ব্রিটিশ নীতির ছায়ায় গড়ে ওঠা আরব রাজনীতি

বিশ্ব ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ আগস্ট ০৬ ১৭:৩৩:৫৬
ব্রিটিশ নীতির ছায়ায় গড়ে ওঠা আরব রাজনীতি
ছবি: সংগৃহীত

ওসমানি শাসনের পতনের পর গঠিত আরব রাষ্ট্রগুলোর উদ্দেশ্য আদৌ কি ছিল স্বাধীনতা অর্জন, নাকি পশ্চিমা শক্তির রাজনৈতিক স্বার্থরক্ষা? ইতিহাস বিশ্লেষণে এ প্রশ্ন নতুনভাবে সামনে এসেছে। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ উসামা মাকদিসির এক সাম্প্রতিক নিবন্ধে দাবি করা হয়েছে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর আরব রাষ্ট্রগুলোর উত্থান মূলত ব্রিটিশ ও ফরাসি সাম্রাজ্যবাদীদের কৌশলের অংশ ছিল—যার উদ্দেশ্য ছিল প্রত্যক্ষ উপনিবেশের পরিবর্তে ‘স্থানীয় মুখোশে’ পরোক্ষ শাসন কায়েম করা।

১৯১৮ সালে ব্রিটিশ প্রভাব মধ্যপ্রাচ্যে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এক ব্রিটিশ কর্মকর্তা স্বীকার করেছিলেন—‘পুরোনো কৌশল অচল, নতুন পরিকল্পনায় এগোতে হবে।’ এই নতুন পরিকল্পনার মূল ভিত্তি ছিল, আরবদের ‘মুখোশ’ ব্যবহার করে পশ্চিমাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ নিশ্চিত করা। বাস্তবতা ছিল, এই শাসনের পেছনে ছিল না জনগণের অংশগ্রহণ কিংবা প্রকৃত স্বায়ত্তশাসন।

১৯১৬ সালের সাইক্স-পিকো চুক্তির মাধ্যমে ব্রিটিশ ও ফরাসিরা ওসমানি সাম্রাজ্যের আরব অঞ্চল নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেওয়ার পরিকল্পনা করে। অথচ শরিফ হোসাইন ইবনে আলিকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, ফিলিস্তিনসহ বৃহৎ একটি স্বাধীন আরব রাষ্ট্র গঠনের আশ্বাস দিয়েছিল ব্রিটিশরা। বাস্তবে সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি। বরং ফিলিস্তিনকে ঘিরে ১৯১৭ সালের বেলফোর ঘোষণায় ‘ইহুদি জাতীয় আবাস’ প্রতিষ্ঠার সমর্থন দিয়ে আরবদের সঙ্গে করা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে ব্রিটিশ সরকার।

এমন অবস্থার মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে 'আরব মুখোশ' নামে পরিচিত একটি রাজনৈতিক কাঠামো গড়ে ওঠে, যার মূল লক্ষ্য ছিল—নামমাত্র স্বাধীনতা দিয়ে পরোক্ষ শাসনের মাধ্যমে পশ্চিমা নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা। স্থানীয় শাসকদের চূড়ান্ত আনুগত্য ছিল পশ্চিমা শক্তির প্রতি, যার মধ্যে হাশেমি পরিবার, সৌদি রাজপরিবার ও মিসরের বাদশাহদের নাম উল্লেখযোগ্য।

পরবর্তীতে, ফিলিস্তিনে ইহুদি উপনিবেশ স্থাপন, ব্রিটিশ সমর্থন এবং আরব রাজতন্ত্রের নীরবতা একটি বৃহৎ রাজনৈতিক বিভ্রান্তি তৈরি করে। যদিও ১৯৪৮ সালের নাকবা বা ফিলিস্তিনি জনগণের বিতাড়নের ঘটনার পর মধ্যপ্রাচ্যে কিছু সামরিক বিপ্লব হয়—যেমন মিসরে নাসের ও ইরাকে হাশেমি রাজতন্ত্র পতন—তবু পশ্চিমা আধিপত্যের অবসান ঘটেনি।

১৯৬৭ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটিশদের উত্তরসূরি হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে প্রধান প্রভাবশালী শক্তি হয়ে ওঠে। তখন থেকেই গড়ে ওঠে 'আরব মুখোশ ২.০'—যার বৈশিষ্ট্য হল পশ্চিমা শাসন কাঠামো মেনে চলা, ফিলিস্তিন প্রশ্নে আপোষমূলক নীতি গ্রহণ এবং তেল রাজস্ব পশ্চিমে পুনর্বিনিয়োগ। এই নতুন কাঠামোতেও আরব শাসকেরা ছিলেন পাশের দর্শক অথবা মার্কিন নীতির সঙ্গী।

ক্যাম্প ডেভিড, অসলো চুক্তি এবং সাম্প্রতিক আব্রাহাম অ্যাকর্ড—সবই মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের স্বার্থ রক্ষার প্রক্রিয়া বলে বিশ্লেষকদের মত। এর বিপরীতে, গাজা, লেবানন ও ইয়েমেনের মতো কিছু অঞ্চলে এখনো প্রতিরোধ দেখা যাচ্ছে। তবে যারা নিজেদের অবস্থান পশ্চিমা শক্তির স্বার্থে উৎসর্গ করেছেন, তারা গণতান্ত্রিক চেতনার বিরুদ্ধেও অবস্থান নিচ্ছেন।

ইতিহাসবিদদের মতে, এই ‘আরব মুখোশ’ কখনোই জনগণের জন্য নয়। এটি ছিল একটি চুক্তিভিত্তিক রাজনীতি, যেখানে শাসকরা ছিলেন উপনিবেশবাদের হাতিয়ার। আজকের দিনে, গাজায় চলমান সহিংসতা এবং ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রেক্ষাপটে, এই মুখোশ কতদিন টিকবে, তা সময়ই বলবে। তবে ইতিহাস বলছে—যে কোনো মুখোশের স্থায়িত্ব সীমিত।

সূত্র: মিডল ইস্ট আই

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