সম্পাদকীয়

ইরান বনাম ইসরায়েল ও আমেরিকা: প্রকৃত বিজয়ী কে?

মো. অহিদুজ্জামান
মো. অহিদুজ্জামান
শিক্ষক ও রাজনৈতিক গবেষক
২০২৫ জুন ২৪ ১২:২৮:৫৯
ইরান বনাম ইসরায়েল ও আমেরিকা: প্রকৃত বিজয়ী কে?

ডোনাল্ড ট্রাম্পের যুদ্ধবিরতির ঘোষণার পর সাময়িকভাবে মধ্যপ্রাচ্যে কিছুটা স্থিতিশীলতা ফিরেছে, তবে এই ঘোষণা কতটা আন্তরিক এবং টেকসই—তা নিয়ে এখনো প্রশ্ন থেকেই যায়। বিগত দুই সপ্তাহে মধ্যপ্রাচ্যে যে নাটকীয় ও বহুমাত্রিক সংঘাতের অবতারণা হয়েছে, তার পেছনে রয়েছে দীর্ঘদিনের ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, সামরিক শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিযোগিতা এবং জিওস্ট্র্যাটেজিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা। কিন্তু এই সংঘাতের পরে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন এখন—কে বিজয়ী? সামরিক শক্তিতে শ্রেষ্ঠ কে? মনস্তাত্ত্বিক ও কূটনৈতিকভাবে লাভবান কে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে শুধুই যুদ্ধক্ষেত্র নয়, দেখতে হবে বৃহৎ রাজনৈতিক বাস্তবতা, ভূকৌশল, প্রযুক্তিগত প্রস্তুতি, এবং জনগণের মনস্তত্ত্বেও।

ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা ও ইরানের কৌশলগত অগ্রগতি

ইসরায়েল বহুদিন ধরেই নিজেকে একটি 'অপ্রতিরোধ্য জাতিরাষ্ট্র' হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে, যার পেছনে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিঃশর্ত সামরিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সমর্থন। আমেরিকান প্রযুক্তির মেধাবান কৌশলে গড়ে উঠেছে ইসরায়েলের 'আয়রন ডোম' ও 'ডেভিড’স স্লিং' নামক মাল্টি-লেয়ারড এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম, যা আধুনিক যুগে সবচেয়ে উন্নত বলে বিবেচিত। কিন্তু যখন ইরানের মাটিতে তৈরি হওয়া শত শত ব্যালেস্টিক মিসাইল ও কামিকাজি ড্রোন একযোগে তেলআবিব, হাইফা এবং দক্ষিণ ইসরায়েলের সামরিক ও বেসামরিক স্থাপনায় আঘাত হানে, তখন সেই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

বিশ্লেষকদের মতে, একযোগে বিপুল পরিমাণ ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার মাধ্যমে ইরান মূলত ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে 'স্যাচুরেশন অ্যাটাক' কৌশলে অভিভূত করে ফেলে। এটি এমন একটি পদ্ধতি যেখানে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সক্ষমতার তুলনায় বহুগুণ বেশি আক্রমণ চালানো হয়, ফলে প্রতিরক্ষা সিস্টেম ব্যর্থ হয় বা অতিরিক্ত খরচে অকার্যকর হয়ে পড়ে।

উল্লেখযোগ্য হলো—ইরান একটি আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার শিকার রাষ্ট্র, যার উপর ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের পর থেকে একের পর এক মার্কিন ও ইউরোপীয় অবরোধ আরোপিত হয়েছে। দেশটি গত ৪০ বছরে একটি পশ্চিমা যুদ্ধবিমান তো দূরের কথা, এমনকি একটি হেলিকপ্টারও আমদানি করতে পারেনি। তারপরও তাদের নিজস্ব গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয় এবং সামরিক ইঞ্জিনিয়াররা মিলেই যে স্বয়ংসম্পূর্ণ ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি তৈরি করেছে তা নিঃসন্দেহে পশ্চিমা সামরিক শিল্পের জন্য একটি আতঙ্কের কারণ।

