জাতি শুমারি: মোদীর ‘সম্মান রাজনীতি’ না কি ভোটের অঙ্কের চালাকি?

২০২৫ সালে ভারতের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে দেখা যাচ্ছে এক উল্লেখযোগ্য কৌশলগত পরিবর্তন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার সম্প্রতি ঘোষণা করেছে, আগামী জনগণনায় জাতিগত (caste-based) উপাত্ত সংগ্রহ অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এ সিদ্ধান্ত শুধু প্রশাসনিক নয়, রাজনৈতিকভাবেও তাৎপর্যপূর্ণ এবং সংঘ পরিবারের দীর্ঘদিনের অবস্থানের পুরোপুরি বিপরীত।
আরএসএস দীর্ঘদিন ধরে জাতিগত শুমারির বিরোধিতা করে আসছে এই যুক্তিতে যে, এটি হিন্দু সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করবে। এমনকি, ২০২৩ সালের নির্বাচনী প্রচারে মোদী নিজেই জাতি-ভিত্তিক রাজনীতিকে ‘দেশ ভাগের’ চেষ্টা বলে কটাক্ষ করেছিলেন। সেখান থেকে মোদী সরকারের এই রীতিবিরুদ্ধ ইউটার্ন এখন বিশ্লেষণের কেন্দ্রবিন্দু।
?️ বিহার: রাজনীতির ল্যাবরেটরি ও জাতিভিত্তিক ভোটের ব্যারোমিটারএই সিদ্ধান্তের পেছনে প্রথম ও প্রধান কারণ হলো বিহার রাজ্য। বহু দশক ধরে এখানে ভোট রাজনীতিতে জাতপাত একটি নির্ধারক ফ্যাক্টর। মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার ২০২২ সালেই একটি রাজ্যভিত্তিক জাতিগত সমীক্ষা চালান, যা বিপুল আলোড়ন তোলে। তাঁর দল জেডিইউ এনডিএ-র অংশ, ফলে মোদী সরকার এই জাতীয় দাবি অস্বীকার করতে পারছিল না।
একই সঙ্গে, কংগ্রেস-আরজেডি নেতৃত্বাধীন ‘ইন্ডিয়া’ জোট যদি বিহারে জাতিগত রাজনীতি জোরদার করে, তাহলে বিজেপি বিপাকে পড়বে। তাই জাতি শুমারির অনুমোদন এখন কৌশলগত চাল—যা প্রতিপক্ষের হাত থেকে একটি কার্যকর অস্ত্র কেড়ে নেওয়ার উপায়ও বটে।
? উচ্চবর্ণের রাজনৈতিক ভিত দুর্বল, নতুন ‘নিম্নবর্ণ’ শ্রেণির উত্থানবিজেপির মূল সমর্থক হিসেবে পরিচিত উচ্চবর্ণ মধ্যবিত্ত শ্রেণি এখন অর্থনৈতিক মন্দা, বেকারত্ব ও সুযোগ সীমাবদ্ধতায় ভুগছে। যদিও ‘ইকনমিক্যালি উইকার সেকশন (EWS)’ নামে উচ্চবর্ণ দরিদ্রদের জন্য কোটা চালু করা হয়েছে, বাস্তবে সরকারি চাকরির সুযোগ কমে এসেছে।
তাই মোদী সরকার এখন ‘নিও-মিডল ক্লাস’ অর্থাৎ নিম্নবর্ণ থেকে উঠে আসা নবাগত মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে আকৃষ্ট করতে চায়। জাতি শুমারির মাধ্যমে এই শ্রেণির সংখ্যাগত ভিত্তি নিশ্চিত করা যাবে, যা ভবিষ্যৎ ‘targeted policy’-এর জন্য কার্যকর হবে।
?? সম্মান ও কল্যাণের রাজনীতি: গরিব ভোটারের মন জয়লোকনীতি-সিএসডিএস জরিপ অনুযায়ী, গরিব ভোটারদের মধ্যে বিজেপির জনপ্রিয়তা ২০০৯ সালের ১৬ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২৪ সালে দাঁড়ায় ৩৭ শতাংশে। মোদী এই গরিব শ্রেণিকে টানার জন্য ব্যবহার করেছেন ‘সম্মানের রাজনীতি’ নিজের দরিদ্র, শ্রমজীবী পটভূমিকে তুলে ধরে, ‘উজ্জ্বলা’, ‘প্রধানমন্ত্রী কিষান’, ‘আয়ুষ্মান ভারত’সহ একাধিক প্রকল্প বাস্তবায়ন করে।
জরিপ বলছে, যেসব মানুষ এই প্রকল্পগুলোর সুবিধা পেয়েছে, তাদের মধ্যে বিজেপিকে ভোট দেওয়ার হার অনেক বেশি। জাতিগত শুমারি সেই শ্রেণির জন্য ‘স্মারক মর্যাদা’ রাষ্ট্র তাঁদের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিচ্ছ।
