রীয় সংস্কারকে। এই পুনঃস্থাপনের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল বৈদেশিক শিক্ষামিশন, বিদ্যার্থী প্রেরণ ও শিক্ষাব্যবস্থার পুনর্গঠন, যার মাধ্যমে জাপান কয়েক দশকের মধ্যেই একটি আধুনিক, প্রযুক্তিনির্ভর, শিল্পোন্নত ও সামরিক পরাশক্তিতে রূপান্তরিত হয়।

১৮৫৩ সালে মার্কিন নৌ-অধিনায়ক কমোডোর পেরির আগমনের মাধ্যমে জাপান প্রথমবারের মতো অনুভব করে যে, তার দীর্ঘদিনের ফিউডাল ও আত্মনির্ভর সমাজব্যবস্থা একটি আধুনিক বিশ্বে টিকে থাকার জন্য প্রস্তুত নয়। পশ্চিমা আগ্রাসনের হুমকি এবং বৈষম্যমূলক চুক্তির চাপে টোকুগাওয়া শাসনের পতন ঘটে। ১৮৬৮ সালে সম্রাট মেইজির ক্ষমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে শুরু হয় রাষ্ট্রীয় পুনর্গঠনের এক ঐতিহাসিক অধ্যায়। এটি ছিল কেবল রাজনৈতিক পরিবর্তন নয়, বরং একটি সমগ্র জাতিকে পুনঃনির্মাণের রূপকল্প—যেখানে শিক্ষা ও বৈদেশিক জ্ঞানার্জনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়।

১৮৭১ সালে পাঠানো ইওয়াকুরা মিশন ছিল জাপানের রাষ্ট্রীয় জ্ঞানভিত্তিক রূপান্তরের প্রথম বড় পদক্ষেপ। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের ১২টি দেশ সফরের মাধ্যমে প্রতিনিধি দলটি প্রত্যক্ষ করে আধুনিক শিক্ষাপ্রণালী, প্রযুক্তিনির্ভর শিল্প, সামরিক কাঠামো এবং প্রশাসনিক দক্ষতা। তাদের পর্যবেক্ষণ ছিল সুস্পষ্ট: “রাষ্ট্রকে আধুনিক করতে চাইলে জনগণকে শিক্ষিত করতে হবে—তথ্য, প্রযুক্তি ও নৈতিকতাভিত্তিক শিক্ষা দিয়ে।” এই অভিজ্ঞতার আলোকে জাপান সিদ্ধান্ত নেয়, শিক্ষাই হবে তার জাতীয় পুনর্জাগরণের কেন্দ্রীয় মাধ্যম।

ইওয়াকুরা মিশনের অনুপ্রেরণায় জাপান সরকার রাষ্ট্রীয় খরচে শত শত তরুণ শিক্ষার্থীকে ইউরোপ ও আমেরিকায় পাঠায়। এদের মধ্যে অনেকে হয়ে ওঠেন আধুনিক জাপানের স্থপতি। যেমন—ইতো হিরোবুমি ব্রিটেনে পড়াশোনা করে ফিরে এসে মেইজি সংবিধান প্রণয়ন করেন; ইয়ামাগাতা আরিতোমো জার্মানি থেকে সামরিক শিক্ষা নিয়ে দেশে ফিরে জাতীয় সেনাবাহিনীর ভিত্তি স্থাপন করেন; ওকুমা শিগেনোবু অর্থনৈতিক সংস্কারের রূপরেখা তৈরি করেন। এই শিক্ষার্থীরা বিদেশ থেকে শুধু ডিগ্রি নিয়ে ফেরেননি; তারা নিয়ে আসেন দৃষ্টিভঙ্গি, শৃঙ্খলা ও কাঠামোগত রূপান্তরের দক্ষতা, যা দেশের অভ্যন্তরে বাস্তবায়ন করে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলেন।

