সিন্ধু পানি চুক্তি নিয়ে হেগের আদালত যে রায় দিল

বিশ্ব ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুন ২৮ ০৮:৫৪:৫৩
সিন্ধু পানি চুক্তি নিয়ে হেগের আদালত যে রায় দিল

সিন্ধু পানি চুক্তি নিয়ে হেগের পার্মানেন্ট কোর্ট অব আর্বিট্রেশন (PCA) সম্প্রতি যে ‘পরিপূরক এখতিয়ার রায়’ দিয়েছে, সেটিকে পাকিস্তান স্বাগত জানালেও ভারত তা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে। পাকিস্তান বলছে, এই রায়ের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আইনের কাঠামোর মধ্যে ভারতের একতরফা সিদ্ধান্ত গ্রহণের পথ রুদ্ধ হয়েছে।

এই পরিপূরক রায়ে বলা হয়েছে, সিন্ধু পানি চুক্তির কোনো পক্ষ একতরফাভাবে চুক্তি স্থগিত করতে বা বিরোধ নিষ্পত্তির প্রক্রিয়া বন্ধ রাখতে পারে না। তা হলে ‘আন্তর্জাতিক বিরোধ নিষ্পত্তির বাধ্যতামূলক কাঠামো’ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

পরিপূরক রায়ে PCA জানিয়েছে, চুক্তির মূল উদ্দেশ্য এবং এর আইনি কাঠামোর আলোকে বিচার করলে দেখা যায়, একতরফাভাবে কোনো পক্ষ চলমান সালিসি প্রক্রিয়া স্থগিত করতে পারে না। আদালত বিশেষভাবে উল্লেখ করেছে, ভারতের মতো রাষ্ট্র এই ব্যাখ্যা থেকে নিজেদের পক্ষে আন্তর্জাতিক আইন দাঁড় করাতে পারবে না।

এই রায় মূলত ভারতের আগের সেই সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়া, যেখানে তারা কাশ্মীরের পাহেলগাম হামলার (এপ্রিল ২০২৪) পর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে সিন্ধু পানি চুক্তি ‘স্থগিত রাখার’ ঘোষণা দেয়। ভারত দাবি করেছিল, পাকিস্তান সন্ত্রাসে পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে, তাই তারা চুক্তি বাস্তবায়ন থেকে পিছিয়ে আসছে।

হেগের রায় প্রত্যাখ্যান করে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, তারা PCA-এর অধীনে গঠিত সালিসি ট্রাইব্যুনালকে কখনোই স্বীকৃতি দেয়নি। ভারতের মতে, এই সালিসি প্রক্রিয়া চুক্তির (সিন্ধু পানি চুক্তি, ১৯৬০) বিরোধিতা করে গঠিত হয়েছে এবং তাই এ আদালতের রায় “অবৈধ ও বাতিলযোগ্য”।

দ্য হিন্দুর প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারত এই প্রক্রিয়াকে ‘পাকিস্তানের ইন্ধনে পরিচালিত রাজনৈতিক প্রহসন’ বলে অভিহিত করেছে। তারা আরও দাবি করে, তাদের সিদ্ধান্ত ‘সার্বভৌম অধিকার প্রয়োগের অংশ’ যার মধ্য দিয়ে তারা চুক্তি স্থগিত রাখতে পারে, যতক্ষণ না পাকিস্তান সন্ত্রাসে সমর্থন বন্ধ করে।

অন্যদিকে, পাকিস্তান এই রায়কে তাদের কূটনৈতিক বিজয় হিসেবে দেখছে। এক বিবৃতিতে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, আদালতের রায় নিশ্চিত করেছে যে, ভারত সিন্ধু পানি চুক্তি লঙ্ঘন করতে পারে না। রায় স্পষ্ট করেছে, কোনো পক্ষ চুক্তি ‘স্থগিত’ রাখতে পারবে না—এটি দুই দেশের পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতেই বাতিল বা পরিবর্তিত হতে পারে।

পাকিস্তান আরও জানায়, ২০২৪ সালের জুলাই মাসে হেগের পিস প্যালেসে এই মামলার merits (মূল বিষয়ের) ওপর পরবর্তী শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে তারা। এই শুনানিতে সিন্ধু চুক্তির বাস্তবায়ন, পানি বণ্টনে ভারতের নীতিগত পদক্ষেপ এবং সালিসি প্রক্রিয়া প্রতিহত করার প্রচেষ্টা নিয়ে আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায় আসবে বলে আশা করছে ইসলামাবাদ।

১৯৬০ সালে বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় স্বাক্ষরিত সিন্ধু পানি চুক্তি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে অন্যতম দীর্ঘস্থায়ী ও কার্যকর আন্তর্জাতিক জলবন্টন চুক্তি। এই চুক্তির অধীনে সিন্ধু নদী অববাহিকার ছয়টি নদীর পানি দুই দেশের মধ্যে ভাগ করা হয়। এর মধ্যে ভারতের অধীনে পড়ে পূর্বের তিনটি নদী (সতলুজ, রবি ও বেয়াস), আর পাকিস্তান পায় পশ্চিমের তিনটি (সিন্ধু, ঝেলম ও চেনাব)।

চুক্তিটি এমন সময়ে কার্যকর ছিল, যখন ভারত-পাকিস্তান একাধিকবার যুদ্ধ করেছে। তবুও এই চুক্তি অক্ষুণ্ণ ছিল, যা এটিকে আন্তর্জাতিক জলের আইনে একটি মডেল হিসেবে গণ্য করে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, হেগের পরিপূরক রায় ভবিষ্যতে ভারত-পাকিস্তান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এবং দক্ষিণ এশিয়ায় জলবণ্টন রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে। ভারত যদি এই রায়কে অস্বীকার করেই একতরফা পদক্ষেপ চালিয়ে যায়, তাহলে তা আন্তর্জাতিক পরিসরে ভারতের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে পারে এবং ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক জল-সালিসি ও চুক্তি বাস্তবায়ন সম্পর্কিত মামলাগুলোতে একটি নেতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।

অন্যদিকে, পাকিস্তান যদি এই সালিসি প্রক্রিয়াকে কৌশলগতভাবে আন্তর্জাতিক পরিসরে ব্যবহার করতে পারে, তবে ভারতের ওপর কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক চাপ বাড়তে পারে।

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ এক বিবৃতিতে বলেছেন, “জম্মু ও কাশ্মীর, পানি, বাণিজ্য ও সন্ত্রাসবাদসহ সব গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে অর্থবহ সংলাপে বসতে প্রস্তুত।” এই বক্তব্য স্পষ্ট করে যে ইসলামাবাদ কূটনৈতিক সমাধানের পথে অগ্রসর হতে আগ্রহী।

-রফিক, নিজস্ব প্রতিবেদক

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