বিশেষ প্রতিবেদন

স্বাস্থ্য কূটনীতিতে নীরব বিপ্লব: ভারতীয় ভিসা বন্ধ ও চীনের উষ্ণ অভ্যার্থনা

রাজনীতি ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুন ০১ ১৬:৫৮:১৪
স্বাস্থ্য কূটনীতিতে নীরব বিপ্লব: ভারতীয় ভিসা বন্ধ ও চীনের উষ্ণ অভ্যার্থনা

ভোরের আলো ফোটার আগেই ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর যেন যেনো অন্য রকম এক ব্যস্ততা ধারণ করে। বহু মানুষের হাতে ধরা ওষুধের প্রেসক্রিপশন, রোগ নির্ণয়ের রিপোর্ট আর সঙ্গে পাসপোর্ট। শত শত মানুষ দাঁড়িয়ে আছে টিকিট কাউন্টারে। একসময় এই দৃশ্য মানেই হতো—তাদের গন্তব্য কলকাতা, দিল্লি কিংবা চেন্নাইয়ের কোনো আধুনিক হাসপাতাল। কিন্তু এবার নয়। এবার তাদের যাত্রাপথ ভিন্ন—কোনমিং, সাংহাই, শেনজেন কিংবা বেইজিংয়ের দিকে। চিকিৎসার প্রয়োজনে বাংলাদেশিদের প্রধান গন্তব্য এখন আর ভারত নয়, তা হয়ে উঠছে চীন।

এই পরিবর্তন কেবল হাসপাতাল বা শহরের নামের পরিবর্তন নয়। এটি একটি বৃহৎ কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতার প্রতিফলন। যার নেপথ্যে রয়েছে সময়োপযোগী, বুদ্ধিদীপ্ত, কিন্তু নিঃশব্দ এক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত—যার স্থপতি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনুস। তাঁর এক নিঃশব্দ কিন্তু কৌশলপূর্ণ আন্তর্জাতিক সফর বাংলাদেশের চিকিৎসা ভ্রমণ নীতিতে ঐতিহাসিক পরিবর্তন এনে দিয়েছে।

৫ আগস্ট: দক্ষিণ এশিয়ার কূটনৈতিক ভারসাম্যে এক মোড়বদল

বাংলাদেশের রাজনৈতিক পালাবদলের প্রেক্ষিতে ভারত সরকার হঠাৎ করে মেডিকেল ভিসা বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়। সরকারিভাবে বলা হয়—ভারতের ভিসা সিস্টেমে ‘প্রযুক্তিগত আপডেট’ চলছে। কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। এটি ছিল একপ্রকার কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগের কৌশল। ভারতের ধারণা ছিল, নতুন প্রশাসনের ওপর প্রভাব বিস্তার এবং নিজেদের বলয় টিকিয়ে রাখার এটাই সুযোগ।

কিন্তু ঘটনাবলির মোড় ঘুরে যায় দ্রুত। ভারত হয়তো বুঝতে পারেনি যে, তার এই সিদ্ধান্ত একটি বিশাল বাজার হাতছাড়া করার দিকেও ধাবিত করছে তাকে। আর ঠিক এই সুযোগটি কাজে লাগান প্রফেসর ইউনুস। আনুষ্ঠানিকতা না দেখিয়ে সরাসরি পাড়ি জমান চীনের কোনমিং শহরে, যেখানে একটি আন্তর্জাতিক চিকিৎসা সম্মেলনে অংশ নেন তিনি। সেখানে তিনি ব্যক্তিগতভাবে চীনের স্বাস্থ্যমন্ত্রকের শীর্ষ পর্যায়ের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে বৈঠক করেন।

বৈঠকে প্রফেসর ইউনুস বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের চিকিৎসা দুর্ভোগ, ভারতে চিকিৎসার উপর নির্ভরতা এবং নতুন বিকল্পের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। চীন, যার আন্তর্জাতিক নীতি সফট পাওয়ার ও কৌশলগত সেবাভিত্তিক বন্ধুত্বের উপর দাঁড় করানো, তৎক্ষণাৎ বাংলাদেশের ডাকে সাড়া দেয়।

দ্রুত প্রতিক্রিয়া: ‘গ্রীন চ্যানেল’ নামে চীনের ভিসা বিপ্লব

চীন আর দেরি করেনি। ঢাকায় চীনা দূতাবাস তড়িঘড়ি করে চালু করে ‘মেডিকেল গ্রীন চ্যানেল ভিসা’ ব্যবস্থা। এখন আর রোগীদের জন্য দীর্ঘ কাগজপত্র বা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুপারিশপত্রের দরকার নেই। নির্দিষ্ট অনুমোদিত ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমেই ব্যাংক সার্টিফিকেট, গ্যারান্টি পত্রসহ পুরো প্রক্রিয়া শেষ করা যায়।

চীনা ভিসা সেন্টারে আলাদা মেডিকেল কাউন্টার খোলা হয়েছে। যেখানে একদিনেই ভিসা দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ রোগীদের জন্য জরুরি ভিত্তিতে একই দিনে ভিসা দিচ্ছে দূতাবাস। এমনকি অনলাইনে ভিডিও ইন্টারভিউর মাধ্যমে যারা ঢাকায় উপস্থিত হতে পারছেন না, তারাও পাচ্ছেন এই সেবা। যা আগে কল্পনাও করা যেত না।