১৮৭২ সালে প্রবর্তিত “গাকুসেই” শিক্ষা আইন জাপানে সর্বজনীন ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা চালু করে। এই নীতিতে গুরুত্ব পায়—বিজ্ঞান ও গণিতভিত্তিক আধুনিক শিক্ষা, নৈতিকতা ও দেশপ্রেম, প্রযুক্তিনির্ভর দক্ষতা এবং শিক্ষার মাধ্যমে সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস ভেঙে নতুন নেতৃত্ব তৈরি। সরকার বিদেশি বিশেষজ্ঞদের নিয়োগ দিয়ে স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়, কারখানা, সেনাবাহিনী ও প্রশাসনে প্রয়োজনীয় জ্ঞান স্থানান্তর করে। পাশাপাশি গড়ে ওঠে টোকিও, কিয়োটো ও ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যা পরবর্তীতে জাপানের উন্নয়নে মেধা সরবরাহকারী প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়।

শিক্ষা ও জ্ঞানভিত্তিক এই রূপান্তরের ফলাফল ছিল অভূতপূর্ব। কয়েক দশকের মধ্যেই জাপান শিল্পায়ন করে রেলপথ, স্টিল কারখানা, বিদ্যুৎ ও জাহাজ নির্মাণ; গড়ে তোলে শক্তিশালী সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনী; বিজয় অর্জন করে চীন-জাপান (১৮৯৪–৯৫) এবং রুশ-জাপান (১৯০৪–০৫) যুদ্ধে; এবং আত্মপ্রকাশ করে এশিয়ার প্রথম আধুনিক সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র হিসেবে। এই সাফল্যের ভিত্তি ছিল—একটি শিক্ষিত, সুশৃঙ্খল, দক্ষ এবং রাষ্ট্রনিষ্ঠ নাগরিক সমাজ।

বাংলাদেশও উন্নয়নশীল বিশ্বের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য, যার রয়েছে বিশাল যুবসমাজ, উচ্চ শিক্ষিত জনসংখ্যা এবং সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ। কিন্তু প্রশ্ন হলো—আমরা কি মেইজি জাপানের শিক্ষাকেন্দ্রিক রাষ্ট্রগঠনের মডেল থেকে কিছু শিখতে পারি? উত্তর—অবশ্যই পারি, তবে তা কেবল অনুকরণ নয়, বরং প্রাসঙ্গিক ব্যাখ্যা ও প্রয়োজনভিত্তিক প্রয়োগে হতে হবে। বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজন—বৈদেশিক শিক্ষামিশনকে কৌশলগত রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ হিসেবে দেখা; বিদেশফেরত শিক্ষিতদের জ্ঞানকে নীতিনির্ধারণ ও রূপকৌশলে অন্তর্ভুক্ত করা; জাতীয় শিক্ষানীতিকে গবেষণা, উদ্ভাবন ও নেতৃত্বে সংযুক্ত করা; এবং প্রযুক্তি, নৈতিকতা ও নাগরিক দায়িত্ববোধ একীভূত শিক্ষা কাঠামো গঠন।

আজকের বাংলাদেশে যে সংখ্যক মেধাবী শিক্ষার্থী বিদেশে যাচ্ছে, তাদের জ্ঞান রাষ্ট্র নির্মাণে কাজে লাগাতে সরকারি ও নীতিগত কাঠামো তৈরি করা জরুরি। কারণ, মেইজি জাপান আমাদের দেখিয়েছে—শক্তি মানেই অস্ত্র নয়, শিক্ষা-নির্ভর নেতৃত্বই পারে একটি জাতিকে টিকিয়ে রাখতে এবং আধুনিকতার পথে এগিয়ে নিতে। বাংলাদেশ যদি আগামী প্রজন্মকে জ্ঞান, নৈতিকতা ও কৌশলগত দক্ষতায় সমৃদ্ধ করতে চায়, তবে এখনই প্রয়োজন একটি শিক্ষাভিত্তিক রাষ্ট্রদর্শন, যা কেবল চাকরি নয়, বরং নাগরিক গঠনের মাধ্যমে রাষ্ট্র নির্মাণে সহায়ক হবে।

জ্ঞানই যখন শক্তি, তখন শিক্ষা হতে পারে আমাদের সবচেয়ে কার্যকর রাষ্ট্রীয় অস্ত্র।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

আমেরযত কাহিনি

আমেরযত কাহিনি

নিজস্ব প্রতিবেদক: স্বাদ, গন্ধ ও পুষ্টিগুণে পরিপূর্ণ ‘আম’ শুধু একটি ফল নয়, বরং এটি ইতিহাস, সংস্কৃতি ও অর্থনীতিতে গভীরভাবে প্রোথিত এক... বিস্তারিত