হালিশহরে শতকোটি টাকার সমবায় দুর্নীতি

সারাদেশ ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুলাই ৩০ ১০:৫৭:২১
হালিশহরে শতকোটি টাকার সমবায় দুর্নীতি
ছবি: সংগৃহীত

চট্টগ্রামের হালিশহর এলাকায় বন্দর নগরী বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের নামে বরাদ্দ পাওয়া সরকারি জমিতে ‘সুপার মার্কেট’ নির্মাণ প্রকল্পে বিস্তৃত দুর্নীতি, অর্থ আত্মসাৎ ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে তোলপাড় শুরু হয়েছে। প্রায় তিন দশক ধরে এই প্রকল্পকে ঘিরে একাধিকবার কমিটি পরিবর্তনের আড়ালে গড়ে ওঠে দুর্নীতির জটিল নেটওয়ার্ক, যার মূল হোতা ছিল সমিতির প্রভাবশালী কিছু ব্যক্তি ও ব্যবস্থাপনা কমিটির বিতর্কিত সদস্যরা।

বিষয়টি তদন্তে নামতে বাধ্য হয়েছে বিভাগীয় সমবায় কার্যালয়। চলতি বছরের ২ জুলাই সমবায় উপনিবন্ধক মোহাম্মদ মাহবুবুল হক হাজারীর সই করা এক নোটিসে তদন্ত কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসে। এছাড়া ভুক্তভোগী সদস্যদের দেওয়া অভিযোগের ভিত্তিতে দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) সমান্তরাল তদন্ত শুরু করেছে। এর আগেও জেলা সমবায় কার্যালয়ের অডিট রিপোর্টে অন্তত ১০টি খাতে দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট প্রমাণ উঠে এসেছে।

১৯৮৮ সালে নিবন্ধিত এই সমিতিকে ১৯৯১ সালে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ হালিশহরের জি ও এইচ ব্লকের মধ্যবর্তী স্থানে ০.৯৫ একর জমি বরাদ্দ দেয়, যার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ১০০ কোটি টাকা। প্রাথমিক পরিকল্পনায় ছিল একটি সুপার মার্কেট নির্মাণ এবং সমিতির সদস্যদের মধ্যে দোকান বরাদ্দ দেওয়ার উদ্যোগ। তবে সময়ের ব্যবধানে সদস্য সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে ফেলা হয়, অভিযোগ রয়েছে মোটা অঙ্কের ঘুষ ও অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে এই সদস্য সংখ্যা ২১৯ থেকে ৮০০-তে পৌঁছায়।

সমিতির একাধিক সদস্য জানান, তাদের কাছ থেকে পাঁচ থেকে দশ লাখ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হলেও এসব অর্থ ফান্ডে জমা না হয়ে সরাসরি নেতাদের পকেটে গেছে। একপর্যায়ে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের হালিশহর শাখা থেকে নেওয়া হয় ৫ কোটি টাকার ঋণ। অথচ প্রকল্পের প্রাথমিক বাজেট ছিল ২২ কোটি ৬১ লাখ টাকা, যা ২০০৭ সালে পুনর্মূল্যায়নের মাধ্যমে ৫৮ কোটিতে উন্নীত করা হয়। তবুও প্রকল্পের অগ্রগতি এখনো মাত্র ৬০ শতাংশ।

২০১৬ সালে দোকান না পাওয়ার অভিযোগে ৩০৭ জন সদস্য জেলা সমবায় কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ দেন। গঠিত তদন্ত কমিটি তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হাসানকে ৫ কোটি ৪৯ লাখ টাকা আত্মসাতের জন্য দায়ী করে। সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরের অডিটেও ভয়াবহ আর্থিক অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা এবং প্রকল্পের আর্থিক গরমিলের বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায়।

অডিট রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রকল্পে খরচ দেখানো হয়েছে ৭৪ কোটি ৩১ লাখ ৯৭ হাজার টাকা, কিন্তু এত বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয়ের পরও কোনো সদস্য দোকান বুঝে পাননি। সদস্যদের অভিযোগ, প্রকল্পের বর্তমান সভাপতি সাহাবউদ্দিন ও সম্পাদক ওমর ফারুক অর্থ আত্মসাৎ ও মানি লন্ডারিংয়ের সঙ্গে সরাসরি জড়িত এবং বর্তমানে তারা পলাতক। তাদের অনুসারীরা সাধারণ সদস্যদের হুমকি-ধমকির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে রাখছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

বিশেষ করে সিডিএ অনুমোদিত নকশা লঙ্ঘন করে খোলা জায়গায় অবৈধভাবে স্থাপনা নির্মাণ করে তা বিক্রির মাধ্যমে বড় অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে, যা সমিতির ফান্ডে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। বর্তমানে সমিতির মূল দলিল, সদস্য রেজিস্টার, হিসাব বহি, এমনকি সদস্যদের পরিচয় সংক্রান্ত কোনো নথিও পাওয়া যাচ্ছে না।

একই পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে কমিটি পরিচালিত হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। কখনো বাবা, কখনো ছেলে বা স্ত্রী এই কমিটি পরিবর্তনের ছায়ায় দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে।

অডিট রিপোর্টে আরো বলা হয়, কর্মচারী নিয়োগ, হিসাব দাখিল, অবচয় তহবিল সংরক্ষণসহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম লঙ্ঘন করা হয়েছে। চলতি বছরেই সমিতির লোকসান প্রায় ১ কোটি ৪৭ লাখ টাকা ছাড়িয়ে গেছে।

ইলেকট্রো-মেকানিক্যাল কাজে নিয়োগ দেওয়া ঠিকাদারও প্রকল্পে কোনো দৃশ্যমান কাজ করেননি বলে উল্লেখ রয়েছে। সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ, সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হাসান ১ কোটি ৯৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন এবং এর ওপর সুদসহ ৭১ লাখ টাকা বকেয়া থাকলেও তা আদায়ে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

ভবিষ্যৎ অনিয়ম রোধে ও সদস্যদের স্বার্থ রক্ষায় সাধারণ সদস্যদের দাবি, একটি স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ তদন্ত পরিচালনা করে দোষীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। সেই সঙ্গে দ্রুত অযোগ্য কমিটিকে অপসারণ করে গণতান্ত্রিকভাবে একটি জবাবদিহিমূলক নতুন কমিটি গঠন করতে হবে।

এই বিষয়ে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে একাধিকবার ফোন করা হলেও তারা কল রিসিভ করেননি। তবে বিভাগীয় সমবায় উপনিবন্ধক মাহবুবুল হক হাজারী জানিয়েছেন, তিনি সরেজমিন তদন্ত করেছেন এবং প্রয়োজনীয় তথ্য যাচাই শেষে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

-শরিফুল

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