বিশেষ প্রতিবেদন

চট্টগ্রাম বন্দরে নতুন ভোর: দক্ষিণ এশিয়ার তেলের ‘রাজসিংহাসন’ দখলের পথে বাংলাদেশ?

অর্থনীতি ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ মে ৩১ ১২:১৫:৩২
চট্টগ্রাম বন্দরে নতুন ভোর: দক্ষিণ এশিয়ার তেলের ‘রাজসিংহাসন’ দখলের পথে বাংলাদেশ?

চট্টগ্রাম বন্দরের আকাশে যখন সকাল নামে, তখন এক নতুন উত্তেজনার ছায়া পড়ে কন্টেইনার ইয়ার্ডজুড়ে। বিশাল জাহাজগুলো পণ্য উঠানো-নামানোর ব্যস্ততায় ডুবে, সাইরেনের শব্দে যেন ভবিষ্যতের ইঙ্গিত—সবকিছু আগের মতো থাকছে না। কারণ, এই বন্দর ঘিরেই গঠিত হতে চলেছে এক নতুন ভূ-রাজনৈতিক মানচিত্র। যেখানে বাংলাদেশ আর শুধু একজন দর্শক নয়, বরং এক কৌশলগত খেলোয়াড় হয়ে উঠছে।

বিশ্বজুড়ে যখন তেলভিত্তিক নতুন শক্তির লড়াই শুরু হয়েছে, তখন সৌদি আরবের তেল জায়ান্ট আরামকো বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার ‘তেল হাব’ হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনায় এগিয়ে এসেছে। সৌদির লক্ষ্য—বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরের পাশে একটি আধুনিক তেল পরিশোধনাগার (রিফাইনারি) স্থাপন করা, যেখান থেকে আফগানিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, এমনকি ভারত পর্যন্ত জ্বালানি সরবরাহ করা হবে।

তেলের করিডর: নতুন ভূরাজনৈতিক লড়াই

বিশ্লেষকদের মতে, পারস্য উপসাগরের উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা সৌদিদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তাই তারা নতুন করিডরের সন্ধানে বঙ্গোপসাগরের দিকে ঝুঁকছে—যেখানে চট্টগ্রাম ও পায়রা বন্দর পরিণত হচ্ছে সম্ভাবনাময় বিকল্পে। চীন-মার্কিন উত্তেজনা, ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত সংকটের মাঝে বাংলাদেশ একমাত্র নিরপেক্ষ এবং প্রস্তুত শক্তি হিসেবে বৈশ্বিক নজর কাড়ছে।

চট্টগ্রাম বন্দরের আধুনিকীকরণ, পরিকাঠামোগত উন্নয়ন, দক্ষ জনশক্তি এবং কৌশলগত অবস্থান সব মিলিয়ে বাংলাদেশকে আরামকোর চোখে পরিণত করেছে ‘আদর্শ গন্তব্য’ হিসেবে।

নীতির পরিবর্তন, সম্ভাবনার দ্বার

২০১৬ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে তিনবার এই প্রস্তাব দিয়েছিল আরামকো। কিন্তু তৎকালীন সরকার সেটি ফিরিয়ে দেয়। বিশ্লেষকদের দাবি, ব্যক্তিগত স্বার্থ এবং রাজনৈতিক সংকীর্ণতার বলি হয়েছিল সম্ভাবনাময় এই বিনিয়োগ। তবে দৃশ্যপট বদলেছে ২০২৪ সালের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে।

নতুন সরকার কৌশলগতভাবে চট্টগ্রাম ও পায়রা বন্দরের বিকাশকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক কূটনীতি, আমদানি-রপ্তানি হাব, এবং জ্বালানি খাতকে কেন্দ্র করেই তারা নির্মাণ করছে বাংলাদেশের নতুন অর্থনৈতিক মানচিত্র।

অর্থনীতিতে সম্ভাব্য বিপ্লব

সৌদি আরব বর্তমানে প্রতিদিন ৯০ লাখ ব্যারেল তেল উৎপাদন করে, যা ২০২৭ সালের মধ্যে ১ কোটি ৩০ লাখ ব্যারেলে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে। এই উৎপাদন সক্ষমতা বজায় রাখতে হলে নতুন পরিশোধনাগার অপরিহার্য, আর এখানেই বাংলাদেশের সম্ভাবনা।

চট্টগ্রাম বন্দরে নির্মিত তেল রিফাইনারি শুধু বিদেশে তেল রপ্তানি করবে না, বরং বাংলাদেশকেও সরবরাহ করবে সাশ্রয়ী মূল্যের জ্বালানি। এর ফলে বিদ্যুৎ ও কৃষিখাতসহ অন্যান্য জ্বালানিনির্ভর খাত উপকৃত হবে। বর্তমানে দেশে তেলের দাম ২০২৩ সালের তুলনায় প্রায় ৪০% বেড়েছে—এই বিনিয়োগ সেই চাপও কমাতে পারে।

হারানো সম্ভাবনা ও ভবিষ্যতের নেতৃত্ব

এর আগে দক্ষিণ কোরিয়ার স্যামসা এবং সৌদির একুয়া পাওয়ার বহু বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েও ফিরতে বাধ্য হয়েছিল। এবার সেই ভুল শুধরানোর সুযোগ এসেছে।

চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ, ভারতের ট্রানশিপমেন্ট কৌশল, যুক্তরাষ্ট্রের সমুদ্র নিরাপত্তা—all eyes are now on Bangladesh. আর সৌদি বিনিয়োগ বাস্তবায়িত হলে চট্টগ্রাম বন্দরের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি দ্বিগুণ হারে বাড়তে পারে, যা আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে অতিরিক্ত ২ শতাংশ যোগ করতে পারে বলে ধারণা বিশ্লেষকদের।

প্রশ্ন রয়ে যায়...

এই সম্ভাবনার দ্বার খুলছে বাংলাদেশের জন্য। কিন্তু একটাই প্রশ্ন এখন প্রাসঙ্গিক—এই তেলের সিংহাসনে বাংলাদেশ সত্যিই বসতে পারবে তো? নাকি ইতিহাসের মতো আবারও কারো ছকবাজির শিকার হবে?

চট্টগ্রামের বন্দরে আজ যেটুকু আলো, তা শুধু সূর্যোদয়ের নয়—এক নতুন সম্ভাবনার। সেখানে লেখা আছে—‘তেল’ নয়, ভবিষ্যতের নেতৃত্ব।

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধ: বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং ভবিষ্যৎ প্রতিযোগিতা

চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধ: বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং ভবিষ্যৎ প্রতিযোগিতা

বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে, এবং এই পরিবর্তনটির মূল কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান বাণিজ্যযুদ্ধ।... বিস্তারিত