আমরা ১৫ জন আশ্রয় নিলাম মহিষবাথান কবরস্থানে: তাসিন খানের স্মৃতি

জাতীয় ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ আগস্ট ০৫ ১৯:৩৮:৫৭
 আমরা ১৫ জন আশ্রয় নিলাম মহিষবাথান কবরস্থানে: তাসিন খানের স্মৃতি
ছবি: সংগৃহীত

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাসিন খান জুলাই আন্দোলনের অন্যতম সক্রিয় সংগঠক। তাঁর মতে, এই মাসটি আর শুধু ক্যালেন্ডারের পাতা নয়—এটি তাঁর আত্মজাগরণের সময়, বেদনার আর এক নতুন অধ্যায়।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের অংশ হিসেবে জুলাইয়ের শুরুতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মাঠে নামেন। আন্দোলন চলাকালে ঢাকার শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হঠাৎ হামলার খবর পেয়ে রাজশাহীর শিক্ষার্থীরা আরও সংহত হয়ে ওঠেন। ১৬ জুলাই হলে থাকা ছাত্রীদের মধ্যে অনেকেই প্রতিবাদের অংশ হন, যা আন্দোলনে নতুন গতি আনে। এর পরদিনই হল প্রশাসনের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। অনেক ছাত্রী চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বেরিয়ে আসেন।

১৮ জুলাই ঘটে এমন একটি ঘটনা যা তাসিনকে আন্দোলনের সম্মুখভাগে নিয়ে আসে। সেদিন তাঁর ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু শেখ ফাহমিন জাফর গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান উত্তরার আজমপুরে। হাস্যোজ্জ্বল সেই তরুণের রক্তাক্ত দেহের ছবি তাসিনের হৃদয়ে গেঁথে যায়। এই মৃত্যু তাঁকে আন্দোলনের প্রতি আরও প্রত্যয়ী করে তোলে।

এরপর আসে ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট। পাঁচ দিনের এই বিচ্ছিন্নতা চলাকালে চলতে থাকে সরকারি প্রচারণা। তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারীরা আবার নতুন করে সংগঠিত হন। রাবি সমন্বয় কমিটি পুনর্গঠিত হয় এবং তাসিন সেখানে সক্রিয়ভাবে কাজ শুরু করেন।

৩১ জুলাই আন্দোলনের আরেকটি স্মরণীয় দিন। সেদিন কোর্ট প্রাঙ্গণে কর্মসূচি চলাকালে পুলিশ বিভিন্ন এলাকায় হানা দিয়ে শিক্ষার্থীদের আটক করতে শুরু করে। নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে তাসিনসহ ১৫ জন আন্দোলনকারী আশ্রয় নেন মহিষবাথান কবরস্থানে, যেখানে স্থানীয় খাদেম তাঁদের সহায়তা করেন।

৪ আগস্ট তালাইমারির কর্মসূচি শেষে ফেরার পথে আন্দোলনকারীরা পুলিশের বাধার মুখে পড়েন। একপর্যায়ে পুলিশ ফাঁকা গুলি চালায় এবং কিছু আন্দোলনকারী ইট-পাটকেল ছুড়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তাসিনসহ ৬ জন শিক্ষার্থী একটি গলিতে আটকে পড়েন। সেখান থেকে এক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকার সহানুভূতির মাধ্যমে তাঁরা নিরাপদ আশ্রয় পান। এ অভিজ্ঞতা মুক্তিযুদ্ধের সময়কার সাধারণ মানুষের সহায়তার স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়।

আন্দোলনের পর তাসিন খান মনে করেন, তারা একটি বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্নে আন্দোলনে নেমেছিলেন, তবে সেই স্বপ্ন এখনো পূর্ণ হয়নি। তাঁর মতে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে একটি দমনমূলক পরিকাঠামোর অবসান হয়েছে বটে, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের পথ এখনো অনেক বাকি।

তিনি মনে করেন, শুধু এনসিপি নয়, গোটা জাতিই এই আন্দোলনের অংশীদার। কিন্তু এনসিপি বারবার নতুন রাজনৈতিক কাঠামোর প্রতিশ্রুতি দিলেও কার্যত তারা পুরনো ধ্যানধারণার দিকেই ঝুঁকেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টারা আন্তরিক হলেও তাঁদের কাজের অগ্রাধিকারে ভুল ছিল বলে মন্তব্য করেন তিনি।

তাসিন মনে করিয়ে দেন, অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ কেবল সুষ্ঠু নির্বাচন নয়, বরং জুলাই মাসের সহিংসতায় যারা নিহত হয়েছেন, তাদের জন্য বিচার নিশ্চিত করাও অপরিহার্য। তাঁর প্রশ্ন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যেসব সদস্যদের হাতে এখনও রক্তের দাগ, তাদের নিয়েই কিভাবে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব? তিনি বলেন, “আমার ভাই কবরে, খুনি কেন বাহিরে”—এই স্লোগান এক বছরেও বাস্তবায়িত হয়নি।

লেখক : শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, চতুর্থ বর্ষসমন্বয়ক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