সম্পাদকীয়
মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ভূ-রাজনৈতিক আধিপত্যের নতুন কৌশল: চীন ও রাশিয়া কী করবে?

অহিদুজ্জামান
নির্বাহী সম্পাদক

মধ্যপ্রাচ্য আবারও এক ভয়াবহ ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। চলতি মাসের ১৩ তারিখে ইসরায়েল ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ (Operation Rising Lion) নামে এক নজিরবিহীন সামরিক অভিযান চালিয়েছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সমর্থন ও গোপন তথ্য-সহায়তা ছিল স্পষ্ট। এই অভিযানে ইরানের ১০০টিরও বেশি সামরিক, পারমাণবিক ও বেসামরিক স্থাপনায় হামলা চালানো হয়। নিহত হন ইরানের বিপ্লবী গার্ড (IRGC)-এর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হোসেইন সালামী, মোহাম্মদ বাগেরি, গোলাম আলি রাশিদসহ শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন পরমাণু বিজ্ঞানী। পাশাপাশি, এ হামলায় অন্তত ৯০ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হন এবং আহত হন ৩০০-রও বেশি মানুষ, যার মধ্যে নারী ও শিশুরাও রয়েছে।
এই হামলা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বরং এটি যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল জোটের বৃহত্তর কৌশলের অংশ, যার লক্ষ্য হলো সুয়েজ খাল থেকে হরমুজ প্রণালী পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যের প্রধান ভূ-রাজনৈতিক ও জ্বালানি করিডোরগুলোর ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান কৌশল একদিকে যেমন ইরানের প্রভাব খর্ব করতে চায়, তেমনি পুরো অঞ্চলকে তার নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক কাঠামোর অধীন আনতে চায়।
এই সামরিক অভিযান এমন সময় সংঘটিত হলো, যখন যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান আনুষ্ঠানিকভাবে পারমাণবিক আলোচনা চালাচ্ছিল। একদিকে কূটনৈতিক সংলাপ, আর অন্যদিকে নিখুঁত সামরিক হামলা—এই দ্বিচারিতা আন্তর্জাতিক কূটনীতির প্রতি এক রূঢ় অবজ্ঞার ইঙ্গিত দেয়। অভিযানের পরপরই সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই হামলাকে “চমৎকার” বলে প্রশংসা করেন এবং হুমকি দেন, “এটি কেবল শুরু”। তাঁর এমন উক্তি শুধু ইসরায়েলের প্রতি তাঁর অন্ধ সমর্থনই নয়, বরং পুরো মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন আগ্রাসনের রূপরেখাও তুলে ধরে।
ইরানও পাল্টা জবাব দিতে দেরি করেনি। ‘অপারেশন ট্রু প্রমিস থ্রি’ (Operation True Promise III) নামে ইরান একযোগে ১৫০টিরও বেশি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন নিক্ষেপ করে তেলআবিব ও জেরুজালেমের উদ্দেশ্যে। যদিও যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল যৌথ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (Iron Dome ও Patriot systems) অধিকাংশ হামলা প্রতিহত করে, তবুও কিছু ক্ষেপণাস্ত্র ঢুকে পড়ে, যার ফলে তিনজন সাধারণ মানুষ নিহত হন এবং অনেক আহত হন। ইসরায়েলের সামরিক ঘাঁটিও এই হামলায় লক্ষ্যবস্তু হয়।
এইসব ঘটনার পটভূমিতে চীন ও রাশিয়ার ভূমিকা তুলনামূলকভাবে সতর্ক ও প্রতিক্রিয়াশীল। দুই পরাশক্তিই সাম্প্রতিক হামলার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে, তবে তা কেবল বিবৃতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। চীন, যার মধ্যপ্রাচ্যে বহু বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ রয়েছে (বিশেষত বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের মাধ্যমে), প্রকাশ্যে হামলার নিন্দা করলেও, ইরান ও ইসরায়েল উভয়ের সঙ্গেই সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। ইসরায়েলের প্রযুক্তি খাতে চীনের বিনিয়োগ ইতোমধ্যে ১৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। তাই বেইজিং এই সংঘাতে সরাসরি জড়াতে চায় না—বরং তারা নিজেকে মধ্যস্থতাকারী ও সমন্বয়কের ভূমিকায় দেখতে চায়।
