খরা: বৈশ্বিক জলসংকটের এক নীরব অথচ বিধ্বংসী রূপ

পরিবেশ ও জলবায়ু ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুন ১৯ ১৪:৫৬:৫৭
খরা: বৈশ্বিক জলসংকটের এক নীরব অথচ বিধ্বংসী রূপ

খরা—প্রকৃতির একটি মৌলিক বৈরিতা, যা এখন আর শুধুমাত্র বৃষ্টির অভাব নয়, বরং মানব সভ্যতার জন্য একটি জটিল ও বহুস্তরীয় সংকট। ইউরোপের শুষ্ক বসন্তের পরে বহু অঞ্চলের কৃষকেরা আশঙ্কা করছেন, এই বছরের ফসল বিপর্যস্ত হবে। তবে এই উদ্বেগ শুধু ইউরোপেই সীমাবদ্ধ নয়। জীবাশ্ম জ্বালানির দহন থেকে উৎপন্ন উষ্ণায়নের ফলে বিশ্বের অনেক অঞ্চলেই দীর্ঘতর খরার প্রকোপ ছড়িয়ে পড়েছে।

☁️ খরার ধরন ও বৈশিষ্ট্য

সব খরা এক নয়—প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী খরাকে সাধারণত পাঁচটি ভাগে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত হচ্ছে মেটিওরোলজিক্যাল খরা—যেখানে গড় বৃষ্টিপাতের তুলনায় নির্দিষ্ট অঞ্চলে এক বা দুই মাস অস্বাভাবিকভাবে কম বৃষ্টিপাত হয়। পরবর্তী পর্যায়ে আসে কৃষিভিত্তিক খরা, যেখানে মাটি শুকিয়ে যায়, জলাধার শুকিয়ে যায় এবং কৃষকরা সেচের পানির অভাবে ফসল উৎপাদনে ব্যর্থ হন।

সুইজারল্যান্ডের বন, তুষার ও ভূদৃশ্য গবেষণা সংস্থা (WSL)-এর সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রকাশ, গত ৪০ বছরে চরম খরার সময়কাল ও ভূভাগ আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। প্রতিবছর প্রায় ৫০,০০০ বর্গকিলোমিটার জমি খরার কবলে পড়ছে—যার পরিমাণ প্রায় স্লোভাকিয়ার সমান। চিলির উত্তরে টানা ১৪ বছর খরা চলছে; যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল—অ্যারিজোনা, নিউ মেক্সিকো ও ক্যালিফোর্নিয়ার মতো রাজ্যগুলো বিগত তিন বছর ধরে ভুগছে তীব্র খরায়।

? জলাধার শুকিয়ে গেলে

হাইড্রোলজিক্যাল খরা ঘটে যখন নদী, হ্রদ ও ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বিপজ্জনকভাবে কমে যায়। সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি মেটিওরোলজিক্যাল খরার পর এই পর্যায়ে উপনীত হয় সংকট। সাইপ্রাসের মতো দ্বীপরাষ্ট্র বর্তমানে কৃষিভিত্তিক ও হাইড্রোলজিক্যাল খরার যুগপৎ অভিঘাতে বিপর্যস্ত। দীর্ঘদিন ধরে বৃষ্টি না হওয়ায় জলাধার ফাঁকা, নদীর তলদেশ ধূলায় ঢাকা, আর কৃষকদের হাতে নেই প্রয়োজনীয় সেচজল। ফলন বিপর্যয়ের আশঙ্কা বাস্তবে রূপ নিচ্ছে।

? সামাজিক ও অর্থনৈতিক অভিঘাত

খরার সবচেয়ে দৃশ্যমান প্রভাব হলো সামাজিক ও অর্থনৈতিক খরা। যখন জলাভাব বিদ্যুৎ উৎপাদন বা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দামে প্রভাব ফেলে, কিংবা তা দুষ্প্রাপ্য হয়ে ওঠে, তখন সমাজ ও অর্থনীতি এই সংকটের শিকার হয়। ২০২৪ সালে স্পেন ও ইতালিতে খরার কারণে জলরেশন ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। ফ্রান্সের কয়েকটি পারমাণবিক চুল্লি বন্ধ করতে হয়েছিল পর্যাপ্ত জল না পাওয়ায়। জিম্বাবুয়ের একটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প জলের অভাবে অচল হয়ে ব্যাপক বিদ্যুৎ বিপর্যয় ঘটায়। সুদান, দক্ষিণ সুদান ও মালি—এই দেশগুলোতে দীর্ঘমেয়াদি খরার ফলে দেখা দিয়েছে খাদ্যসংকট ও অপুষ্টি।

? বাস্তুতন্ত্রের সংকট

সবচেয়ে উপেক্ষিত খরা হচ্ছে ইকোলজিক্যাল খরা, যা উদ্ভিদ, প্রাণী ও সমগ্র বাস্তুতন্ত্রকে অস্থিতিশীল করে তোলে। জার্মানির হেলমহোলৎজ পরিবেশ গবেষণা কেন্দ্রের মতে, এই খরার প্রভাব অনেক সময় ঝড় বা বন্যার চেয়েও ভয়াবহ, অথচ এর কোনো পূর্বাভাস থাকে না। মাটির আর্দ্রতা কমে গেলে গাছ মারা যায়, ফসল ব্যর্থ হয়, বনভূমি দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ঘাসভূমি কিছুটা দ্রুত পুনরুদ্ধার করতে পারলেও বনভূমি সেই সক্ষমতা রাখে না। খরার পর ভারী বৃষ্টিপাত হলে মাটি তা শোষণ করতে না পারায় দেখা দেয় বন্যা, ভূমিধস ও কাদা প্লাবন।

?️ করণীয়: অভিযোজন ও ব্যবস্থাপনা

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভবিষ্যতে খরার ভয়াবহতা রোধে এখনই জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। একই সঙ্গে প্রয়োজন দীর্ঘ খরার সঙ্গে অভিযোজনের কৌশল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সিঙ্গাপুর এই ক্ষেত্রে এক অনন্য উদাহরণ। পুরো শহর জুড়ে বৃষ্টির জল সংরক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে; বর্জ্যজল পুনঃব্যবহার করে পানীয়জলে রূপান্তর করা হয়।

বিশ্বের বহু শহরে পানির অপচয় রোধে ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি। ইতালিতে ৪০ শতাংশ, ইউরোপে গড়ে ২৫ শতাংশ পানীয়জল পাইপলাইন সমস্যার কারণে নষ্ট হয়ে যায়। এই সমস্যার সমাধান করতে হলে অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ, লিক চিহ্নিতকরণ এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির ওপর জোর দিতে হবে।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

আমেরযত কাহিনি

আমেরযত কাহিনি

নিজস্ব প্রতিবেদক: স্বাদ, গন্ধ ও পুষ্টিগুণে পরিপূর্ণ ‘আম’ শুধু একটি ফল নয়, বরং এটি ইতিহাস, সংস্কৃতি ও অর্থনীতিতে গভীরভাবে প্রোথিত এক... বিস্তারিত