ইতিহাস

ক্রিস্টোফার কলম্বাস: বীর না বর্বর? ইতিহাসের নির্মম সত্য

ইতিহাস ও দর্শন ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুন ১৬ ০০:১১:৫২
ক্রিস্টোফার কলম্বাস: বীর না বর্বর? ইতিহাসের নির্মম সত্য

আমরা সবাই ছোটবেলায় ইতিহাসের পাঠে এমন কিছু চরিত্রের গল্প শুনে বড় হই, যাদের মহান এবং বীরোচিত হিসেবে তুলে ধরা হয়। তেমনই একজন ছিলেন ক্রিস্টোফার কলম্বাস। আমাদের শেখানো হয়েছিল, তিনি আমেরিকা “আবিষ্কার” করেছিলেন, এবং ইউরোপীয় সভ্যতা এই মহাদেশে নিয়ে এসেছিলেন। স্কুলের পাঠ্যবই ও টেলিভিশনের প্রামাণ্যচিত্রে তাঁকে তুলে ধরা হতো এক মহান দিগন্তজয়ীর প্রতীক হিসেবে। এতটাই প্রভাবিত ছিলাম যে একবার এক বন্ধুর সঙ্গে প্রায় ঝগড়ায় লিপ্ত হয়ে গিয়েছিলাম, কারণ সে বলেছিল, কলম্বাস কিছুই আবিষ্কার করেননি—আমেরিকায় বহু আগে থেকেই মানুষ বসবাস করতো।

আমি তখন যুক্তির বদলে অহংকার নিয়ে কথা বলেছিলাম। কিন্তু পরে, মাত্র কয়েক মিনিটের গুগল সার্চ করেই বুঝতে পারলাম, সত্যিই আমার ধারণা ভুল ছিল। সেই “আবিষ্কৃত” মহাদেশে লক্ষ লক্ষ আদিবাসী জনগোষ্ঠী বাস করত, তাদের সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতি ছিল একান্তই তাদের নিজস্ব। এই উপলব্ধি আমার ভিতরের বিশ্বাসকে নাড়িয়ে দিয়েছিল এবং ধীরে ধীরে আমি জানতে শুরু করলাম, কলম্বাস শুধু একজন নাবিক ছিলেন না, বরং ছিলেন সহিংস দখলদার, যার লোভ, নির্দয়তা এবং দম্ভের কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন ধ্বংস হয়েছিল।

আসলে কে ছিলেন কলম্বাস?

ক্রিস্টোফার কলম্বাস জন্মগ্রহণ করেন ১৪৫১ সালে বর্তমান ইতালির জেনোয়া শহরে। তার পরিবার ছিল তুলনামূলকভাবে দরিদ্র, এবং তিনি কৈশোরে জাহাজে কাজ করতে শুরু করেন। নাবিক হিসেবে অভিজ্ঞতা অর্জনের পর তিনি পশ্চিমে এশিয়ায় পৌঁছানোর একটি বিকল্প পথের ধারণা দেন—পূর্বের স্থলপথ মুসলিম শাসকদের নিয়ন্ত্রণে থাকায় ইউরোপীয়রা একটি বিকল্প সমুদ্রপথ খুঁজছিল। কলম্বাস দাবি করেন, পৃথিবী গোল, এবং পশ্চিম দিকে সমুদ্রযাত্রা করলেই সরাসরি এশিয়ায় পৌঁছানো সম্ভব হবে।

এই পরিকল্পনায় তিনি পর্তুগাল, ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড থেকে প্রত্যাখ্যাত হন। কিন্তু স্পেনের রানি ইসাবেলা ও রাজা ফার্ডিন্যান্ড তাঁর প্রস্তাবে উৎসাহী হন। ১৪৯২ সালে তিনটি জাহাজ—নিনা, পিন্টা ও সান্তা মারিয়া নিয়ে কলম্বাস যাত্রা শুরু করেন এবং অবশেষে বাহামা দ্বীপপুঞ্জে পৌঁছান। যদিও তিনি মনে করেছিলেন, তিনি জাপানের কাছাকাছি পৌঁছেছেন, বাস্তবে তিনি ছিলেন ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে। তার এই ভুলই একটি ভয়ংকর অধ্যায়ের সূচনা করে।

“আবিষ্কার” না “দখল”?