ভারতের জন্য অর্থনৈতিক বিপর্যয়: স্বাস্থ্য বাজার হারানোর যন্ত্রণা

বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে দুই লক্ষেরও বেশি রোগী ভারতে চিকিৎসার জন্য যেতেন। একজন রোগীর গড় খরচ হতো ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা। চিকিৎসা খাত, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, ফার্মেসি, পরিবহনসহ বিভিন্ন খাতে বাংলাদেশের রোগীরা ভারতের অর্থনীতিতে অবদান রাখতেন বছরে প্রায় ৮ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা।

কিন্তু ভিসা বন্ধের পর ভারতের হাসপাতালগুলোর বাংলা হেল্প ডেস্ক গুটিয়ে ফেলা হচ্ছে, ঢাকাস্থ কনসালটেন্ট অফিসগুলো বন্ধ হচ্ছে। বাংলাদেশিদের জন্য তৈরি হওয়া সম্পর্কগুলো বিলীন হয়ে যাচ্ছে। চেন্নাই, দিল্লি, কলকাতার নামী হাসপাতালগুলো এখন একে একে বাংলাদেশি রোগীদের হারাচ্ছে—এবং সঙ্গে সঙ্গে হারাচ্ছে লাভজনক একটি বাজার।

চীনের পদক্ষেপ: উদারতা নয়, কৌশলগত বন্ধুত্ব

চীন জানে—চিকিৎসা একটি আবেগসম্পৃক্ত খাত। রোগীকে চিকিৎসা দেয়ার মাধ্যমে শুধু অর্থনৈতিক সম্পর্কই তৈরি হয় না, গড়ে ওঠে মানুষের মনের ভেতর গভীর আস্থা ও কৃতজ্ঞতার বন্ধন। এই ‘স্নেহ কূটনীতি’ বা humanitarian diplomacy-র সুবিধা নিতে চীন এগিয়ে এসেছে আরও বড় ঘোষণার মাধ্যমে।

প্রফেসর ইউনুসের অনুরোধে চীনের কোনমিং শহরের চারটি আধুনিক হাসপাতাল নির্দিষ্ট করা হয়েছে বাংলাদেশি রোগীদের জন্য। পাশাপাশি তারা ঘোষণা দিয়েছে—বাংলাদেশে তিনটি আধুনিক হাসপাতাল নির্মাণ করবে চীনের অনুদানে, যার মধ্যে একটি হবে ১,০০০ শয্যার পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসাকেন্দ্র।

চিকিৎসা খাতে এই বিনিয়োগ নিছক দান নয়। বরং এটি একটি কৌশলগত দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক নির্মাণের পথ।

বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের নতুন অধ্যায়

চীন এখন শুধু চিকিৎসা নয়, বরং বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথভাবে ক্যান্সার গবেষণা, হৃদরোগ চিকিৎসা, ডিজিটাল হাসপাতাল ম্যানেজমেন্ট, এবং মেডিকেল টেকনোলজি খাতে কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এরই মধ্যে চীনের হাসপাতালগুলোতে বাংলাদেশি দোভাষী, বাংলা ভাষায় সাইনবোর্ড, হালাল খাবার ব্যবস্থা, পর্যবেক্ষণ সহায়তা ডেস্ক চালুর কাজ শুরু হয়েছে।

এর ফলে, বাংলাদেশিরা যে আত্মবিশ্বাস, পরিচিতি ও সম্মানজনক সেবা এতদিন ভারতের বড় শহরে পেতেন—তা এবার তারা চীনেও পাবেন। আর তা হবে আরও সাশ্রয়ী, দ্রুত এবং সম্মানজনক।

অপমানের উত্তরে কৌশলের শক্ত জবাব

অনেকেই ভেবেছিলেন ভারতীয় ভিসা বন্ধের সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশের সাধারণ রোগীদের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছাবে। কিন্তু প্রফেসর ইউনুস প্রমাণ করলেন—সফট পাওয়ার ও কৌশলনির্ভর কূটনীতি দিয়েই কীভাবে একটি দেশের দুর্বলতা বদলে দেওয়া যায় সম্ভাবনায়।

ভারত যে জায়গায় বাংলাদেশের অভিমানে আঘাত দিয়েছিল, সেখানে বাংলাদেশ কৌশলগতভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে সাড়া দিল নতুন বিকল্প দিয়ে। চিকিৎসা খাত যা এতদিন ভারতের নিয়ন্ত্রণে ছিল, সেটিই এখন চীনের পরিপক্ব, পরিপাটি ও সুসংহত সফট পাওয়ার কৌশলের অধীনে চলে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের জন্য এই পরিবর্তন কেবল একটি চিকিৎসা গন্তব্য বদলের ঘটনা নয়—এটি এক নতুন ভূ-কৌশলগত অভিমুখে যাত্রার সূচনা।

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধ: বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং ভবিষ্যৎ প্রতিযোগিতা

চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধ: বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং ভবিষ্যৎ প্রতিযোগিতা

বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে, এবং এই পরিবর্তনটির মূল কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান বাণিজ্যযুদ্ধ।... বিস্তারিত