কৌশলগত "জানিয়ে হামলা" ও দ্বিপাক্ষিক হিসাবনিকাশ

এই সংঘাতের একটি অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য ছিল দুই পক্ষের পূর্ব-সংকেতমূলক আক্রমণ। ইরান যেমন ইরাকে ও কাতারে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা চালানোর আগে ওয়াশিংটনকে অবহিত করে, তেমনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও সম্ভাবত ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলিতে আঘাত হানার পূর্বে তেহরানকে সতর্ক করে দেয়। এই "জানিয়ে হামলা" কোনো সাধারণ কূটনৈতিক সৌজন্য নয়; এটি ছিল পারস্পরিক যুদ্ধ-অনিচ্ছা এবং সংঘাত সীমিত রাখার যৌথ প্রচেষ্টা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এই কৌশলগত পন্থা নেওয়া হয়েছে দুটি কারণেই—প্রথমত, উভয় পক্ষই জানে একটি পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ দুই দেশের জন্যই ধ্বংসাত্মক হবে; দ্বিতীয়ত, এই সীমিত সংঘাতে একধরনের ‘ম্যাচড ডিটারেন্স’ বা ভারসাম্যপূর্ণ প্রতিরোধ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হয়েছে।

রাশিয়া ও চীনের ভূমিকা এখানে ছিল "শব্দহীন প্রভাব"—যা সংঘাত তীব্র না হওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হতে পারে। ব্রিকস ও সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের মাধ্যমে ইরান রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে গভীর সামরিক-অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে, যার কারণে আমেরিকা এককভাবে ইরানকে 'আউটম্যাচ' করতে পারেনি।

ইরানের ভবিষ্যৎ: পরমাণু শক্তি ও ভূরাজনৈতিক স্বাতন্ত্র্য

এই যুদ্ধের পরে আরেকটি প্রশ্ন সামনে এসেছে—ইরান কি এখন পরমাণু অস্ত্র অর্জনের দিকে অগ্রসর হবে? যেহেতু আমেরিকা পারমাণবিক আলোচনার পথ বন্ধ করে দিয়েছে, এবং ইসরায়েল আবার পারমাণবিক স্থাপনাগুলিতে হামলা চালিয়েছে—তাতে করে ইরান যেন আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের অজুহাত ছাড়াই এই পথে হাটার নৈতিক বা কৌশলগত বৈধতা পেয়ে গেছে।

বিশ্বের বিভিন্ন পর্যবেক্ষকের মতে, ইরান যদি এখনো পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি না-ও করে থাকে, তবু আগামী পাঁচ বছরের মধ্যেই দেশটি গোপনে কিংবা প্রকাশ্যে নিজেকে একটি পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করতে পারে। সাম্প্রতিক বৈশ্বিক ঘটনাবলি—যেমন ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত সংঘাত নিরসনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের হস্তক্ষেপ, পাকিস্তানের সেনাপ্রধানের সঙ্গে বিধিভঙ্গকারী মধ্যাহ্নভোজ, কিংবা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ—এসবের বিশ্লেষণে পরিষ্কারভাবে প্রতীয়মান, ভবিষ্যতের ভূরাজনীতিতে আত্মরক্ষার একমাত্র কার্যকর নিশ্চয়তা হয়ে উঠছে পারমাণবিক অস্ত্র।

এই বাস্তবতা বিশ্বের বহু দেশকে, বিশেষত যেগুলি আঞ্চলিক নিরাপত্তাহীনতা ও বৈশ্বিক অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে, নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে গোপনে কিংবা প্রকাশ্যে পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হতে উৎসাহিত করতে পারে। ফলে পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার রোধে প্রচলিত কূটনৈতিক কাঠামো ও আন্তর্জাতিক চুক্তিসমূহের কার্যকারিতা আগামী দিনে আরও কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হবে।

ইসরায়েলি নিরাপত্তা সংকট ও অভ্যন্তরীণ মোহভঙ্গ

এই সংঘাতের অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো—ইসরায়েলি জনগণের নিরাপত্তাহীনতা। সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, হাজার হাজার ইসরায়েলি নাগরিক, বিশেষ করে দ্বৈত নাগরিকত্বপ্রাপ্ত ইহুদিরা আমেরিকা, কানাডা ও ইউরোপে ফিরে যেতে চাইছে। এমনকি টেল আভিভে নিরাপত্তাহীনতার কারণে আবাসিক প্রকল্পের দাম ও চাহিদা কমে গেছে।