ইতিহাসে “আবিষ্কার” শব্দটি বহুবার ব্যবহার করা হয়েছে অত্যন্ত ভুলভাবে। কলম্বাসকে অনেকেই “নিউ ওয়ার্ল্ড” বা “নতুন বিশ্ব” আবিষ্কারকারী হিসেবে অভিহিত করেন, কিন্তু আদৌ কি তা সত্য?

এই অঞ্চলে লক্ষ লক্ষ আদিবাসী—তাইনো, অ্যাজটেক, ইনকা, চিবচা, মায়া—ইতিমধ্যেই বসবাস করছিলেন। তাদের সমাজ ছিল সংগঠিত, কৃষি ব্যবস্থা ছিল উন্নত, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গ ছিল সম্পূর্ণ। তাহলে কলম্বাস কাকে “আবিষ্কার” করলেন? যদি কেউ কোনো বসতিপূর্ণ জনপদে এসে দাবি করেন যে তিনি তা আবিষ্কার করেছেন, তাহলে সেটি কি সত্যি আবিষ্কার?

আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কলম্বাসই প্রথম ইউরোপীয় নন যিনি আমেরিকায় পা রাখেন। নর্স নাবিক লেইফ এরিকসন ১০০০ সালের কাছাকাছি সময়ে কানাডার নিউফাউন্ডল্যান্ডে পৌঁছেছিলেন। সুতরাং, কলম্বাসকে “প্রথম” হিসেবে মহিমান্বিত করা ইতিহাসের নির্লজ্জ বিকৃতি।

রোগ, মৃত্যু এবং একটি নীরব গণহত্যা

কলম্বাস এবং তার সঙ্গীরা আমেরিকায় নিয়ে এসেছিলেন ইউরোপীয় জীবাণু—স্মলপক্স, হাম, ইনফ্লুয়েঞ্জা, ইত্যাদি। আদিবাসীদের শরীর এসব রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী ছিল না। কয়েক দশকের মধ্যেই লক্ষ লক্ষ মানুষ এই রোগে মারা যান। একে অনেকেই ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ ‘জৈবিক বিপর্যয়’ (biological catastrophe) বলে গণ্য করেন।

যদিও এই রোগ ছড়ানো ইচ্ছাকৃত ছিল না, তবে ইউরোপীয়রা এই মৃত্যু এবং দুর্যোগকে কখনো মানবিকভাবে বিবেচনা করেননি। বরং অনেক ইউরোপীয় খ্রিষ্টান নেতাই এটিকে ঈশ্বরের দান হিসেবে দেখতেন—যাতে আদিবাসীদের জায়গা দখল করা যায় আরও সহজে।

দাসপ্রথা: কলম্বাসের নির্মম অবদান

সবচেয়ে বিভীষিকাময় দিক ছিল দাসত্ব ও যৌন সহিংসতার মাধ্যমে আদিবাসীদের শোষণ। কলম্বাস নিজেই তার ডায়েরিতে তাইনো আদিবাসীদের সম্পর্কে লেখেন—

“তারা সরল, শান্তিপ্রিয়, নিরস্ত্র। চমৎকার দাস বানানো যাবে। মাত্র পঞ্চাশজন মানুষ নিয়ে আমরা এদের পুরোপুরি দখল করে ফেলতে পারি।”

তিনি স্পেনের রাজা-রানিকে প্রতিশ্রুতি দেন—“যত সোনা ও দাস চাও, আমি দেব।”

এই প্রতিশ্রুতি রাখতে গিয়েই শুরু হয় নারকীয় অত্যাচার। কলম্বাস এবং তার সঙ্গীরা হাজার হাজার আদিবাসীকে বন্দি করে, আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে স্পেনে পাঠান। যারা থেকে যায়, তাদের বাধ্য করা হয় স্বর্ণ খুঁজে আনতে বা তুলা চাষ করতে। যারা ব্যর্থ হয়, তাদের হত্যা করা হয়, হাত-পা কেটে দেওয়া হয়, কুকুর দিয়ে ছিঁড়ে ফেলা হয়, এমনকি কিশোরী মেয়েদের যৌনদাসী বানানো হয়।

