আলী (রা.) ‘হায়দার’ নামের পেছনের ইতিহাস

ধর্ম ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুন ২৬ ০৯:২২:০৯
আলী (রা.) ‘হায়দার’ নামের পেছনের ইতিহাস

মদিনা থেকে খায়বার, একটি যুদ্ধ একটি উপাধির জন্ম। ‘হায়দার’, যার অর্থ সিংহ, আজও ইসলামি ইতিহাসে সাহসিকতা, আনুগত্য ও বিজয়ের প্রতীক। এই উপাধি অমর হয়েছে হজরত আলী ইবনে আবু তালিব (রা.)-এর নামের সঙ্গে, বিশেষ করে খায়বারের যুদ্ধে তার বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার মধ্য দিয়ে।

খায়বার যুদ্ধ: প্রেক্ষাপট ও গুরুত্ব

খায়বার, যা ছিল ইহুদি গোত্রসমূহের একটি সুরক্ষিত দুর্গনগরী, মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। হিজরতের সপ্তম বছরে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবিদের একটি বাহিনী নিয়ে খায়বার অভিযান পরিচালনা করেন। উদ্দেশ্য ছিল অসত্য ও ষড়যন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দুকে ন্যায় ও শান্তির পথে ফিরিয়ে আনা।

খায়বারের অন্যতম শক্তিশালী দুর্গভেদ অভিযানে যখন একে একে সাহাবিরা পরাজিত হচ্ছিলেন, তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন,“আমি কাল এমন একজনের হাতে পতাকা তুলে দেব, যাকে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল ভালোবাসেন, এবং যিনি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে ভালোবাসেন।”(সহিহ মুসলিম: ৪৫২৭)

পরদিন সেই সম্মানিত দায়িত্ব অর্পিত হয় হজরত আলী (রা.)-এর হাতে। সেই মুহূর্তে আলী (রা.) চোখের সংক্রমণে ভুগছিলেন। রাসুল (সা.) তার চোখে নিজের পবিত্র থুথু লাগিয়ে দোয়া করলে, তাৎক্ষণিকভাবে তিনি সুস্থ হয়ে যান এটিই নবুয়তের অলৌকিক করুণা।

মারহাবের দ্বন্দ্ব ও ‘হায়দার’-এর আত্মপ্রকাশ

যুদ্ধে ইহুদি বীর মারহাব তরবারি দোলাতে দোলাতে এগিয়ে এলো এবং চিৎকার করে নিজের পরিচয় দিল:

قَدْ عَلِمَتْ خَيْبَرُ أَنِّي مَرْحَبُখায়বার জানে ভালো করেই আমি মারহাব অস্ত্রে সুসজ্জিত অভিজ্ঞ যোদ্ধা।

জবাবে হজরত আলী (রা.) উচ্চারণ করেন এক দৃঢ়, সাহসিকতায় ভরপুর কবিতা-

أَنَا الَّذِي سَمَّتْنِي أُمِّي حَيْدَرَهْআমি সেই ব্যক্তি, যার নাম আমার মা রেখেছেন হায়দারঅর্থাৎ সিংহ।

তিনি নিজেকে উপস্থাপন করেন এমন এক অপ্রতিরোধ্য শক্তি হিসেবে, যা ভয়ঙ্কর বন্য সিংহের মতো শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। মারহাবের পূর্বস্বপ্নে সিংহ দ্বারা নিহত হওয়ার ভবিষ্যদ্বাণি হজরত আলী (রা.) জানতেন। সে ভয়কে জাগিয়ে তুলতেই কৌশলে ব্যবহার করেন ‘হায়দার’ নামটি।

এরপর শুরু হয় মরণপণ দ্বন্দ্বযুদ্ধ। আলী (রা.) দিকভ্রান্ত করে শত্রুর মাথায় ভয়ংকর এক তরবারির আঘাত হানেন এবং মারহাব নিহত হন। যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায় মুসলমানদের জন্য আসে বিজয়ের সুর।

আত্মত্যাগ ও নবুয়তের আশ্বাস

এ যুদ্ধে আরও এক হৃদয়বিদারক অধ্যায় ছিল সাহাবি আমির ইবনে আকওয়ার (রা.)-এর আত্মত্যাগ। শত্রুকে আঘাত করতে গিয়ে নিজের তরবারির ঘায়ে তিনি শহিদ হন। কিছু সাহাবি ভুল করে ভেবেছিলেন, এটি আত্মহত্যার শামিল। কিন্তু রাসুলুল্লাহ (সা.) তাদের সংশোধন করে বলেন,“তোমরা ভুল বলেছো। বরং তিনি দ্বিগুণ প্রতিদান পাবেন।”

‘আলীকে ভালোবাসা মানে আল্লাহকে ভালোবাসা’

রাসুল (সা.) নিজ মুখেই ঘোষণা করেন যার হাতে তিনি সেই দিন পতাকা তুলে দেন, তিনি আল্লাহ ও রাসুলের প্রিয়, এবং তিনি নিজেও আল্লাহ ও রাসুলকে ভালোবাসেন। এই বর্ণনা থেকে মুসলিম উম্মাহ বুঝে নিয়েছে হজরত আলী (রা.)-এর মর্যাদা, সাহস এবং আধ্যাত্মিক নৈকট্য।

‘হায়দার’ শুধু একটি আরবি শব্দ নয়, বরং সাহস, দৃঢ়তা, কৌশল ও ঈমানি শক্তির প্রতীক। খায়বারের যুদ্ধের সেই দৃশ্য আজও মুসলমানদের মনে দোলা দেয় যখন একজন বীর, নিজের মায়ের দেয়া নামে, সিংহের মতো শত্রুর সামনে দাঁড়িয়ে যায়; শুধু যুদ্ধ জেতার জন্য নয়, বরং ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য।

এটি এমন এক মুহূর্ত, যেখানে ঈমান, নেতৃত্ব, কৌশল, কবিতা ও করুণা একত্র হয়ে সৃষ্টি করেছে ইসলামী ইতিহাসের এক অনন্য মহাকাব্য।

সূত্র: সহিহ মুসলিম, শরহু মুসলিম লিন-নববী, সিরাত সাহাবা, আল-গার্ডিয়ান ইসলামিক রিভিউ (বিশ্লেষণ)।

লেখক মন্তব্য: আজকের প্রজন্মের কাছে ‘হায়দার’ হওয়া মানে কেবল নাম নয়, ন্যায়ের পথে অটল দাঁড়ানো যত প্রতিকূলতাই আসুক না কেন।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

আমেরযত কাহিনি

আমেরযত কাহিনি

নিজস্ব প্রতিবেদক: স্বাদ, গন্ধ ও পুষ্টিগুণে পরিপূর্ণ ‘আম’ শুধু একটি ফল নয়, বরং এটি ইতিহাস, সংস্কৃতি ও অর্থনীতিতে গভীরভাবে প্রোথিত এক... বিস্তারিত