মতামত

পরিচয় আগে, না মেধা? — বাজার ফান্ডের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও পার্বত্য চট্টগ্রামে বৈষম্যের বাস্তবতা

ওমর ফারুক
ওমর ফারুক
একটিভিস্ট, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা
২০২৫ জুন ২৫ ১২:২৮:১৭
পরিচয় আগে, না মেধা? — বাজার ফান্ডের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও পার্বত্য চট্টগ্রামে বৈষম্যের বাস্তবতা

পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়িতে সম্প্রতি প্রকাশিত একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি আবারও সামনে নিয়ে এসেছে বাংলাদেশের সংবিধান ও বাস্তবতার মধ্যকার একটি গভীর বৈপরীত্য—জাতিগত পরিচয় বনাম নাগরিক সমতা। খাগড়াছড়ি বাজার ফান্ড প্রশাসকের কার্যালয় ১২ জুন ২০২৫ তারিখে একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে, যার ৭ নম্বর শর্তে বলা হয়—“পরিষদের আইন মোতাবেক উপজাতীয় প্রার্থীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।” প্রথম দর্শনে এটি একটি নির্বিকার প্রশাসনিক বাক্য মনে হলেও, গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে এটি স্পষ্টত একটি বৈষম্যমূলক রাষ্ট্রনৈতিক বার্তা, যা শুধু সংবিধানের মৌলনীতি নয়, বরং নাগরিক অধিকারের মেরুদণ্ডকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।

এই ‘অগ্রাধিকার’ কথাটির পেছনে যে আইনগত ব্যাখ্যা দেওয়া হয়, তা পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন, ১৯৮৯ এবং ১৯৯৭ সালের পার্বত্য শান্তিচুক্তির নির্দিষ্ট ধারার ওপর নির্ভরশীল। এই আইনি কাঠামো উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন নিশ্চিতে প্রাথমিকভাবে প্রণীত হলেও সময়ের সাথে সাথে সেটি এখন কিছু ক্ষেত্রে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ ও সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জনগোষ্ঠীকে প্রশাসনিকভাবে পিছিয়ে দেওয়ার অস্ত্রে পরিণত হয়েছে। প্রশ্ন হলো—এই ‘অগ্রাধিকার’ কি সরকারি সাধারণ নিয়োগে সংবিধানসম্মতভাবে প্রযোজ্য?

বাংলাদেশ সংবিধানের ২৯(১) ধারা অত্যন্ত স্পষ্ট—“প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ থাকবে।” অবশ্য ২৯(৩) ধারা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা নির্ধারণের অনুমতি দেয়, তবে সেটি হতে হবে সংখ্যাগত, প্রতিষ্ঠানভিত্তিক ও স্বচ্ছ নীতিমালায়। কিন্তু বাজার ফান্ডের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে কোনো কোটার উল্লেখ নেই, নেই সংরক্ষিত পদের সংখ্যা বা সংজ্ঞা। শুধু একটি অস্পষ্ট শব্দ—“অগ্রাধিকার।” এর অর্থ দাঁড়ায়, একজন বাঙালি প্রার্থী যদি যোগ্যতা ও মেধায় এগিয়ে থাকেন, তবুও তাঁকে পিছিয়ে রেখে উপজাতীয় প্রার্থীকে নিয়োগ দেওয়া যাবে। এটি কি সংবিধান অনুযায়ী বৈধ? অথবা নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য?

