বিশেষ প্রতিবেদন

বিশ্বশক্তির নজর এখন বাংলাদেশে: খনিজ ভাণ্ডারের নতুন মানচিত্র

জাতীয় ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুন ০১ ২২:৩৬:১২
বিশ্বশক্তির নজর এখন বাংলাদেশে: খনিজ ভাণ্ডারের নতুন মানচিত্র

বাংলাদেশের মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা এক অজানা শক্তি আজ বিশ্বব্যাপী নজর কেড়েছে। গাইবান্ধা জেলার ব্রহ্মপুত্র নদীর চরভূমিতে দাঁড়িয়ে থাকা এক কৃষক হয়তো জানেন না, তার পায়ের নিচে রয়েছে এমন কিছু, যা বদলে দিতে পারে দেশের ভবিষ্যৎ। ব্রহ্মপুত্র নদীর তলদেশে ও বালুচরে সম্প্রতি যেসব খনিজ উপাদানের সন্ধান পাওয়া গেছে, তা শুধু বাংলাদেশের নয়, বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলোরও নজর কাড়ছে।

এই খনিজ উপাদানগুলো হলো ইউরেনিয়াম, সামারিয়াম, গ্যাডলিনিয়াম, টারবিয়াম ও ডিসপ্রোসিয়াম। এগুলো একসাথে পরিচিত রেয়ার আর্থ এলিমেন্টস বা বিরল মৃত্তিকা মৌল হিসেবে। এগুলোর উপস্থিতি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, বিশ্বে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির প্রতিটি খাতে এগুলোর ব্যবহার অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্মার্টফোন থেকে শুরু করে বৈদ্যুতিক গাড়ি, সামরিক ড্রোন, মিসাইল ও পারমাণবিক রিয়্যাক্টর—সবকিছুর পেছনে রয়েছে এই মৌলগুলোর অবদান।

বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এই বিরল মৌলের সন্ধান মিলেছে। গাইবান্ধার ব্রহ্মপুত্র চর ছাড়াও যমুনা, তিস্তা, ধরলা ও মেঘনা নদীর তলদেশে বালুতে পাওয়া গেছে ল্যান্থানাইড গ্রুপের মৌল। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি কেজি বালুতে ৬০ থেকে ১৭৬ মিলিগ্রাম পর্যন্ত এই মৌল বিদ্যমান। সিলেট, সুনামগঞ্জ ও ময়মনসিংহের পাহাড়ি অঞ্চলেও এই ধরণের খনিজের উপস্থিতির সম্ভাবনা রয়েছে।

এই খনিজের আর্থিক মূল্যও বিপুল। শুধু ব্রহ্মপুত্র নদীর বালুচরেই প্রতি বর্গকিলোমিটারে ছয়টি মূল্যবান খনিজ পাওয়া গেছে, যার আনুমানিক মূল্য ৩৬৩০ কোটি টাকা। কক্সবাজার, মহেশখালী ও সেন্ট মার্টিনের উপকূলে পাওয়া গেছে প্রায় ৫ মিলিয়ন টন ধাতব খনিজ ও তেজস্ক্রিয় উপাদান, যার আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য হাজার কোটি ডলারে গিয়ে দাঁড়াতে পারে।

বঙ্গোপসাগরের অর্থনৈতিক অঞ্চলেও খনিজ সম্ভার পাওয়া গেছে। এখানে পাওয়া গেছে গ্যাস হাইড্রেট, যার পরিমাণ ০.১ থেকে ০.৬৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট—এটি প্রায় ১০৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট প্রাকৃতিক গ্যাসের সমান। এছাড়া সাগরের গভীরে মিলেছে ২২০ প্রজাতির সিওয়েড, ৩৪৭ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, ৫০০টিরও বেশি সামুদ্রিক প্রাণী—যা বাংলাদেশের ব্লু ইকোনমির জন্য বিশাল সম্ভাবনা তৈরি করছে।

বিশ্বে এই খনিজ মৌলের সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী দেশ হলো চীন। চীনের হাতে রয়েছে রেয়ার আর্থ এলিমেন্টস-এর প্রায় ৮০% বাজার। কিন্তু সম্প্রতি চীন এই মৌলের রপ্তানি সীমিত করার ঘোষণা দিয়েছে, যার ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে সংকট তৈরি হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশ এখন বিকল্প উৎস হিসেবে আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছে।

বাংলাদেশের ভূ-কৌশলগত অবস্থানও এই আলোচনাকে আরও জোরালো করেছে। ভারত মহাসাগরের কাছাকাছি অবস্থিত হওয়ায় বাংলাদেশ এখন চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ ও যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে। ফলে আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও অর্থনীতির নতুন মেরুকরণে বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হয়ে উঠছে।

তবে এত সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ এখনো পিছিয়ে। দেশে নেই প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি, নেই বড় আকারের বিনিয়োগ, এবং নেই সময়োপযোগী ও স্বচ্ছ খনিজনীতি। জয়পুরহাটের চুনাপাথরের খনি কিংবা উত্তরবঙ্গের কয়লা খনি—সবই প্রায় অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। ইনস্টিটিউট অব মাইনিং, মিনারোলজি অ্যান্ড মেটালজির মতে, সঠিক পরিকল্পনা ও বিনিয়োগ থাকলে এসব সম্পদ জাতীয় অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখতে পারতো।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খনিজ সম্পদকে ঘিরে কূটনৈতিক ও নিরাপত্তা ঝুঁকিও তৈরি হতে পারে। অতীতে আফ্রিকার বহু দেশে খনিজ সম্পদ ঘিরে সংঘর্ষ, সামরিক অভ্যুত্থান ও বিদেশি হস্তক্ষেপ ঘটেছে। বাংলাদেশ সেই পথে যাবে কি না, তা সময়ই বলবে। তবে ঢাকার নীতিনির্ধারক মহলে ইতোমধ্যে আলোচনায় এসেছে খনিজ নিরাপত্তা আইন, একটি বিশেষ মিনারেল প্রটেকশন ফোর্স গঠন এবং বিদেশি বিনিয়োগকারী বাছাইয়ের বিষয়।

এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ এখন একটি বড় প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে। আমরা কি এই খনিজ সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক, কৌশলগত ও জ্বালানিনির্ভরতা দূর করে নতুন যুগে প্রবেশ করবো, নাকি পিছিয়ে পড়ে বিশ্বের রাজনীতির খেলায় অন্যদের হাতে নিয়ন্ত্রণ তুলে দেব? এক প্রবীণ কূটনীতিকের মতে, “বাংলাদেশ এখন কেবল একটি দেশের নাম নয়—এটি হয়ে উঠছে ভবিষ্যৎ ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার এক গুরুত্বপূর্ণ মানচিত্র।”

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধ: বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং ভবিষ্যৎ প্রতিযোগিতা

চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধ: বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং ভবিষ্যৎ প্রতিযোগিতা

বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে, এবং এই পরিবর্তনটির মূল কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান বাণিজ্যযুদ্ধ।... বিস্তারিত