দ্য গার্ডিয়ানের সাথে সাক্ষাৎকার
“মানুষ এখনো সরকারকে শত্রু ভাবে” — প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস

এক বছর পেরিয়ে গেছে সেই ঐতিহাসিক ছাত্র-জনতার জাগরণ, যা দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করে প্রবাসে পাঠিয়ে দেয়। সেই আন্দোলনের পথ বেয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব নেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এখন, আন্দোলনের এক বছর পরে, তিনি বলছেন—"এই দেশের মানুষ এখনো সরকারকে তাদের শত্রু মনে করে"।
দ্য গার্ডিয়ানকে দেওয়া এক বিশদ সাক্ষাৎকারে ইউনূস বলেন, রাষ্ট্র এবং জনগণের মধ্যে সম্পর্ক এতটাই বিষাক্ত হয়ে উঠেছে যে মানুষ সরকারের কাছে সুযোগ বা সেবা প্রত্যাশা করে না, বরং নিরাপদ দূরত্বে থাকতে চায়। তার ভাষায়, "সরকার যেন এক সর্বগ্রাসী শত্রু; যাকে মোকাবেলা না করে, এড়িয়ে চললেই বাঁচা যায়।"
আন্দোলনের প্রেক্ষাপট: কোটা সংস্কার থেকে গণআন্দোলনে রূপান্তর
২০২৪ সালের জুন-জুলাই মাসে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে শিক্ষার্থী ও তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বে যে আন্দোলন গড়ে ওঠে, তার সূচনা হয়েছিল সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতির সংস্কারের দাবিতে। কোটা সুবিধা দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগপন্থী সংগঠন ও ব্যক্তিদের জন্য রক্ষা করা হচ্ছিল বলে অভিযোগ ওঠে, যা সমতার নীতির পরিপন্থী বলে শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল।
কিন্তু অল্প সময়েই এই দাবির বাইরে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে—জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি, তরুণদের জন্য চাকরির সংকট, দুর্নীতির ব্যাপকতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ, এবং একটি স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে জনগণের সামগ্রিক ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হয়ে ওঠে।
একপর্যায়ে, সেনাবাহিনী নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়ে রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য মঞ্চ তৈরি করে। আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায় ঘটে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয় প্রয়োজনে সম্মতিতে। এর নেতৃত্বে আসেন ড. ইউনূস, যাকে তখন পর্যন্ত বিতর্কিত ও প্রশংসিত দুই চরিত্রেই দেখা হচ্ছিল।
রাষ্ট্রব্যবস্থার অবক্ষয় ও জনগণের বিচ্ছিন্নতা
সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস বলেন, প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে এমনভাবে দুর্নীতি ও সুবিধাবাদ জেঁকে বসেছিল যে, জনগণের মনে সরকারের প্রতি স্থায়ী অনাস্থা তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন,
"পাসপোর্ট বানাতে চাইলে টাকা লাগে, ব্যবসা শুরু করতে চাইলে ঘুষ লাগে, এমনকি গরিব কৃষক যদি তার জমির দলিল হালনাগাদ করতে চায়, সেখানেও তাকে কারও পকেট ভারী করে দিতে হয়।"
"মানুষ মনে করে সরকার মানেই হয়রানি, সরকার মানেই শোষণ। এমন বাস্তবতায় রাষ্ট্র আর নাগরিকের সম্পর্কটা একটা যুদ্ধের মতো মনে হয়।"
তিনি আরও বলেন, এই অবিশ্বাস কাটাতে হলে শুধুমাত্র ব্যক্তি পরিবর্তন নয়, চাই পদ্ধতিগত সংস্কার। এবং সেটাই অন্তর্বর্তী সরকারের মূল লক্ষ্য।
অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ: সংস্কার কমিশন ও 'জুলাই সনদ'
ড. ইউনূস জানান, তার সরকার প্রথম ছয় মাসেই নির্বাচন ব্যবস্থা, প্রশাসন, দুর্নীতি দমন এবং সামাজিক সুরক্ষা নিয়ে চারটি সংস্কার কমিশন গঠন করে। এসব কমিশন জানুয়ারি ২০২৫-এ সুপারিশ জমা দেয়। সেই সুপারিশের ভিত্তিতে একটি ঐকমত্যের নীতিপত্র তৈরি হচ্ছে, যার নাম 'জুলাই সনদ'।
এই সনদে যে কয়েকটি মূল বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তা হচ্ছে: নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা ও পুনর্গঠন, প্রধানমন্ত্রী এবং সংসদ সদস্যদের জন্য মেয়াদ সীমা, দুর্নীতির জন্য স্বাধীন 'জাতীয় অডিট আদালত', ডিজিটাল আইনের সংস্কার এবং বাকস্বাধীনতা রক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর প্রসার এবং রাজনৈতিক দলগুলোর অর্থায়নে স্বচ্ছতা।
