স্বপ্নের ব্যানারে ‘মোনাফেকদের দখল’: উমামা ফাতেমার বিদায়ের নেপথ্য কাহিনি

রাজনীতি ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুন ২৮ ১৭:০৪:৫৬
স্বপ্নের ব্যানারে ‘মোনাফেকদের দখল’: উমামা ফাতেমার বিদায়ের নেপথ্য কাহিনি

জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী অন্যতম জনচিত মুখ, উমামা ফাতেমা, আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। শুক্রবার গভীর রাতে নিজের ব্যক্তিগত ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে তিনি যে দীর্ঘ স্ট্যাটাস প্রকাশ করেছেন, তাতে যেমন রয়েছে রাজনৈতিকভাবে গঠিত একটি ছাত্র প্ল্যাটফর্মের অন্দরমহলের কালো চিত্র, তেমনই রয়েছে একজন তরুণ নারীনেত্রীর হৃদয়বিদারক আত্মকথন।

এটি কেবল কোনো ব্যক্তিগত পদত্যাগপত্র নয়, বরং একটি প্রজন্মের আন্দোলনের ভেঙে পড়া স্বপ্ন, আস্থার সংকট ও বিপন্ন ভবিষ্যতের প্রকাশ্য জবানবন্দি।

‘জুলাই-আন্দোলনের অসমাপ্ত দায়িত্ব থেকেই যাত্রা, কিন্তু স্বাধীনতা ছিল না’

উমামা ফাতেমা স্পষ্টভাবে জানান, তিনি এনসিপি গঠনের পর ‘জুলাই অভ্যুত্থানের অসমাপ্ত কাজগুলো সম্পন্ন করতে’ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে যুক্ত হন। কিন্তু প্ল্যাটফর্মটিকে স্বাধীনভাবে সক্রিয় রাখার চেষ্টা করতেই শুরু হয় চাপ, ষড়যন্ত্র ও হেনস্তা।

তার ভাষায়:“দলীয় লেজুড় ও প্রেসক্রিপশনের বাইরে এই ব্যানারটি স্বাধীনভাবে কাজ করলে অনেকের রাজনৈতিক ভবিষ্যত হুমকির মুখে পড়ত। তাই আমার উপর অনলাইন, অফলাইনে ভয়াবহ চাপ সৃষ্টি করা হয় যাতে আমি কাজ না করি।”

‘সহযোদ্ধা’দের মুখোশ খুলে গেল: ভেতরে ছিল দম্ভ, বাইরে কৃত্রিম সৌজন্য

স্ট্যাটাসে উমামা অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে লেখেন, “মানুষ বাইরে যত ভালো সাজার চেষ্টা করুক, ভিতর থেকে কতটা ছোটলোক হতে পারে আমি হাড়ে হাড়ে টের পাই ঐ সময়গুলোতে।”

তিনি জানান, যাদের সঙ্গে মিটিং-মিছিল করেছেন, তারাই পরিকল্পিতভাবে জুনিয়রদের দিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে Smear Campaign চালিয়েছে। তাঁকে নানা প্রোপাগান্ডার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করা হয়। আর এ ঘটনা ঘটেছে সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রত্যক্ষ বা নীরব প্রশ্রয়ে।

কমিটি বিতর্ক: নেতৃত্বে গোষ্ঠীপন্থা, তৃণমূলে বঞ্চনা

উমামা স্ট্যাটাসে জানান, এনসিপি গঠনের আগে এবং পরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে কমিটিগুলো ঢালাওভাবে বিতরণ করা হয়। এগুলোর অধিকাংশই ‘ভাই-ব্রাদার ক্লাব’ ভিত্তিক বলে অভিযোগ করেন তিনি।

“কমপ্লেইন আসলে আমি সরাসরি সাবেক আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবকে জানিয়েছি। কিন্তু আমার কথা শোনা হয়নি। বরং পেইজের এক্সেস আমার কাছে থাকা উচিত হলেও, আমাকে মিডিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা হয়েছে।”

তিনি আরও বলেন, মার্চ মাসে আন্দোলনের অফিসিয়াল পেজ থেকেই তার বিরুদ্ধে পোস্ট দেওয়া হয়—এটি ছিল তার ওপর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগের অন্যতম প্রতীকী ঘটনা।

‘ভোট দেওয়ার এক মিনিট আগেও দ্বিধায় ছিলাম’

প্ল্যাটফর্মের সাম্প্রতিক কাউন্সিল নির্বাচন নিয়েও উমামা গভীর হতাশা প্রকাশ করেন।তিনি জানান, “যারা কাজ করতে চায়, তারা প্রার্থী হতে পর্যন্ত পারেনি। ভোটারদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের ক্যাডার।”

তিনি শেষ মুহূর্তে ভোট দেন ঠিকই, কিন্তু বলেন,“ভেবেছিলাম হয়তো শেষবার কিছু ভালো কিছু হবে। কিন্তু রাতে দেখি, যিনি নির্বাচনেই অংশ নেননি, তিনিই কাউন্সিল মেম্বার হয়ে গেছেন।”

‘পদ, ক্ষমতা, স্ট্যান্ডবাজি—প্ল্যাটফর্মটা এখন একটা সুবিধাবাদী কুয়ায় আটকে গেছে’

উমামা আরও জানান,“নেতারা রাতের বেলা হেয়ার রোডে গিয়ে পদ নিয়ে দরকষাকষি করত। আমি জানতাম। অথচ তারা সামনাসামনি আমাকে বলেন, আমিও যেন গিয়ে পদ চাই। আমি তখনই বলি, আমি কেন ওদের কাছে যাব? তারা আমার কে?”

