জাতীয় নাগরিক পার্টি

হতাশার ছায়ায় এনসিপি!

জাতীয় ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ মে ২৪ ০৮:৪৮:০৬
হতাশার ছায়ায় এনসিপি!

বাংলাদেশের রাজনীতির উত্তাল সময়ে জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণ ছাত্র-জনতার উদ্যোগে গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) শুরুতে যেমন উদ্দীপনা ও প্রত্যাশার জন্ম দিয়েছিল, এখন তেমনই সমালোচনা ও বিতর্কের ঘূর্ণিপাকে আবদ্ধ হয়ে পড়ছে। দল গঠনের অল্প কয়েক মাসের মধ্যেই একের পর এক দুর্নীতি, অনিয়ম, নেতৃত্বের সংকট, অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা—সবমিলিয়ে এনসিপি এখন এক গভীর বিশ্বাসযোগ্যতা সংকটে।

সম্ভাবনার বার্তা থেকে বাস্তবতার ধাক্কা

২০২৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি আত্মপ্রকাশের সময় এনসিপি জনগণের সামনে একটি নতুন রাজনৈতিক বিকল্পের প্রতিশ্রুতি দেয়। রাজপথে লড়াই করে উঠে আসা তরুণদের এ রাজনৈতিক উদ্যোগ গণতন্ত্র, স্বচ্ছতা এবং জাতীয় স্বার্থ রক্ষার প্রশ্নে স্পষ্ট অবস্থানের কথা বলেছিল। কিন্তু মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই সেই প্রতিশ্রুতির ছায়া ম্লান হয়ে পড়েছে বিতর্কের ভারে।

দলটির জ্যেষ্ঠ নেতা আব্দুল হান্নান মাসউদের বিরুদ্ধে একজন ‘চাঁদাবাজ’ ছাত্রনেতাকে থানায় গিয়ে ছাড়িয়ে আনার অভিযোগ, যুগ্ম সদস্য সচিব গাজী সালাউদ্দিন তানভীরের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক দুর্নীতি ও কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগ এসব ঘটনায় দলটির নৈতিক ভিত্তি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। বিশেষ করে তানভীরের বিষয়ে স্থায়ী ব্যবস্থা না নেওয়ায় শৃঙ্খলা ও জবাবদিহিতার ঘাটতি স্পষ্ট হয়েছে।

নেতৃত্বের অভ্যন্তরীণ টানাপড়েন

দলটির শীর্ষ নেতাদের মধ্যে বহুবার মতবিরোধ প্রকাশ্যে এসেছে। পঞ্চগড়ে শোডাউন করে আলোচিত হন মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম, যিনি বিত্ত-বৈভব প্রদর্শন করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিদ্রুপের পাত্র হন। অপরদিকে, দক্ষিণাঞ্চলের সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ সেনাবাহিনী নিয়ে স্পর্শকাতর মন্তব্য করে সমালোচিত হন। এনসিপির এমন কয়েকজন নেতা যাদের সরকারে কোনো পদ নেই, তবুও তাদের নাম দুর্নীতির অভিযোগে দুদকের তদন্তে উঠে এসেছে—যা দলীয় শুদ্ধতার প্রশ্নে গুরুতর সংকেত।

এছাড়া রেল ভবনে তদবির, ওয়াসার নিয়োগে সুপারিশ, সাংবাদিকদের ওপর হামলা এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য—এসবের ফলে নেতাদের ব্যক্তিগত কর্মকাণ্ড দলীয় ইমেজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

রাজনৈতিক সম্পর্কের টানাপোড়েন

নবগঠিত এ দলটি শুরুতে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে বিভিন্ন ছাত্র ও রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ থাকলেও বর্তমানে তা ভেঙে পড়েছে। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, ছাত্রশিবির এবং গণঅধিকার পরিষদের সঙ্গে একাধিক ইস্যুতে তিক্ততা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে কেন্দ্র করে, রাজনৈতিক অবস্থান ও কৌশলগত ভিন্নতা আরও গভীর করেছে দূরত্ব। এনসিপি নেতাদের প্রকাশ্য কটূক্তি, অপরপক্ষের পাল্টা প্রতিক্রিয়া—সব মিলিয়ে একটি বৃহত্তর ঐক্যের সম্ভাবনাকে খর্ব করেছে।

জামায়াত-শিবিরের অভিযোগ অনুযায়ী, এনসিপি অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে তাদের সহযোগিতা নিয়েও পরবর্তীতে ‘মাইনাস’ নীতির আশ্রয় নেয়। অন্যদিকে, গণঅধিকার পরিষদ এনসিপিকে ‘চক্রান্তকারী’, ‘বিশ্বাসভঙ্গকারী’ ও ‘ষড়যন্ত্রকারী’ হিসেবে উল্লেখ করে। এর ফলে রাজনীতির রাজপথে এনসিপি এখন অনেকটাই একঘরে।

মানুষের প্রত্যাশা বনাম বাস্তবতা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. স ম আলী রেজা মনে করেন, “নতুন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে এনসিপির আত্মপ্রকাশ একটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ ছিল। কিন্তু দলটি সাংগঠনিক পরিপক্বতা, অভিজ্ঞ নেতৃত্ব এবং রাজনৈতিক শৃঙ্খলা গড়তে ব্যর্থ হয়েছে।” তার মতে, “জনগণের চাহিদা ছিল গভীর, এনসিপির প্রস্তুতি ছিল অগভীর।”

বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকতে হলে এনসিপিকে অভ্যন্তরীণ শুদ্ধি অভিযান, নেতৃত্বের পেশাদারিত্ব, রাজনৈতিক কৌশলগত দূরদর্শিতা এবং গণসংযোগ জোরদার করতে হবে। না হলে, সম্ভাবনার সেই উজ্জ্বল আলো ক্রমেই নিভে যেতে পারে।

আত্মপক্ষ সমর্থন ও ভবিষ্যৎ পথরেখা

নেতারা এখনো আত্মবিশ্বাস হারাননি। যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, “আমরা জানি আমাদের ঘাটতি কোথায়। তা কাটিয়ে উঠতে কাজ করছি। অপপ্রচারের বিরুদ্ধে জনসম্পৃক্ততা বাড়াচ্ছি।”

যুগ্ম সদস্য সচিব আলাউদ্দিন মোহাম্মদ জানান, “যতটুকু সমস্যা হয়েছে, তার বেশির ভাগই বহিরাগত গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র। আমরা দলে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি।”

তবে এসব প্রতিশ্রুতি কতটা কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হবে, সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। কারণ যে তরুণদের অগ্রণী ভূমিকায় জনগণ রাজনৈতিক মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিল, তারাই এখন অনেকের চোখে পরিণত হয়েছেন আরেক ‘ব্যর্থ আশার প্রতিচ্ছবি’তে।

স্বপ্ন, সম্ভাবনা ও সংগ্রামের মধ্যে জন্ম নেওয়া জাতীয় নাগরিক পার্টি এখন নিজের অবস্থান টিকিয়ে রাখার চ্যালেঞ্জে পড়ে গেছে। বিতর্ক ও বিভ্রান্তির জট ছাড়িয়ে দলটি আদৌ জনগণের প্রত্যাশা পূরণে সক্ষম হবে কি না, সেটিই এখন বড় প্রশ্ন। সময়ই বলবে—এটি ত্বরিত প্রত্যাশার ক্লান্ত উপাখ্যান, না কি আত্মশুদ্ধির মধ্য দিয়ে ফিরে আসার এক অনন্য রাজনৈতিক রূপকথা।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