ফিরে দেখা ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট

জাতীয় ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ আগস্ট ০৫ ০৯:৫২:৩২
ফিরে দেখা ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট
ছবি: সংগৃহীত

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট, বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গভীর সংকটময় ও পরিবর্তনশীল দিন। একদিকে সরকারের ঘোষিত অনির্দিষ্টকালের কারফিউ, অন্যদিকে ছাত্র-জনতার ‘এক দফা’ দাবিতে ঘোষিত ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি। দেশের রাজনৈতিক উত্তাপ সেদিন যে স্তরে পৌঁছেছিল, তা হয়তো গত দেড় যুগেও দেখা যায়নি। এই প্রতিবেদনে রয়েছে সেদিনের সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ঢাকার রাস্তায় ঘটা বাস্তবচিত্র কারফিউ আর কাঁটাতার ভেদ করে জনতার প্রতিরোধ গড়ে তোলার এক বিস্ময়কর কাহিনি।

ঢাকার সকাল: কারফিউর চাদরে মোড়ানো এক শহর

ভোরের আলো ফোটার আগেই ঢাকার রাস্তায় নেমে পড়ে পুলিশ ও সেনাবাহিনী। মহাখালী, শাহবাগ, গুলশান, বনানী, মোহাম্মদপুর, যাত্রাবাড়ী, রামপুরা প্রায় প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কে বসানো হয় কাঁটাতারের ব্যারিকেড। রাজধানীর প্রবেশমুখ, বিশেষ করে গাবতলী, যাত্রাবাড়ী এবং আব্দুল্লাহপুরে নজিরবিহীন নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা হয়। এমনকি আবাসিক গলির মুখেও দেখা যায় পুলিশের কড়া নজরদারি। ঘর থেকে বের না হতে মাইকিং করে সতর্ক করা হচ্ছিল।

সকালের দিকে যেসব নাগরিক কারফিউ পাস হাতে বের হয়েছিলেন, তারাও হয়রানি ও জেরার মুখে পড়েন নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে। এক পর্যায়ে সকাল ১১টার দিকে বন্ধ করে দেওয়া হয় মোবাইল ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ ঢাকা কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

কারফিউ ভাঙা শুরু: ছাত্র-জনতার প্রত্যাঘাত

কিন্তু সকাল দশটার পর পরিস্থিতির মোড় নিতে শুরু করে। কাঁটাতার, ব্যারিকেড, হুমকি–সব উপেক্ষা করে একে একে রাস্তায় নামতে শুরু করেন ছাত্র-জনতা। তরুণ শিক্ষার্থীরা, শিক্ষক, নারীরা এমনকি শিশু-কিশোররাও হাতের লাঠিতে জাতীয় পতাকা বেঁধে মিছিলের অংশ হন। উত্তরা, রামপুরা, বনশ্রী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা হয়ে গোটা শহরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে বিক্ষোভের ঢেউ।

উত্তরার বিএনএস সেন্টারের সামনে বিক্ষোভকারীরা সেনা ব্যারিকেড উপেক্ষা করে মূল সড়কে উঠে আসে। সেনাবাহিনী মাইকে অনুরোধ করেও মিছিল থামাতে পারেনি। বাধ্য হয়ে ফাঁকা গুলি ছোড়া হয়। কিন্তু মিছিল থামেনি। বরং আরও সংগঠিতভাবে ব্যারিকেড ভেঙে ছাত্ররা এগিয়ে যায় গণভবনের দিকে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-শাহবাগ: শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের মিছিলে উত্তাল নগর

বিশেষ নিরাপত্তার আওতায় থাকা শাহবাগ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাও খুব দ্রুত উত্তাল হয়ে ওঠে। সকাল ১০টা পর্যন্ত অনেকটা শান্ত থাকলেও শহীদ মিনার এলাকায় কয়েকশ শিক্ষার্থীর সমাবেশে টিয়ারশেল, রাবার বুলেট এবং সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করতে চায় পুলিশ। বৃষ্টিভেজা সকালেও ক্যাম্পাসে শিক্ষকরা বিক্ষোভে নামেন। পরে শত শত শিক্ষার্থী টিএসসি থেকে মিছিল নিয়ে শাহবাগের দিকে অগ্রসর হন।

শাহবাগে শুরু হয় জনতার জমায়েত। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়াকড়ি ক্রমশ শিথিল হতে থাকে। বেলা একটার পর শাহবাগ হয়ে অন্যান্য এলাকাগুলোতেও মিছিল, স্লোগান, প্রতিরোধ বিস্তৃত হতে থাকে।

রামপুরা-বনশ্রী: পুরনো ক্ষতের ওপরে আগুন

জুলাই মাসের আন্দোলনে প্রাণহানির কেন্দ্রবিন্দু ছিল রামপুরা-বনশ্রী। পাঁচ আগস্টেও ভোর থেকেই এখানকার পরিস্থিতি ছিল জর্জরিত নিরাপত্তা ব্যবস্থায়। সকাল ১০টা পর্যন্ত মূল সড়কে ছাত্রদের দেখা না গেলেও এরপর গলি গলি থেকে নারী-পুরুষ, শিক্ষার্থী-অভিভাবকের ঢল নামে। দুপুর একটা নাগাদ হাজারো মানুষ রামপুরা ব্রিজে পৌঁছে গেলে সেনাবাহিনী তাদের থামাতে চায়। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে জনতার উল্লাস, সিজদা আর কান্না–সেনা সদস্যদের ঘিরে মানুষের ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়।

শেখ হাসিনার পদত্যাগের গুজব, আর তার পর…

রামপুরাসহ বিভিন্ন এলাকায় তখন গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন, দেশ ছেড়েছেন। বিকেলের দিকে টিভিতে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামানের ভাষণের ঘোষণা পরিস্থিতিকে আরও সংবেদনশীল করে তোলে। তখন ঢাকায় রীতিমতো উৎসবের আবহ। লাখো মানুষ নেমে আসে রাস্তায়।

গণভবন, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় ও সংসদ ভবনে জনতার ঢল

বিকাল ৩টার দিকে গণভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পিজিআর ও এসএসএফের সদস্যরা সরে যেতে শুরু করলে জনতার ঢল সেখানে আছড়ে পড়ে। গণভবনে ভাঙচুর, লুটপাট শুরু হয়। কেউ মাছ ধরে, কেউ চেয়ার নিয়ে যায়, কেউ ভেতরে বিজয় মিছিল করে। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের ছাদে ছাত্ররা পতাকা টাঙিয়ে উল্লাস করে। সংসদ ভবনেও ঢুকে পড়ে জনগণ। অনেককে স্পিকারের আসনে বসে সেলফি তুলতেও দেখা যায়।

-রফিক

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