তিনি উল্লেখ করেন, যে নেতৃত্ব পদ দেয়, সেই নেতৃত্ব আদর্শও নিয়ন্ত্রণ করে—এবং এই দাসত্বপ্রবণ সংস্কৃতি আদর্শভিত্তিক ছাত্র রাজনীতিকে ধ্বংস করছে।

উমামা'র ফেইসবুক স্ট্যাটাস দেখতে ক্লিক করুণ

‘আমি রাজনৈতিকভাবে নয়, মানবিকভাবে হেরে গেছি’

উমামা তার স্ট্যাটাসে একপর্যায়ে লেখেন:“আমি অভ্যুত্থানের স্বপ্নকে রক্ষার জন্য এই প্ল্যাটফর্মে গিয়েছিলাম। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম, এখানে ভালো কিছু সম্ভব নয়। এখানে সংস্কার, শহীদ, শহীদ পরিবার—সবই মুখের বুলি।”

তিনি নিজেই বলেন, রাজনৈতিক সুবিধা নিতে পারতেন, কিন্তু পারেননি—কারণ তা তার আত্মাকে বিদ্ধ করত।“আমি তো মানুষ, কাদা ছোড়াছুড়ি করতে আসিনি।”

‘আমি প্রত্যাহার করছি আমার ভোট ও সমর্থন’

এই আন্দোলনের মুখপাত্র হয়েও তিনি নিজেকে দলবাজ গোষ্ঠীর কাছে ‘একজন অনাহুত প্রতিবাদী’ বলে বর্ণনা করেন। সে কারণেই শেষমেশ তিনি জানান,“আমি অভ্যুত্থানের কথা ভেবে বৈষম্যবিরোধী প্ল্যাটফর্মে যে ভোট দিয়েছি, যে সমর্থন দিয়েছি, সবকিছুই প্রত্যাহার করে নিচ্ছি।”

তিনি এটিও লেখেন,“অনেকের স্বপ্ন, সময় নষ্ট হয়েছে। আমি জানি না প্ল্যাটফর্মের ভবিষ্যৎ কী, তবে আমি আমার আত্মাকে এই রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের ছায়া থেকে সরিয়ে নিচ্ছি।”

‘যারা আমাকে মানসিকভাবে ভেঙেছে, তাদের কখনো ক্ষমা করব না’

উমামা ফাতেমা লেখেন,“আমি জানি, আমাকে যারা কষ্ট দিয়েছে, আমার প্রতি ষড়যন্ত্র করেছে, অভ্যুত্থানকে পণ্য করে রাজনৈতিক লাভ তুলেছে—আমি তাদের কখনোই ক্ষমা করব না। আমি রূহের ভেতর থেকে বদদোয়া দিচ্ছি এই মোনাফেকদের।”

একটি স্বপ্ন ভাঙার গল্প, যা ইতিহাস হয়ে থাকবে

উমামা ফাতেমার স্ট্যাটাস কেবল একটি ব্যক্তিগত পদত্যাগ নয়। এটি বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির অবক্ষয়ের এক উন্মোচিত দলিল। যেখানে ‘বৈষম্যবিরোধী’ নামটি থাকলেও বাস্তবে তার ভেতরে রয়েছে গোষ্ঠীতন্ত্র, নেতৃত্ব চোরাচালান ও আদর্শের বিপর্যয়।

জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থান যেভাবে হাজারো তরুণকে পথে নামিয়েছিল, সেই অভ্যুত্থানের ব্যানারে দাঁড়ানো এক নারীনেত্রীর এই অভিজ্ঞতা আমাদের মনে করিয়ে দেয়—শুধু বিপ্লব ঘটিয়ে নয়, সেটি টিকিয়ে রাখার নেতৃত্বও প্রয়োজন। আর সেই নেতৃত্ব যদি আস্থাহীন হয়, তাহলে অভ্যুত্থানও হয়ে পড়ে ব্যর্থ স্মারক।

? স্ট্যাটাস উৎস: উমামা ফাতেমার ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্ট?️ প্রতিবেদন: সত্তনিউজ ইনভেস্টিগেশন ডেস্ক

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

প্রেস সচিবের বক্তব্যে বাকস্বাধীনতা, মব কালচার ও সাংবাদিকতার দ্বন্দ্ব: পাঠবিশ্লেষণ

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেস সচিব শফিকুল আলম সম্প্রতি এক দীর্ঘ বক্তব্যে দেশের সাংবাদিকতা, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং সরকারের অবস্থান নিয়ে বিস্তারিত... বিস্তারিত