বিজেপির দীর্ঘদিনের অস্ত্র ধর্মীয় মেরুকরণ বিশেষ করে হিন্দু-মুসলিম বিভাজন। সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা যায়, ‘নিম্নবর্ণ’ হিন্দুদের মধ্যেও মুসলিমবিরোধী মনোভাব উচ্চবর্ণের মতোই প্রবল। এই মনোভাবের সুযোগ নিয়েই বিজেপি হিন্দুত্বের ছায়ায় সব শ্রেণির ভোটারকে টেনে আনতে চেয়েছে।
কিন্তু জাতীয় স্তরে জাতি ভিত্তিক দাবি এতই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে যে, শুধু ধর্ম দিয়ে আর ভোট ধরে রাখা যাচ্ছে না। বিশেষ করে ওবিসি (অন্যান্য পিছিয়ে পড়া জাতি) ভোটারদের মধ্যে বিরোধীরা আবার সক্রিয়। সমাজবাদী পার্টির মতো দল ‘নিম্ন ওবিসি’ গোষ্ঠীকে গুরুত্ব দিয়ে প্রার্থী বাছাই করে ইতিবাচক সাড়া পেয়েছে।
২০২৪ সালে বিজেপি মনোনীত প্রার্থীদের ৩১ শতাংশ ছিল উচ্চবর্ণ, যেখানে বিরোধী ইন্ডিয়া জোটে এটি ১৯ শতাংশ। জাতি শুমারি বাস্তবায়নের পর যদি বিজেপিকে ‘নিম্নবর্ণ’ প্রার্থী বাড়াতে হয়, তাহলে দলীয় অভ্যন্তরে উচ্চবর্ণ নেতাদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়বে। এটি দলের ঐতিহ্যবাহী সমর্থকদের মধ্যে বিভাজনও তৈরি করতে পারে।
তাছাড়া, জাতিগত তথ্য প্রকাশের পর ‘জনসংখ্যার ভিত্তিতে অংশীদারিত্ব’-এর দাবিও বাড়বে, যেমন সংরক্ষণের হার, বাজেট বরাদ্দ ইত্যাদি। বিজেপির জন্য এটি একটি দ্বিধাজনক পরিস্থিতি তারা কি বাস্তবতা মেনে সামঞ্জস্য আনবে, নাকি দলীয় অভ্যন্তরীণ চাপেই পিছু হটবে?
মোদী সরকারের জাতিগত শুমারির অনুমোদন কোনো একক কারণের ফল নয়। এটি রাজনৈতিক চাপে নেওয়া সিদ্ধান্ত, সামাজিক বাস্তবতা থেকে পালিয়ে না গিয়ে তা ব্যবস্থাপনার চেষ্টা। এতে রাজনৈতিক ঝুঁকি যেমন আছে, তেমনি সম্ভাবনাও আছে বিশেষ করে মোদী সরকারের নতুন সামাজিক ভিত্তি নির্মাণের কৌশল সফল হলে।
তবে এটাও ঠিক, এই সিদ্ধান্ত বিজেপির ঐতিহ্যবাহী অবস্থানের একটি মৌলিক পরিবর্তন যা দেখায়, ভারতের ভোটার সমাজ বদলাচ্ছে, আর রাজনৈতিক দলগুলোর সে পরিবর্তনের সাথে তাল মেলাতে হচ্ছে।
-শরিফুল, নিজস্ব প্রতিবেদক
আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ
- শেয়ারবাজারে এল বড় সুখবর!
- কবে থামবে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিভেদের রাজনীতি?
- স্টারমারের নীরবতা: কূটনৈতিক শিষ্টাচার বনাম রাজনৈতিক সংকোচ
- ২০২৬ সালের এপ্রিলেই জাতীয় নির্বাচন: জাতির উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা
- নির্বাচনের ঘোষণায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া: বিএনপি অসন্তুষ্ট, জামায়াত সন্তুষ্ট, এনসিপি শর্তসাপেক্ষে সমর্থন
- রিজার্ভের দাপট: বিদ্যুৎ খাতের ১৪ কোম্পানি বিনিয়োগের নতুন ঠিকানা
- রোজা, পরীক্ষা ও বাজেটের মাঝে নির্বাচন অযৌক্তিক: বিএনপি
- নারায়ণগঞ্জে বিএনপি নেতার বাড়িতে সেনা অভিযান:উদ্ধার ইয়াবা ও ধারালো অস্ত্র!
- দ্বিতীয় দিনেও চলছে কোরবানি, কসাই না পাওয়ায় আজ জবাই অনেকের
- তিন মাসেই যে ১০ বেসরকারি ব্যাংকে ৩২ হাজার কোটি টাকার আমানত বৃদ্ধি!
- তারেক-ইউনূস বৈঠক: উত্তপ্ত রাজনীতিতে সম্ভাব্য টার্নিং পয়েন্ট?
- তারেক রহমানের দেশেফেরার সম্ভাব্য সময় জানালেনমির্জা ফখরুল
- উত্তর-পূর্ব ভারতের ক্ষোভ কি ভারতের কেন্দ্রীয় কূটনীতি পাল্টাবে?
- সাক্ষাৎ চাইলেন শেখ হাসিনার ভাগ্নি, মুখ ফিরিয়ে নিলেন ড. ইউনূস
- আবদুল হামিদের দেশে ফেরা: স্বপ্ন না বাস্তব? সারজিস আলম যা বললেন