বাজার ফান্ড একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানীয় প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান। খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবানের বাজার ব্যবস্থাপনা, হাট ভাড়া, উন্নয়ন প্রকল্প তদারকি প্রভৃতি এ প্রতিষ্ঠানের আওতাভুক্ত। অথচ স্থানীয় বাঙালিরা অভিযোগ করছেন, এইসব নিয়োগে ক্রমাগত উপজাতীয় প্রার্থীদের একচেটিয়া নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, অনেক সময় কোনো লিখিত পরীক্ষা ছাড়াই মৌখিক পরীক্ষার ভিত্তিতে। এতে একটি সংবিধানসম্মত রাষ্ট্রব্যবস্থায় মেধা, প্রতিযোগিতা ও নাগরিক সমতার ধারণা বারবার লঙ্ঘিত হচ্ছে।

আরও উদ্বেগের বিষয় হলো—বাজার ফান্ডের মতো প্রতিষ্ঠান পরিচালনার বোর্ডে বাঙালি সদস্যরাও থাকেন। তাহলে তাঁদের ভূমিকা কোথায়? তাঁরা কি এসব বৈষম্যমূলক শর্তের বিরুদ্ধে কোনো বক্তব্য দেননি? নাকি রাজনৈতিক চাপ অথবা আত্মঘাতী নীরবতার কারণে তাঁরা কেবল ‘আনুগত্য’ পালন করেছেন? এভাবে যদি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে এক পক্ষের ইচ্ছা ও আধিপত্যই মুখ্য হয়ে ওঠে, তাহলে স্থানীয় গণতন্ত্র ও বহুত্ববাদ কীভাবে টিকে থাকবে?

এখানে একটি বড় প্রশ্ন হলো—বাংলাদেশ কি ক্রমে তার সংবিধানিক আদর্শ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে? একটি রাষ্ট্রের জন্য জাতিগত বৈচিত্র্য নিঃসন্দেহে এক ধরনের সম্পদ। তবে সেই বৈচিত্র্য যদি বৈষম্যের ভিত্তিতে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নির্ধারণ করতে শুরু করে, তাহলে সেটি আর সম্প্রীতি থাকে না, তা হয়ে ওঠে রাষ্ট্রীয় পক্ষপাত ও সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর বঞ্চনার নেপথ্য রূপরেখা। পার্বত্য চট্টগ্রামের অনেক উপজাতীয় জনগোষ্ঠী অতীতে বঞ্চনার শিকার হয়েছে, এটিও অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু বঞ্চনা কাটাতে গিয়ে যদি অন্য এক পক্ষকে নতুন করে বঞ্চনার শিকার করা হয়, তাহলে সেটি রাষ্ট্রের মূলনীতি—সমতা, ন্যায় ও নাগরিকত্বের মৌলিকতা—কে ধ্বংস করে দেয়।

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে কিছু তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ জরুরি। বাজার ফান্ডের বিতর্কিত শর্তটি অবিলম্বে পর্যালোচনা ও সংশোধন করতে হবে। “অগ্রাধিকার” কথাটির স্পষ্ট সংজ্ঞা ও সীমা নির্ধারণ করতে হবে—তা কি একবারের সুযোগ, নাকি চলমান একচেটিয়া প্রবণতা? পাশাপাশি স্থানীয় বাঙালি সমাজকে সংগঠিতভাবে সোচ্চার হতে হবে। গণমাধ্যম, মানবাধিকার সংস্থা ও বিচার বিভাগের পক্ষ থেকেও এই বৈষম্যমূলক প্রশাসনিক দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে সরব হওয়ার এখনই সময়।

অন্যথায়, মেধার জায়গায় পরিচয় এবং ন্যায়ের জায়গায় পক্ষপাত প্রতিষ্ঠিত হলে তা শুধু পাহাড় নয়, সমগ্র রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিত্তিকে দুর্বল করে তুলবে। শান্তি, উন্নয়ন ও সম্প্রীতির জন্য চাই বৈষম্যহীন সমতা—জাতিগত অগ্রাধিকার নয়।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

আমেরযত কাহিনি

আমেরযত কাহিনি

নিজস্ব প্রতিবেদক: স্বাদ, গন্ধ ও পুষ্টিগুণে পরিপূর্ণ ‘আম’ শুধু একটি ফল নয়, বরং এটি ইতিহাস, সংস্কৃতি ও অর্থনীতিতে গভীরভাবে প্রোথিত এক... বিস্তারিত