গুলিবিদ্ধ রোগীর আর্তনাদ—এক ইন্টার্নের চোখে দেখা বাস্তবতা

জীবনযাপন ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুলাই ১৯ ১০:০৩:০৫
গুলিবিদ্ধ রোগীর আর্তনাদ—এক ইন্টার্নের চোখে দেখা বাস্তবতা
শামীমা আক্তার বর্তমানে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ট্রেইনি চিকিৎসকছবি: শামীমা আক্তারের সৌজন্যে

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় আহতদের চিকিৎসা দিতে দিনরাত কাজ করেছেন তরুণ চিকিৎসক শামীমা আক্তার। সবার কাছে তিনি 'আশা' নামে পরিচিত। আন্দোলনের উত্তাল সময়ে নিজের পরিচয় গোপন রেখে ‘ছুটির দিনে’র পাঠকদেরসঙ্গে সেই দিনগুলোর অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করেছিলেন তিনি। এবার নিজের নামসহ প্রকাশিত হওয়া লেখার পরবর্তী অভিজ্ঞতা জানালেন তিনি।

৩ আগস্ট ২০২৪, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। সকালবেলা চারপাশে এক অদ্ভুত নীরবতা। আমি ডিউটির জন্য হাসপাতালে পৌঁছেই ডক্টরস রুমে যাই। সেখানে দেখি কয়েকজন চিকিৎসক ‘প্রথম আলো’ পড়ছেন এবং কোনো একটি লেখা নিয়ে আলোচনা করছেন। কাছে গিয়ে দেখলাম, ‘ছুটির দিনে’ পাতায় ছাপা হওয়া “এক ইন্টার্ন চিকিৎসকের ডায়েরি” পড়ছেন তাঁরা। আমার বুকটা কেঁপে উঠল। কারণ, লেখাটির লেখক আমি নিজেই—একজন ইন্টার্ন চিকিৎসক!

লেখাটিতে লেখকের নাম প্রকাশ হয়নি, শুধু লেখা হয়েছে—“নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ইন্টার্ন চিকিৎসক।” আমি লিখতে ভালোবাসি। কিন্তু হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ রোগীদের আহাজারি আর নিহতদের স্বজনদের কান্না শুনে বাসায় ফিরে এসব স্মৃতি আর লিখতে ইচ্ছা করে না।

তবু যখন প্রথম আলো থেকে ঢাকা মেডিকেলের অভ্যন্তরীণ বাস্তবতা নিয়ে লেখার প্রস্তাব এলো, তখন মনে হলো—এটা দায়িত্ব। যেহেতু আমি সেই ঘটনা চোখের সামনে দেখেছি, আমিই লিখে জানাতে পারি ভেতরের রক্তাক্ত বাস্তবতা।

সেই লেখাটি সেদিন শুধু ডক্টরস রুমেই নয়, হাসপাতালের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। কেউ প্রশংসা করলেন, কেউ তাচ্ছিল্য করলেন। আমি চুপচাপ পাশে বসে এসব শুনতে থাকি। এক সহকর্মী হঠাৎ জিজ্ঞেস করেন—“এই লেখাটা তোদের ব্যাচের কেউ লিখেছে?” আমি চোখে চোখ রেখে জবাব দিই, “জানি না।”

সেই লেখাটি পরে ফেসবুকে ভাইরাল হয়। হাজার হাজার মানুষ পড়েন, শত শত মন্তব্য করেন। কেউ কেউ লেখেন, “লেখাটি পড়ে চোখে পানি এসে গেছে।” আমি তখন মনে মনে বলি—এই লেখায় যা বলা হয়েছে, তা তো আমাদের অভিজ্ঞতার অল্পই। রক্তাক্ত শরীর নিয়ে রাতে হলে ফেরা, নিহতদের মুখ বন্ধ করে দেওয়া—এসব তো আমরা প্রতিদিন করছি।

আমাদের আন্দোলনে অংশ নেওয়ার কারণে হুমকি পেয়েছি, তাই লেখক হিসেবে নিজের নাম প্রকাশ করতে পারিনি। কেউ যাতে চিনতে না পারে, সেই আশঙ্কায় ক্যানটিনে চা খাওয়ার সময়ও পাশে বসা কাউকে দেখলে উঠে যেতে হয়।

৫ আগস্টের ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির দিন—আবার উত্তেজনা ছড়ায়। হাসপাতালে আবার প্রস্তুতি, আবার আহতদের সেবা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে পড়ি আমরা।

সে সময় এক ভিডিও ভাইরাল হলো—গণভবন নাকি ভেঙে ফেলেছে মানুষ! কেউ বলল, শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করেছেন। সহকর্মীদের ফোনে ভিডিও দেখে প্রথমে অবিশ্বাস্য মনে হলেও পরে বুঝলাম, ঘটনা সত্যি।

হাসপাতালের ভেতর থেকেই বাইরে মিছিলের শব্দ শুনতে পাই। মনে হচ্ছিল, এবারের মিছিল রক্ত আর হাহাকার নয়—আনন্দের। আমার বন্ধুরা ব্যাচ ধরে বেরিয়ে পড়ে মিছিলে। আমিও তাদের সঙ্গে যাই।

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আমরা জড়ো হই। একে একে সবাই নিজেদের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেয়। আমিও বলি—লেখাটার লেখক আমি। বন্ধুরা হেসে বলে, “আমরা তো আগেই জানতাম।”

তারা চুপ ছিল, কারণ তখন চুপ থাকার সময় ছিল।

এক বন্ধু হাসিমুখে বলে ওঠে—“যাক, আমাদের সুবোধ জেগে উঠেছে।”

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