ড. ইউনূস চান, ২০২৫ সালের জুলাই মাসের মধ্যেই এই সনদ চূড়ান্ত হোক এবং এপ্রিলের নির্বাচনের আগে তা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু করা সম্ভব হোক।
রাজনৈতিক সমঝোতা ও বাধা
সংসদীয় রাজনীতিতে বর্তমানে সবচেয়ে শক্তিশালী দল হচ্ছে বিএনপি। আন্দোলনের সময় তারা মাঠে সক্রিয় না থাকলেও, আওয়ামী লীগের পতনের পর তাদের জনপ্রিয়তা বাড়ে।
বিএনপি আগাম নির্বাচনের দাবি করছে এবং 'দুই মেয়াদে প্রধানমন্ত্রিত্ব' সীমার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। তবে ইউনূস বলছেন,
"এই দেশে আগে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনো কনসেন্সাস ছিল না। এখন অন্তত সবাই টেবিলে বসছে, কথা বলছে। এটা ছোট অর্জন নয়।"
তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, এই ঐকমত্য ধরে রাখা এবং তা লিখিত রূপ দেওয়া হবে আসল পরীক্ষা।
অর্থনীতি ও সামাজিক ব্যবসা: মাইক্রোক্রেডিট মডেল পুনর্গঠন
ড. ইউনূস তার বহু প্রশংসিত মাইক্রোক্রেডিট মডেলকে আরও প্রতিষ্ঠিত করতে চান একটি নতুন কাঠামোর মধ্য দিয়ে। বর্তমানে এনজিওরাই ক্ষুদ্রঋণ সেবা দেয়। কিন্তু তিনি চান মাইক্রোফাইন্যান্স ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হোক, যা অলাভজনকভাবে গরিব মানুষের ব্যবসায়িক উদ্যোগে সহায়তা করবে।
তিনি বলেন,
"অনেকে এখন মাইক্রোক্রেডিটকে বলছে শোষণের মাধ্যম। কারণ, কিছু প্রতিষ্ঠান উচ্চ সুদে ঋণ দিচ্ছে। আমি বলছি, এটি একটি দুর্দান্ত সামাজিক মডেল, এবং এটি বিশ্বব্যাপী কপি করা হয়েছে। সমস্যা নয়, বরং এটি সমাধান।"
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও বিদায়ের প্রস্তুতি
ড. ইউনূস বলেছেন, তিনি নির্বাচনের পর আর সরকারের অংশ হতে চান না। তার ভাষায়,
"আগে শুধু আওয়ামী লীগ আমাকে গালাগাল দিত, এখন সবাই দেয়। এটা এই পদে থাকলে স্বাভাবিক। কিন্তু আমার কাজ হচ্ছে একটা ভিত্তি তৈরি করে দেওয়া, যাতে আমরা একটা সুস্থ, স্থিতিশীল রাষ্ট্রের দিকে যাত্রা শুরু করতে পারি।"
তিনি বলেন, নির্বাচনের মাধ্যমে যদি একটি গ্রহণযোগ্য সরকার আসে এবং 'জুলাই সনদ' কার্যকর হয়, তবে তবেই শুরু হবে 'নতুন বাংলাদেশের' বাস্তব পথচলা।
একটি যুগান্তকারী সন্ধিক্ষণ
বাংলাদেশের ইতিহাসে ২০২৪-২৫ সাল একটি যুগান্তকারী সময়। গণজাগরণ, ক্ষমতা পরিবর্তন, এবং একটি অভূতপূর্ব অন্তর্বর্তীকালীন শাসনের পথচলা আজ ঐতিহাসিক পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। ড. ইউনূসের নেতৃত্বে এই সরকার যদি রাজনৈতিক ঐকমত্য, প্রশাসনিক সংস্কার, এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠার ভিত্তি রেখে যেতে পারে, তাহলে ২০২৫ সালের নির্বাচন শুধু নতুন সরকারের সূচনা নয়, এক নতুন রাষ্ট্রচিন্তারও সূচনা হবে।
আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ
- শেয়ারবাজারে এল বড় সুখবর!
- স্টারমারের নীরবতা: কূটনৈতিক শিষ্টাচার বনাম রাজনৈতিক সংকোচ
- কবে থামবে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিভেদের রাজনীতি?
- রিজার্ভের দাপট: বিদ্যুৎ খাতের ১৪ কোম্পানি বিনিয়োগের নতুন ঠিকানা
- নারায়ণগঞ্জে বিএনপি নেতার বাড়িতে সেনা অভিযান:উদ্ধার ইয়াবা ও ধারালো অস্ত্র!
- দ্বিতীয় দিনেও চলছে কোরবানি, কসাই না পাওয়ায় আজ জবাই অনেকের
- তিন মাসেই যে ১০ বেসরকারি ব্যাংকে ৩২ হাজার কোটি টাকার আমানত বৃদ্ধি!
- তারেক-ইউনূস বৈঠক: উত্তপ্ত রাজনীতিতে সম্ভাব্য টার্নিং পয়েন্ট?
- তারেক রহমানের দেশেফেরার সম্ভাব্য সময় জানালেনমির্জা ফখরুল
- উত্তর-পূর্ব ভারতের ক্ষোভ কি ভারতের কেন্দ্রীয় কূটনীতি পাল্টাবে?
- সাক্ষাৎ চাইলেন শেখ হাসিনার ভাগ্নি, মুখ ফিরিয়ে নিলেন ড. ইউনূস
- ডিএসইতে সাধারণ বীমা খাতের প্রান্তিক বিশ্লেষণ:মুনাফা বৃদ্ধির শীর্ষে কারা?
- তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে যা বললেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
- লন্ডনে তারেক-ইউনূসের বৈঠকের পরে পর পর ২টি স্ট্যাটাসে কি বললেন পিনাকী?
- আবদুল হামিদের দেশে ফেরা: স্বপ্ন না বাস্তব? সারজিস আলম যা বললেন