পশ্চিমাদের বুকে ভয় ধরানো কে এই ইব্রাহিম ট্রাউরে?

২০২৫ জুন ০৩ ২১:৩৭:৪৭
পশ্চিমাদের বুকে ভয় ধরানো কে এই ইব্রাহিম ট্রাউরে?

বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৬ হাজার মাইল দূরের পশ্চিম আফ্রিকার ছোট একটি দেশ বুরকিনা ফাসো আজ আন্তর্জাতিক রাজনীতির আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। কারণ একটাই, এই দেশের সেনানায়ক প্রেসিডেন্ট ক্যাপ্টেন ইব্রাহিম ট্রাউরে। মাত্র ৩৪ বছর বয়সে ২০২২ সালে সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার পর তিনি যেন হয়ে উঠেছেন আফ্রিকার নতুন ‘বিপ্লবী মুখ’। একদিকে ফ্রান্সের মতো ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান, অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় সম্পদের পুনর্দখল—সব মিলিয়ে ট্রাউরের নেতৃত্ব যেন এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

ইব্রাহিম ট্রাউরে ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট লেফটেন্যান্ট-কর্নেল পল-হেনরি দামিবাকে উৎখাত করেন। দামিবাও মাত্র আট মাস আগে আরেকজন প্রেসিডেন্টকে সরিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন। এই টানা অভ্যুত্থান চক্রের পেছনে প্রধান ইস্যু ছিল—দেশের ৪০% এলাকা আইএস ও আল-কায়েদা সংশ্লিষ্ট মিলিশিয়াদের দখলে চলে যাওয়া। এই ব্যর্থতার সুযোগ নিয়ে ক্ষমতায় এসে ট্রাউরে বলেন,

“আমরা এমনটা চাইনি, কিন্তু আমাদের কোনো বিকল্প ছিল না।.”

ক্ষমতায় এসেই ট্রাউরে একটি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন—এই দেশ আর পশ্চিমাদের খেলার মাঠ নয়। তিনি ফ্রান্সের সঙ্গে সব সামরিক সম্পর্ক ছিন্ন করেন এবং তাদের সৈন্যদের দেশে ফেরত পাঠান। একইসাথে রাশিয়ার সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। এমনকি রাশিয়ান প্যারামিলিটারি ফোর্সও বুরকিনা ফাসোতে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে শুরু করেছে।

বুরকিনা ফাসো আফ্রিকার অন্যতম সোনার ভাণ্ডার। এতদিন পশ্চিমা কোম্পানিগুলো অত্যন্ত কম মূল্যে ও অস্বচ্ছ চুক্তিতে এখান থেকে সম্পদ আহরণ করত। ট্রাউরে এসে এই খাতে বড় রকমের সংস্কার এনেছেন। এখন থেকে বিদেশি কোম্পানিগুলোকে ১৫% স্টেক রাষ্ট্রায়ত্ব কোম্পানিকে দিতে হবে এবং স্থানীয় জনগণকে প্রশিক্ষণ দিয়ে যেতে হবে। এই নিয়ম রাশিয়ান কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি পশ্চিমা কোম্পানির মাইনিং লাইসেন্স বাতিল করে খনিগুলো জাতীয়করণ করা হয়েছে।

ট্রাউরে শুধু বিদেশি আগ্রাসন নয়, দেশের ভেতরেও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছেন। তাঁর সরকারের অধীনে দুর্নীতির বিচারগুলো জনসমক্ষে প্রচার করা হচ্ছে, যা নাগরিকদের মধ্যে এক ধরণের আস্থা তৈরি করছে।

ট্রাউরে খাদ্য রপ্তানি নিষিদ্ধ করে দেশকে স্বনির্ভর করার ঘোষণা দিয়েছেন। কৃষকদের ফ্রি ট্রাক্টর দিচ্ছেন এবং ভাতসহ প্রধান খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়াতে গুরুত্ব দিচ্ছেন।

সম্প্রতি তিনি বুরকিনা ফাসোর প্রথম রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংক "বুরকিন লিমন" চালু করেছেন। এতদিন এই দেশে কোনো সরকারি ব্যাংক না থাকাটা ছিল অর্থনৈতিক দারিদ্র্যের প্রতীক। এই ব্যাংক অর্থনীতিকে নতুন দিক দেখাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বুরকিনা ফাসো, মালি এবং নাইজার মিলে গঠন করেছে ‘আলায়েন্স অফ সাহেল স্টেটস’। এই জোট পশ্চিমা প্রভাবিত ইকোয়াস থেকে বেরিয়ে এসেছে এবং এখন ব্রিক্সে যোগদানের চেষ্টা করছে। এটি স্পষ্টভাবে পশ্চিমা আধিপত্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার ইঙ্গিত দেয়।

তবে ট্রাউরে একজন বিতর্কিত নেতা। তাঁর সরকারের অধীনে মত প্রকাশের স্বাধীনতা অনেকটাই সংকুচিত হয়েছে। প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে কথা বললে জেল পর্যন্ত হতে পারে। এই দিক থেকে তাঁকে ‘স্বৈরাচারী’ বলেও আখ্যা দিচ্ছেন অনেকে। ফলে প্রশ্ন উঠছে—এই স্বপ্নিল বিপ্লবের শেষ গন্তব্য কি বাস্তব উন্নয়ন, নাকি আরেক স্বৈরশাসকের জন্ম?

ইব্রাহিম ট্রাউরে পশ্চিমা দৃষ্টিকোণে 'ঝুঁকিপূর্ণ' এক নেতা। তবে আফ্রিকার বহু সাধারণ নাগরিকের কাছে তিনি এখন ‘হিরো’। তাঁর সাহসী অবস্থান, নিজস্ব সম্পদ রক্ষা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনসমক্ষে যুদ্ধ এবং খাদ্য-নিরাপত্তায় পদক্ষেপ তাঁকে জনপ্রিয় করে তুলেছে। তবে তাঁর সরকার কতটুকু টিকে থাকতে পারবে এবং এই সকল উদ্যোগ বাস্তবায়নে কতটা সফল হবে, সেটা সময়ই বলে দেবে।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

আমেরযত কাহিনি

আমেরযত কাহিনি

নিজস্ব প্রতিবেদক: স্বাদ, গন্ধ ও পুষ্টিগুণে পরিপূর্ণ ‘আম’ শুধু একটি ফল নয়, বরং এটি ইতিহাস, সংস্কৃতি ও অর্থনীতিতে গভীরভাবে প্রোথিত এক... বিস্তারিত