রাশিয়া তুলনামূলকভাবে বেশি সরব। সিরিয়া ও ইরানের সঙ্গে রাশিয়ার কৌশলগত ও সামরিক সম্পর্ক পুরোনো। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার সামরিক সম্পদ সীমিত হলেও তারা ইরানকে অস্ত্র, গোয়েন্দা তথ্য এবং কূটনৈতিক সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। তবে রাশিয়াও এখন পর্যন্ত সরাসরি কোনো সামরিক হস্তক্ষেপে যায়নি।
এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল জোট যখন মধ্যপ্রাচ্যে আগ্রাসী ভূমিকায় অবতীর্ণ, তখন চীন ও রাশিয়া এখনো কৌশলগতভাবে নিজ নিজ জায়গায় অবস্থান করছে—দর্শকের ভূমিকায়, প্রতিপক্ষ নয়। এই অসম প্রতিক্রিয়াই নতুন একটি ভৌগোলিক ভারসাম্যহীনতার সূচনা করেছে।
এদিকে, মধ্যপ্রাচ্যের অন্য একটি ফ্রন্ট—গাজা—তীব্র রক্তপাতের সাক্ষী হয়ে উঠেছে। ইসরায়েলি বাহিনী সেখানে একের পর এক বিমান হামলা চালিয়ে শত শত শিশু, নারী ও সাধারণ মানুষকে হত্যা করেছে। নেটানিয়াহু ও ট্রাম্পের যৌথ বিবৃতিতে স্পষ্ট হয়েছে যে, তারা চূড়ান্তভাবে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড দখলের দিকে এগোতে চায়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যখন ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত, তখন গাজার ধ্বংসযজ্ঞ প্রায় অনুল্লেখিত থেকে যাচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপটে, প্রশ্ন উঠছে—চীন ও রাশিয়া কি সত্যিই প্রস্তুত একটি বহুপোলার বিশ্ব গড়তে, নাকি তারা কেবল প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি হিসেবেই থেকে যাবে? আজকের ভূ-রাজনীতির নতুন বাস্তবতা হচ্ছে, অস্ত্র, আগ্রাসন ও অর্থনৈতিক জোটবদ্ধতার মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একতরফাভাবে পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে পুনর্গঠন করতে চায়। আর যদি চীন ও রাশিয়া এখনই কার্যকর কৌশলগত উদ্যোগ না নেয়, তবে তাদের "মাল্টিপোলার ওয়ার্ল্ড" ধারণা কেবল তাত্ত্বিক পরিভাষাতেই রয়ে যাবে।
অপারেশন রাইজিং লায়ন এবং অপারেশন ট্রু প্রমিস থ্রি—এই দুটি অভিযানের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়েছে, মধ্যপ্রাচ্য এখন আর প্রথাগত কূটনীতির ক্ষেত্র নয়, বরং এটি এক ভয়াবহ যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে, যেখানে ভবিষ্যতের ভারসাম্য নির্ধারিত হচ্ছে রক্ত, বোমা ও বল প্রয়োগের মাধ্যমে।
এখন সময়, বিশ্ব নেতারা প্রশ্ন তুলুক:-এই সংঘাত কি নতুন শীতল যুদ্ধের রূপরেখা তৈরি করছে?নাকি এখনো সময় আছে বৈশ্বিক সংযম ও কূটনৈতিক নেতৃত্বের মাধ্যমে মানবিক ও ভূ-রাজনৈতিক বিপর্যয় ঠেকানোর?
পাঠকের মতামত:
আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ
- ভবিষ্যতের গণতন্ত্র না পুরাতনের পুনরাবৃত্তি? ইউনুস-তারেক সাক্ষাৎ পর্যালোচনা
- শেয়ারবাজারে এল বড় সুখবর!
- স্টারমারের নীরবতা: কূটনৈতিক শিষ্টাচার বনাম রাজনৈতিক সংকোচ
- রিজার্ভের দাপট: বিদ্যুৎ খাতের ১৪ কোম্পানি বিনিয়োগের নতুন ঠিকানা
- ইউনূস-তারেক ঐতিহাসিক ও সফল বৈঠক: সংস্কার, একতা ও ন্যায়বিচার— এই তিন স্তম্ভে গড়ে উঠুক নতুন বাংলাদেশ
- নারায়ণগঞ্জে বিএনপি নেতার বাড়িতে সেনা অভিযান:উদ্ধার ইয়াবা ও ধারালো অস্ত্র!
- দ্বিতীয় দিনেও চলছে কোরবানি, কসাই না পাওয়ায় আজ জবাই অনেকের
- তিন মাসেই যে ১০ বেসরকারি ব্যাংকে ৩২ হাজার কোটি টাকার আমানত বৃদ্ধি!
- তারেক রহমানের দেশেফেরার সম্ভাব্য সময় জানালেনমির্জা ফখরুল
- তারেক-ইউনূস বৈঠক: উত্তপ্ত রাজনীতিতে সম্ভাব্য টার্নিং পয়েন্ট?
- উত্তর-পূর্ব ভারতের ক্ষোভ কি ভারতের কেন্দ্রীয় কূটনীতি পাল্টাবে?
- লন্ডনে তারেক-ইউনূসের বৈঠকের পরে পর পর ২টি স্ট্যাটাসে কি বললেন পিনাকী?
- সাক্ষাৎ চাইলেন শেখ হাসিনার ভাগ্নি, মুখ ফিরিয়ে নিলেন ড. ইউনূস
- ডিএসইতে সাধারণ বীমা খাতের প্রান্তিক বিশ্লেষণ:মুনাফা বৃদ্ধির শীর্ষে কারা?
- তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে যা বললেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা