জানুন কি সেই অস্ত্র যা পরমানু বোমার চেয়েও ভয়ংকর

প্রযুক্তি ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুন ২৪ ১১:৪০:০২
জানুন কি সেই অস্ত্র যা পরমানু বোমার চেয়েও ভয়ংকর

এই পৃথিবীতে এমন এক অস্ত্র রয়েছে, যা একবার ব্যবহার করা হলে তার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কেবল মানুষের মৃত্যুতে সীমাবদ্ধ থাকে না; বরং প্রাণীকুল, কৃষি, খাদ্যব্যবস্থা, এমনকি পুরো পরিবেশ-প্রতিবেশও দীর্ঘমেয়াদে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এই অস্ত্রটি হলো জৈবিক অস্ত্র (Biological Weapon), যা অনেকের কাছে অদৃশ্য অথচ সবচেয়ে ভয়ংকর যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে বিবেচিত। সাধারণ ধারণা অনুযায়ী, পারমাণবিক বোমা বিশ্ব ইতিহাসে সবচেয়ে বিধ্বংসী অস্ত্র, যা ১৯৪৫ সালে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে ব্যবহারের পর ভয়াবহ পরিণতি ঘটিয়েছিল। কিন্তু আধুনিক ভূরাজনীতি ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, জৈবিক অস্ত্রের মাধ্যমে যে প্রকার ধ্বংস ডেকে আনা সম্ভব, তা পারমাণবিক হামলার তুলনায় অনেক বেশি বিস্তৃত, দীর্ঘস্থায়ী এবং সাংঘাতিক।

জৈবিক অস্ত্র আসলে একধরনের 'নীরব গণহত্যার হাতিয়ার', যার কাজ ধ্বংস নয় বিস্ফোরণের মাধ্যমে, বরং মানুষের দেহে সংক্রামক জীবাণু ঢুকিয়ে ধীরে ধীরে শারীরিক অবনতি ঘটানো, মৃত্যুকে দীর্ঘায়িত করা, এবং একপ্রকার মানসিক আতঙ্কের বিস্তার ঘটানো। এ ধরনের অস্ত্রে ব্যবহৃত হয় ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক ও টক্সিন। এগুলোর মধ্যে অনেকগুলো প্রাণঘাতী যেমন: অ্যানথ্রাক্স, বোটুলিনাম, স্মলপক্স, ইবোলা, প্লেগ এবং আরও বহু জৈবিক উপাদান, যেগুলো অনিয়ন্ত্রিত ছড়িয়ে পড়লে বিশ্বজুড়ে মহামারি ঘটাতে পারে।

জৈবিক অস্ত্রের সবচেয়ে ভয়ংকর দিক হলো, এগুলো একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ড বা লক্ষ্যবস্তুতে সীমাবদ্ধ থাকে না। একজন সংক্রমিত ব্যক্তি হয়ে উঠতে পারে একেকটি দেশের বিরুদ্ধে ‘মানববোমা’। এই অস্ত্র এতটাই জটিল ও অদৃশ্য যে এর উৎস শনাক্ত করা প্রায় অসম্ভব। উদাহরণস্বরূপ, কোভিড-১৯ এর সময় একটি বিশ্বব্যাপী বিতর্ক ছড়িয়ে পড়ে উহানের একটি গবেষণাগার থেকে ভাইরাসটি কী ইচ্ছাকৃতভাবে ছাড়া হয়েছিল? যদিও এই দাবির কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ মেলেনি এবং কোভিডকে প্রাকৃতিক উৎস থেকেই উদ্ভূত বলে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, তবুও এই মহামারি দেখিয়ে দিয়েছে জৈবিক অস্ত্রের মতো একটি ভাইরাস কীভাবে বিশ্ব অর্থনীতি, রাজনীতি, স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং মানুষের মানসিক স্থিতিকে পুরোপুরি বিপর্যস্ত করতে পারে।

