যুদ্ধের পর মুখ খুললেন খামেনি: ইরান নত হয় না, শাস্তি দেয়

বিশ্ব ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুন ২৭ ০০:২১:২১
যুদ্ধের পর মুখ খুললেন খামেনি: ইরান নত হয় না, শাস্তি দেয়

ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে ১২ দিনব্যাপী সংঘর্ষ থেমে যাওয়ার দু’দিন পর, ইসলামী বিপ্লবের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী খামেনি এক গুরুত্বপূর্ণ ভিডিও ভাষণে পুরো জাতির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। ১৩ জুন শুরু হওয়া এই যুদ্ধের পরিণতি এবং এর প্রভাব নিয়ে তিনি সরাসরি কথা বলেন, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল উভয় শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে ইরানের বিজয়কে তিনি ঈশ্বরপ্রদত্ত সফলতা হিসেবে অভিহিত করেন।

খামেনি তাঁর বক্তব্যের শুরুতেই সম্প্রতি সংঘর্ষে শহীদ হওয়া ইরানি কমান্ডার, বিজ্ঞানী এবং সৈনিকদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। তিনি বলেন, এইসব শহীদরা কেবল একটি দেশের জন্য জীবন দেননি, তারা ইসলামী প্রজাতন্ত্রের ভবিষ্যৎকে রক্ষা করেছেন। তাদের আত্মত্যাগের জন্য পরম করুণাময় আল্লাহর দরবারে তারা নিশ্চয়ই উত্তম প্রতিদান লাভ করবেন, এই বিশ্বাসই ইরানের জাতীয় চেতনার অংশ।

এরপর তিনি ধাপে ধাপে তুলে ধরেন ইরানের সাফল্যের দিকগুলো। প্রথমত, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে এই বিজয় ছিল একেবারেই অভাবনীয় ও অচিন্তনীয়। বহুস্তরবিশিষ্ট প্রতিরক্ষা ব্যুহ থাকার পরেও ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র ও উন্নত অস্ত্র প্রযুক্তি ইসরায়েলি শহর ও সামরিক ঘাঁটিগুলোর গভীরে প্রবেশ করে ব্যাপক ধ্বংস চালিয়েছে। খামেনি বলেন, ইসরায়েল এমন আঘাতের সম্ভাবনাও কল্পনা করেনি। অথচ, এই আঘাত বাস্তবে ঘটেছে। তিনি এই সামরিক অর্জনের জন্য আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান এবং একইসঙ্গে দেশের সশস্ত্র বাহিনী ও জনগণের ভূমিকার প্রশংসা করেন।

এরপর তিনি সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের প্রসঙ্গে আসেন। খামেনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুদ্ধে নেমেছে শুধুমাত্র ইসরায়েলের পরাজয় ঠেকাতে। তারা ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায়, যা আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে একটি স্বাধীন মামলার বিষয়। কিন্তু তবুও তারা কোন উল্লেখযোগ্য কৌশলগত অর্জন করতে পারেনি। খামেনি স্পষ্ট করে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট যুদ্ধের পরিস্থিতিকে যেভাবে অতিরঞ্জিত করে তুলে ধরেছেন, তা কেবল তাদের ব্যর্থতা ঢাকতেই। আমেরিকা কেবল ব্যর্থই হয়নি, বরং ইরান তাদের আঞ্চলিক ঘাঁটি আল-উদেইদে পাল্টা হামলা চালিয়ে প্রমাণ করেছে যে প্রয়োজনে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিক্রিয়া জানানো সম্ভব—এবং তা আবারও ঘটতে পারে।

বক্তব্যের তৃতীয় অংশে খামেনি ইরানি জাতির অভূতপূর্ব ঐক্যের কথা বলেন। তিনি বলেন, প্রায় ৯ কোটির এই জাতি রাজনৈতিক মতপার্থক্য ভুলে এক কণ্ঠে সশস্ত্র বাহিনীর পাশে দাঁড়িয়েছে। দেশজুড়ে চলা বিক্ষোভ, সমর্থন, স্লোগান ও জাতীয় সংহতি ইরানকে আরও শক্তিশালী করেছে। এটাই ইরানের প্রকৃত শক্তি "জাতির ঐক্য", যা কোনো বিদেশি শক্তির হাতে পরাজিত হয় না।

বক্তব্যের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অংশে এসে খামেনি মার্কিন প্রেসিডেন্টের সেই মন্তব্যের কড়া সমালোচনা করেন, যেখানে তিনি বলেন, “ইরানকে আত্মসমর্পণ করতে হবে।” খামেনি বলেন, এই ধরনের বক্তব্য শুধুমাত্র অবাস্তব নয়, বরং ইরানি জাতির সম্মান ও ইতিহাসের প্রতি সরাসরি অবমাননা। একটি সভ্যতা, যার সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক সম্পদ আমেরিকার চেয়ে শতগুণ বেশি, সেই জাতিকে আত্মসমর্পণের কথা বলা এটা একটি অবজ্ঞাপূর্ণ এবং বেমানান দাবি।

এই বক্তব্যে খামেনি ইরানি জাতিকে স্মরণ করিয়ে দেন, এই সংঘাত কেবল পারমাণবিক প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণ নয়, বরং জাতীয় স্বাভিমান রক্ষার প্রশ্ন। তিনি বলেন, ইরানি জাতি একটি সম্মানিত জাতি, যারা কখনো আত্মসমর্পণ করেনি এবং ভবিষ্যতেও করবে না। বরং সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় এই জাতি বিজয়ী ছিল, আছে এবং থাকবে।

আয়াতুল্লাহ খামেনির এই বক্তব্য শুধু তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া নয়—এটি ইরানের দীর্ঘমেয়াদী রাষ্ট্রীয় অবস্থান ও ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার একটি পরিষ্কার ঘোষণা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা তার মিত্ররা যদি ইরানকে চাপ দিয়ে নতজানু করার স্বপ্ন দেখে, তাহলে তাদের বুঝতে হবে, এই জাতিকে চাপে ফেলে পরাস্ত করা যায় না। বরং, ইতিহাস বলে, চাপ যত বেড়েছে, প্রতিরোধ তত শক্তিশালী হয়েছে।

এই প্রেক্ষাপটে ‘ইরানের আত্মসমর্পণ’ বিষয়ক দাবি শুধু অযৌক্তিকই নয়, বরং এমন এক রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে অস্বীকার করার নামান্তর, যার মাটি জুড়ে প্রতিরোধই জাতীয় পরিচয়ের মূল উপাদান। সুতরাং, এই বক্তব্য শুধু এক রাজনৈতিক ঘোষণা নয়, এটি এক সাংস্কৃতিক, কৌশলগত ও অস্তিত্বমূলক প্রত্যাঘাত। এবং ইতিহাস বলছে, এমন প্রত্যাঘাতকে অবমূল্যায়ন করার পরিণতি কখনোই হালকা হয় না।

সূত্রঃ তেহরান টাইমস।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