গরমে সুস্থ থাকার পরামর্শ: গ্রীষ্মকালীন শরীরচর্চা ও সচেতনতা

বাংলাদেশে গ্রীষ্মকাল মানেই প্রচণ্ড গরম ও আর্দ্রতা। এ সময় শরীর থেকে ঘামের মাধ্যমে প্রচুর পানি ও লবণ বেরিয়ে যায়, যার ফলে সহজেই পানিশূন্যতা, হিটস্ট্রোক, খাদ্যবিষক্রিয়া ও ত্বকের নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। এ সময়ে হালকা খাবার, পর্যাপ্ত পানি, বিশ্রাম এবং সূর্য থেকে সুরক্ষা নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের প্রতি বাড়তি খেয়াল রাখা জরুরি। নিচে গ্রীষ্মকালীন সঠিক জীবনযাপন ও স্বাস্থ্যসচেতনতার বিস্তারিত নির্দেশনা তুলে ধরা হলো:

খাদ্যাভ্যাস

হালকা ও সহজপাচ্য খাদ্যগ্রহণ: গরমকালে ভারী, তেল-মসলাযুক্ত খাবারের বদলে হালকা রান্না করা সহজপাচ্য খাবার খাওয়া উচিত। যেমন: শাকসবজি দিয়ে পাতলা ঝোল, ডাল, ছোট মাছ বা পাতলা মুরগির মাংসের ঝোল। ডিম খেতে চাইলে সেদ্ধ খাওয়া উত্তম। ভাজাপোড়া এড়িয়ে চলুন, কারণ এটি হজমে সমস্যা করে এবং শরীরের তাপমাত্রা বাড়ায়।

পুষ্টিকর তাজা ফল ও সবজি: খাদ্যতালিকায় পানিসমৃদ্ধ ফল ও সবজি যেমন তরমুজ, বাঙ্গি, শসা, আনারস রাখা উচিত। এগুলো শরীরকে ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করে এবং পুষ্টি সরবরাহ করে।

সালাদ ও পানীয়: খাবারের সঙ্গে শসা, টমেটো, লেবুর মতো কাঁচা সালাদ খাওয়া যেতে পারে। চিনি ছাড়া ফলের রস ও লেবুর শরবত পান করুন। কোমল পানীয় ও অতিরিক্ত মিষ্টি পানীয় পরিহার করুন। চা ও কফি সীমিত পরিমাণে গ্রহণ করুন।

পানি গ্রহণ ও হাইড্রেশন

প্রচুর পানি পান: প্রতিদিন অন্তত ৮–১২ গ্লাস পানি পান করুন। রোদে কাজ করলে আরও বেশি পানি পান করতে হবে।

পানিশূন্যতার লক্ষণ: প্রস্রাবের রঙ গাঢ় হলুদ হওয়া, মুখ শুকিয়ে যাওয়া বা দুর্বল লাগলে অবিলম্বে স্যালাইন বা লবণ-চিনির মিশ্রণ পান করা উচিত।

হাইড্রেটিং পানীয়: ডাবের পানি, ঘোল, ঠাণ্ডা শরবত, লেবু পানি ইত্যাদি পান করুন। রাস্তার অস্বাস্থ্যকর পানীয় এড়িয়ে চলুন। বাইরে বের হলে সঙ্গে বিশুদ্ধ পানির বোতল রাখুন।

ঘুম ও বিশ্রাম

পর্যাপ্ত ঘুম: প্রতিদিন অন্তত ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমান। দিনে অতিরিক্ত ঘুম এড়িয়ে চলুন। ঘুমের একটি রুটিন অনুসরণ করুন।

ঘুমের প্রস্তুতি: রাতে ঠাণ্ডা পানি দিয়ে গোসল বা অন্তত পা ধুয়ে ঘুমাতে যান। হালকা খাবার খান। ঘুমের আগে দুধ, কলা বা সামান্য মধু সহায়ক হতে পারে।

ঘরের পরিবেশ: ঘরে ফ্যান বা প্রয়োজন অনুযায়ী এয়ার কন্ডিশনার ব্যবহার করুন। জানালায় পর্দা টানুন। সুতির চাদর ব্যবহার করুন।