বিশ্বের অন্তত ১৭টিরও বেশি দেশ যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, উত্তর কোরিয়া, ইরান, জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্যসহ গোপনে বা ছদ্মবেশে জৈবিক অস্ত্র সংক্রান্ত গবেষণা পরিচালনা করছে বলে একাধিক আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ সংস্থা এবং কূটনৈতিক রিপোর্টে উঠে এসেছে। যদিও ১৯৭২ সালে স্বাক্ষরিত Biological Weapons Convention (BWC) অনুসারে কোনো দেশই এসব অস্ত্র তৈরি ও সংরক্ষণ করতে পারে না, কিন্তু বাস্তবে এটি উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। অধিকাংশ দেশই ‘সামরিক প্রতিরক্ষামূলক গবেষণা’ বা ‘ভাইরোলজি রিসার্চ’ এর নামে এসব অস্ত্রের সম্ভাব্য ব্যবহারিক কাঠামো তৈরি করছে।

জৈবিক অস্ত্রের বিপজ্জনকতা এখানেই শেষ নয়। এর প্রভাব শুধু মানুষের দেহে সীমাবদ্ধ না থেকে জলবায়ু, প্রাণিবৈচিত্র্য ও খাদ্যশৃঙ্খলেও সরাসরি আঘাত করে। উদাহরণস্বরূপ, কোনো ফসলনাশক ছত্রাক বা গবাদিপশু সংক্রমক ভাইরাস ছড়িয়ে দিলে একটি দেশের কৃষি উৎপাদন ও খাদ্যনিরাপত্তা চরম হুমকিতে পড়ে। এতে একদিকে যেমন অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটে, অন্যদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও গণবিক্ষোভ বাড়ে যা শত্রুপক্ষের জন্য একটি কৌশলগত জয়।

এই অস্ত্রের আরেকটি ছায়া-প্রভাব হলো মানসিক স্বাস্থ্য ধ্বংস। যখন কোনো সংক্রমণ দীর্ঘায়িত হয়, তখন জনমনে ভয়, অবিশ্বাস, ষড়যন্ত্রতত্ত্ব এবং রাষ্ট্রবিরোধী মনোভাব ছড়িয়ে পড়ে। ফলে একটি রাষ্ট্রের সমাজ কাঠামো ও শাসনব্যবস্থাও দুর্বল হয়ে যায়।

বিশ্বব্যাপী চিকিৎসাবিজ্ঞান ও প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকরা একমত জৈবিক অস্ত্র যুদ্ধের এক নতুন যুগের সূচনা করেছে, যেখানে আর কামান বা ট্যাঙ্কের প্রয়োজন হয় না; প্রয়োজন শুধু একটি নমুনা ভাইরাস, একটি জীবাণুযুক্ত চিঠি, কিংবা একটি ল্যাব-উৎস থেকে নিঃসৃত মাইক্রোঅর্গানিজম। তাই কেবল সেনাবাহিনী নয়, প্রতিটি দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা, গবেষণাগার নিরাপত্তা, আন্তর্জাতিক সমন্বয় ও দ্রুত প্রতিক্রিয়াশীল মেডিকেল প্রস্তুতি থাকা এখন জরুরি।

এই অস্ত্রের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় প্রতিরক্ষা হতে পারে নৈতিক বিজ্ঞানচর্চা, বৈশ্বিক ট্রান্সপারেন্সি, এবং আন্তঃরাষ্ট্রীয় বিশ্বাসভিত্তিক নিরাপত্তা কাঠামো। যুদ্ধের রাজনীতি যতই এগিয়ে যাক, পৃথিবী নামক এই গ্রহে যদি মানবতা টিকে থাকে, তবে জৈবিক অস্ত্রকে ‘না’ বলার সাহস এবং সামগ্রিক প্রস্তুতি এটাই হতে হবে আমাদের সভ্যতার ভবিষ্যৎ রক্ষার শেষ ভরসা।

-রাফসান, নিজস্ব প্রতিবেদক

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

আমেরযত কাহিনি

আমেরযত কাহিনি

নিজস্ব প্রতিবেদক: স্বাদ, গন্ধ ও পুষ্টিগুণে পরিপূর্ণ ‘আম’ শুধু একটি ফল নয়, বরং এটি ইতিহাস, সংস্কৃতি ও অর্থনীতিতে গভীরভাবে প্রোথিত এক... বিস্তারিত