ইসরায়েল নিজেকে যে 'ইহুদি জাতির নিরাপদ আবাসভূমি' হিসেবে তুলে ধরেছিল, সেই ধারণায় এখন ধস নেমেছে। এর পাশাপাশি, অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে জোট সরকারের টানাপোড়েন, নেতানিয়াহুর জনপ্রিয়তা হ্রাস এবং সামরিক ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন উঠায় দেশটির রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে।

প্রক্সি ফ্রন্ট: মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে অঘোষিত যুদ্ধ

যুদ্ধবিরতির ঘোষণা যতই আসুক না কেন, ইরানের প্রতিপালিত প্রক্সি শক্তিগুলো—হিজবুল্লাহ (লেবানন), হামাস (গাজা), হুতি (ইয়েমেন)—তাদের যুদ্ধ থামাবে না বলেই ধারণা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে হিজবুল্লাহ গলান হাইটস অঞ্চলে গোলাবর্ষণ করেছে, হামাস দক্ষিণ ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে এবং হুতিরা আবারও সৌদি সীমান্তে নতুন আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

এই অবস্থায় গোটা মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ইসরায়েল ও আমেরিকার জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা একটি দুরূহ কাজ হয়ে দাঁড়াবে। যুদ্ধবিরতি মানে এই অঞ্চলের জন্য শান্তি নয়—বরং অঘোষিত নতুন ফ্রন্টলাইনের সূচনা।

একটি মাল্টিপোলার বিশ্বের সম্ভাবনা ও মার্কিন আধিপত্যের চ্যালেঞ্জ

এই যুদ্ধ কেবল মধ্যপ্রাচ্যের সংকট নয়, বরং একটি বৈশ্বিক ব্যবস্থার টার্নিং পয়েন্ট। ইরান, রাশিয়া, চীন, উত্তর কোরিয়া, ভেনিজুয়েলা, কিউবা, দক্ষিণ আফ্রিকা সহ আফ্রিকার একাধিক রাষ্ট্র ইতোমধ্যে মার্কিন নীতির বিরুদ্ধে একটি বিকল্প জোটের সন্ধান করছে। এই কৌশলগত সমীকরণ যদি আরও সুসংগঠিত হয়, তাহলে আমরা আর ইউনিপোলার বা বাইপোলার নয়, বরং একটি মাল্টিপোলার পৃথিবীতে প্রবেশ করতে যাচ্ছি—যেখানে ক্ষমতা ভাগ হবে, জোটভিত্তিক রাজনীতি আবার সক্রিয় হবে, এবং আমেরিকার একক আধিপত্য হারাবে তার গতি ও গ্রহণযোগ্যতা।

এই সংঘাতের মাধ্যমে বিশ্ব দেখতে পেয়েছে—একটি নিষেধাজ্ঞা-বিধ্বস্ত দেশও আত্মরক্ষা করতে পারে, সামরিক ও কৌশলগতভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে, এমনকি মনস্তাত্ত্বিকভাবে আধিপত্যকামী শক্তিকে বিপর্যস্ত করতে পারে। পক্ষান্তরে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল বুঝে গেছে—যেকোনো স্থলযুদ্ধ বা বৃহৎ সামরিক অভিযান এখন আগের মতো সহজসাধ্য নয়।

এই যুদ্ধ সাময়িক বিরতির মধ্য দিয়ে শেষ হতে পারে, কিন্তু এর অনুরণন বহু বছর ধরে বৈশ্বিক রাজনীতিতে অনুভূত হবে।

-লেখক মো. অহিদুজ্জামান ইনডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ এর গ্লোবাল স্টাডিজ অ্যান্ড গভর্ন্যান্স বিভাগে শিক্ষকতা করছেন। পাশাপাশি তিনি অনলাইন সংবাদমাধ্যম "সত্য নিউজ"-এর নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

আমেরযত কাহিনি

আমেরযত কাহিনি

নিজস্ব প্রতিবেদক: স্বাদ, গন্ধ ও পুষ্টিগুণে পরিপূর্ণ ‘আম’ শুধু একটি ফল নয়, বরং এটি ইতিহাস, সংস্কৃতি ও অর্থনীতিতে গভীরভাবে প্রোথিত এক... বিস্তারিত