পোশাক ও বিছানা: হালকা, ঢিলেঢালা ও সুতি পোশাক পরুন। ঘাম শোষণকারী চাদর ও বালিশ কভার ব্যবহার করুন। বিদ্যুৎ না থাকলে ভেজা তোয়ালে ব্যবহার করা যেতে পারে।

ত্বকের পরিচর্যা

সানস্ক্রিন ও সুরক্ষা: বাইরে যাওয়ার আগে SPF ৩০ বা তার বেশি সানস্ক্রিন ব্যবহার করুন। ছাতা ও টুপি ব্যবহার করুন। দুপুর ১২টা থেকে ৩টা পর্যন্ত রোদে না যাওয়াই ভালো।

ত্বক পরিষ্কার রাখা: দিনে দুইবার ফেসওয়াশ দিয়ে মুখ ধুয়ে ফেলুন। বাইরে থেকে এলে হাত, মুখ ও পা পরিষ্কার করুন। ঠাণ্ডা পানি দিয়ে একাধিকবার গোসল করলে ত্বক সতেজ থাকবে।

ময়েশ্চারাইজার ও চুলের যত্ন: হালকা ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করুন। অ্যালোভেরা জেল লাগাতে পারেন। সপ্তাহে ২-৩ বার শ্যাম্পু ও কন্ডিশনার ব্যবহার করুন। চুল হালকা করে বাঁধা ভালো।

পোশাক ও পাউডার: ঢিলেঢালা সুতি জামা পরুন। ট্যালকম পাউডার বা বেবি পাউডার ব্যবহার করে ঘামের জায়গাগুলো শুকনো রাখুন।

ব্যায়াম ও শারীরিক কার্যকলাপ

উপযুক্ত সময়: ব্যায়ামের জন্য ভোর বা সন্ধ্যা উপযুক্ত সময়। দুপুরে ব্যায়াম এড়িয়ে চলুন।

ইনডোর ব্যায়াম: ঘরে দড়ি লাফ, ইয়োগা বা জুম্বা করতে পারেন। হালকা হাঁটাচলা বা শপিং মলে হাঁটা ভালো।

সতর্কতা: ব্যায়ামের আগে ও পরে পানি পান করুন। আরামদায়ক পোশাক পরুন। ব্যায়ামের পর ঠাণ্ডা পানি দিয়ে গোসল করুন।

ছোটখাটো উদ্যোগ: লিফটের বদলে সিঁড়ি ব্যবহার করুন, খাওয়ার পর হাঁটুন, নিরাপদ স্থানে সাঁতার কাটুন।

স্বাস্থ্যঝুঁকি ও প্রতিকার

পানিশূন্যতা ও হিটস্ট্রোক: প্রচুর পানি পান করুন। দুপুরের রোদে না বেরোন। রোদে বের হলে ছাতা বা টুপি ব্যবহার করুন। হিটস্ট্রোক হলে দ্রুত ছায়ায় নিয়ে গিয়ে শরীর ঠাণ্ডা করুন এবং চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন।

খাদ্যে বিষক্রিয়া ও ডায়রিয়া: খাবার ঢেকে রাখুন, বাসি খাবার না খেয়ে ফ্রিজে সংরক্ষণ করুন। রাস্তার খাবার ও বরফ মেশানো পানীয় এড়িয়ে চলুন। ফল-সবজি ভালো করে ধুয়ে খান।

ঘামাচি ও ছত্রাক সংক্রমণ: শরীর শুকনো রাখুন, ঘামে আক্রান্ত স্থানে পাউডার লাগান। আঁটসাঁট পোশাক পরিহার করুন। ছত্রাক হলে অ্যান্টিফাঙ্গাল পাউডার ব্যবহার করুন।

চোখ ও হিট অ্যালার্জি: রোদে চোখ সুরক্ষায় সানগ্লাস ব্যবহার করুন। অ্যালার্জি হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। মাথা ঘোরা বা দুর্বল লাগলে পানি ও লবণ গ্রহণ করুন।

গ্রীষ্মকালে সচেতনতা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে এই কঠিন মৌসুমেও সুস্থ ও সতেজ থাকা সম্ভব। প্রতিদিনের ছোট ছোট অভ্যাসই আপনাকে গরমের কষ্ট থেকে রক্ষা করবে এবং শরীর ও মনকে রাখবে সতেজ।