বহুমুখী চ্যালেঞ্জ এর মুখে বাংলাদেশের অর্থনীতি

অর্থনীতি ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুন ২৮ ০৮:৪১:৪৬
বহুমুখী চ্যালেঞ্জ এর মুখে বাংলাদেশের অর্থনীতি

বাংলাদেশের অর্থনীতির সামনে আগামী দিনগুলোতে ভিন্নমাত্রার বহুমুখী চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে বলে সতর্ক করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF)। বৃহস্পতিবার রাতে প্রকাশিত এক মূল্যায়ন প্রতিবেদনে সংস্থাটি জানিয়েছে, বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক টানাপড়েন, রপ্তানি বাজারে নতুন বাধা, জ্বালানি নিরাপত্তার ঘাটতি এবং অভ্যন্তরীণ কাঠামোগত দুর্বলতা মিলিয়ে দেশের অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধির গতি হ্রাস পাচ্ছে।

এই মূল্যায়নটি করা হয়েছে আইএমএফের সঙ্গে বাংলাদেশের ঋণচুক্তির চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি ছাড়ের প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে। এতে দেশের আর্থিক ঝুঁকি ও সম্ভাবনার খতিয়ান তুলে ধরার পাশাপাশি কাঙ্ক্ষিত সংস্কারগুলোর সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে।

বিশ্বমঞ্চের সংকট: রপ্তানিতে বড় ধাক্কার আশঙ্কা

আইএমএফ জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পণ্যে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করা হলে পোশাক খাত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তৈরি পোশাক রপ্তানিই বাংলাদেশের বৈদেশিক আয়ের প্রায় ৮৬ শতাংশের উৎস। আর এর অর্ধেকের বেশি, প্রায় ৫৪ শতাংশ রপ্তানি হয় যুক্তরাষ্ট্রে। এই শুল্কব্যবস্থা কার্যকর হলে রপ্তানি আয় হ্রাস, কর্মসংস্থান সংকট এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ সৃষ্টি হবে।

অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যে চলমান অস্থিরতা, বিশেষত ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনা ও লেবানন-সিরিয়ার জ্বালাময় পরিস্থিতি বাংলাদেশের রেমিট্যান্স প্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারে বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক কর্মী নিয়োজিত। রাজনৈতিক সঙ্কট ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে এই অঞ্চল থেকে রেমিট্যান্সে ধস নামার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ছায়া এখনো বিদ্যমান

বিশ্বজুড়ে সরবরাহব্যবস্থার ব্যাঘাত, খাদ্য ও জ্বালানি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, এবং রপ্তানি বাজারের অনিশ্চয়তা সব মিলিয়ে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের অভিঘাত থেকে বাংলাদেশ এখনো পুরোপুরি মুক্ত হতে পারেনি। আইএমএফ সতর্ক করেছে, এই যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে তা বৈদেশিক বাণিজ্যে নতুন করে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা: রাজস্ব ঘাটতি ও বিনিয়োগে স্থবিরতা

দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোগত দুর্বলতা বিশেষ করে ব্যাংক খাতের ঋণ বিতরণে সীমাবদ্ধতা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা ব্যবসায়িক আস্থা ও বিনিয়োগ পরিবেশকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।

সরকারের রাজস্ব আয় প্রত্যাশার তুলনায় কম হওয়ায় উন্নয়ন ব্যয়ও সংকুচিত হচ্ছে। এর ফলে সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়ন ধীরগতির এবং অর্থনৈতিক চক্রে কাঙ্ক্ষিত গতি আসছে না। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ হ্রাস পাওয়ায় কর্মসংস্থান সৃষ্টিও ব্যাহত হচ্ছে।

বৈদেশিক লেনদেন ও ডলার চাপে দীর্ঘমেয়াদি শঙ্কা

আইএমএফ পূর্বাভাস দিয়েছে, চলতি অর্থবছরে বৈদেশিক লেনদেনের ঘাটতি কিছুটা কমে জিডিপির ৩.৫ শতাংশে নামতে পারে। তবে আগামী বছরগুলোতে এই ঘাটতি ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, যা সরাসরি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, আমদানি ক্ষমতা ও মুদ্রানীতির স্থিতিশীলতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই পরিস্থিতি ডলার বাজারে পুনরায় অস্থিরতা তৈরি করতে পারে, যার ফলাফল হবে মূল্যস্ফীতি, আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি এবং বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে চাপ।

আইএমএফের সংস্কার নির্দেশনা: সময় নির্ধারিত পরিকল্পনাআইএমএফ সরকারকে একগুচ্ছ কাঠামোগত সংস্কার বাস্তবায়নের সুপারিশ করেছে, যার মধ্যে রয়েছে:

জ্বালানি নিরাপত্তা পরিকল্পনা:

আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে তিন বছর মেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। এ খাতে ভর্তুকি ধাপে ধাপে শূন্যে নামিয়ে আনার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, যাতে বাজেট ভারসাম্য বজায় থাকে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা:

ডিসেম্বরের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও মুদ্রানীতি প্রণয়নে পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। এককভাবে বিনিময় হার নির্ধারণের ক্ষমতা বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে থাকতে হবে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ ছাড়াই।

জুনের মধ্যেই সরকারের অন্তত ৫০% আর্থিক লেনদেন অনলাইনে স্থানান্তর করতে হবে। ই-রিটার্ন, করদাতা সেবা ও কর আদায়ের ডিজিটাল পদ্ধতি নিশ্চিত করতে এনবিআরকে বাধ্যবাধকতা দেওয়া হয়েছে।

আগামী বছরের মার্চের মধ্যে সব ধরনের অযৌক্তিক কর ছাড় বাতিল করতে হবে। সরকারি প্রতিষ্ঠানের ঋণকে বেসরকারি খাতের মতো শ্রেণিবিন্যাস করতে হবে। এতে দায়-দেনার বাস্তবচিত্র স্পষ্ট হবে এবং আর্থিক খাতের স্বচ্ছতা বাড়বে।

আইএমএফ একক রপ্তানি খাতের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে বহুমুখীকরণের ওপর জোর দিয়েছে। তৈরি পোশাকের বাইরে চামড়া, ওষুধ, আইসিটি এবং কৃষিপণ্য রপ্তানি বৃদ্ধির তাগিদ দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে আমদানির ওপর নির্ভরতা কমাতে দেশে কৃষিপণ্যের উৎপাদন বাড়ানোর সুপারিশও করা হয়েছে।

বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে এক বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জের মুখে। বৈশ্বিক অনিশ্চয়তা, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং কাঠামোগত দুর্বলতা মিলে এক কঠিন বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আছে দেশটি। এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় দ্রুত, সুসমন্বিত ও সময়োপযোগী সংস্কার ছাড়া বিকল্প নেই।

-ইসরাত, নিজস্ব প্রতিবেদক

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