এই বিপর্যয়ের কারণে যখন আদিবাসী জনসংখ্যা নষ্ট হয়ে যায়, তখন কলম্বাস ও তার অনুসারীরা আফ্রিকা থেকে দাস আমদানি শুরু করে—যাদের বলা হতো ‘রোগপ্রতিরোধে সক্ষম শ্রমিক’। এভাবেই কলম্বাস ট্রান্সআটলান্টিক দাস বাণিজ্যের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।

অবশেষে পতন: নিজেরাই গ্রেফতার করলো যাকে পাঠিয়েছিল

কলম্বাসের নির্মম শাসন শুধু আদিবাসীদের ওপরই নয়, বরং স্প্যানিশ উপনিবেশবাদীদের ওপরও ছিল নিষ্ঠুর। হিসপানিওলায় তার শাসনব্যবস্থা এতটাই স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে যে স্পেন সরকার তাকে গ্রেফতার করে শিকল পরিয়ে স্পেনে ফেরত পাঠায়। যদিও পরে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়, কিন্তু তিনি আর কখনো গভর্নর হিসেবে কাজ করতে পারেননি। নিজেই স্বীকার করেন, অনেক অভিযোগ সত্য ছিল।

কলম্বাসের উত্তরাধিকার: সভ্যতার সেতুবন্ধন, না এক ধ্বংসযজ্ঞের ইতিহাস?

একদল ইতিহাসবিদ কলম্বাসের যাত্রাকে Columbian Exchange নামে চিহ্নিত করেছেন—যেখানে ইউরোপ ও আমেরিকার মধ্যে খাদ্য, প্রাণী, প্রযুক্তি ও সংস্কৃতির বিনিময় ঘটে। এই বিনিময় ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু এই “বিনিময়” হয়েছিল রক্ত, লাশ এবং দাসত্বের বিনিময়ে। কোনো সভ্যতা গড়ে ওঠে যদি তা অন্যকে ধ্বংস করে—তাহলে সেটি আদৌ সভ্যতা?

প্রতি বছর অক্টোবর মাসে, যুক্তরাষ্ট্রে Columbus Day পালিত হয়। কিন্তু এখন অনেক জায়গায় এটি Indigenous Peoples’ Day হিসেবে পালিত হচ্ছে—যেখানে সত্যিকারের ইতিহাস ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সংগ্রামকে সম্মান জানানো হয়। এখন আমাদের প্রশ্ন করা উচিত—আমরা কী উদযাপন করছি? একটি আবিষ্কারের গল্প, না একটি দখলের ইতিহাস?

কলম্বাস একজন দক্ষ নাবিক ছিলেন, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু তার নৈতিকতা ছিল বিকৃত, দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ঔপনিবেশিক, এবং কার্যকলাপ ছিল নির্মম। তাকে উদযাপন করা মানে সেই সহিংসতা ও নিপীড়নকে প্রশ্রয় দেওয়া। সত্যিকারের ইতিহাস বোঝা মানে শুধু অতীত জানা নয়—বরং ভবিষ্যতের জন্য ন্যায়বোধ গড়ে তোলা। ইতিহাসের পাঠ কেবল বিজয়ের গল্প নয়, বিচারের দায়ও।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

স্টারমারের নীরবতা: কূটনৈতিক শিষ্টাচার বনাম রাজনৈতিক সংকোচ

স্টারমারের নীরবতা: কূটনৈতিক শিষ্টাচার বনাম রাজনৈতিক সংকোচ

একজন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ, সামাজিক ব্যবসার পথপ্রদর্শক এবং গণতান্ত্রিক উত্তরণের নেতৃত্বদানকারী রাষ্ট্রনায়ক—এই তিনটি পরিচয়ই এখন সমভাবে প্রযোজ্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের... বিস্তারিত