চিত্র নয়, চেতনা—‘দি লাস্ট সাপার’ কেন আজও আলোচনার কেন্দ্রে?

ধর্ম ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুন ২১ ১৪:৪৪:৪০
চিত্র নয়, চেতনা—‘দি লাস্ট সাপার’ কেন আজও আলোচনার কেন্দ্রে?

“দি লাস্ট সাপার”—শুধু একটি চিত্রকর্মের নাম নয়, বরং একটি রাত, একটি টেবিল ও কিছু মানুষের উপস্থিতিতে রচিত হয়েছিল এমন এক ইতিহাস, যা আজও হাজার বছর ধরে রহস্য, ভাবনা ও বিতর্কের জন্ম দিয়ে চলেছে। এটি কি কেবল যিশু খ্রিস্টের শেষ আহার ছিল? নাকি এই ভোজের পেছনে লুকিয়ে ছিল গভীর রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র, ঘনিষ্ঠ কারও বিশ্বাসঘাতকতা এবং আত্মত্যাগের এক অলঙ্ঘনীয় আখ্যান?

এই ভোজের শুরু এক নিখাদ উৎসবের উপলক্ষে। ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের জন্য পাসোভার একটি পবিত্র স্মারক—যেখানে তারা স্মরণ করে সেই ঐতিহাসিক রাতকে, যেদিন মিসরের দাসত্ব থেকে মুক্তির উদ্দেশ্যে তারা মুসা (আ.)-এর নেতৃত্বে যাত্রা শুরু করেছিল। সেই মুক্তির স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে প্রতি বছর আয়োজন করা হয় “সেদার মিল” নামের এক বিশেষ নৈশভোজ। সেখানে যে প্রতিটি উপাদান পরিবেশিত হয়—ম্যাটজাহ, তিতা শাকসবজি, আঙুরের রস ও ভাজা হাড়—তা কেবল খাদ্য নয়, প্রতীক হয়ে ওঠে একটি জাতির কষ্ট, সংগ্রাম ও ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞতার।

এই সেদার মিল-ই হয়ে উঠেছিল যিশুর সেই শেষ নৈশভোজ। বাইবেলের বর্ণনা অনুযায়ী, যিশু তাঁর বারোজন শিষ্যকে নিয়ে এই পবিত্র রাতে একত্র হন। তবে রাতটি ছিল নিছক কোনো উৎসব নয়, বরং এক ভবিষ্যদ্বাণীর মুখোমুখি হওয়ার সময়। খাওয়ার মাঝপথে যিশু বলেন, “তোমাদের মধ্যে একজন আজ রাতেই আমাকে বিশ্বাসঘাতকতা করবে।” সে মানুষটি ছিলেন জুডাস ইসকারিয়ট, যিনি রোমানদের হাতে যিশুকে তুলে দেন মাত্র ত্রিশ রৌপ্যমুদ্রার বিনিময়ে।

এই ভোজেই যিশু প্রথম বলেন, “এই রুটি আমার দেহ, এই মদ আমার রক্ত—তোমরা এটি স্মরণে কর।” এখান থেকেই খ্রিস্টধর্মে শুরু হয় পবিত্র আচার Holy Communion—যেখানে যিশুর আত্মত্যাগের স্মরণে এই রীতি পালন করেন তাঁর অনুসারীরা।

এই গভীর রাতের ইতিহাসকে অমর করে রাখেন শিল্পী লিওনার্দো দা ভিঞ্চি। তাঁর বিখ্যাত চিত্রকর্ম The Last Supper চিত্রায়িত করে যিশু ও তাঁর শিষ্যদের সেই মুহূর্ত—যেখানে প্রত্যেক মুখে প্রতিফলিত হয় বিস্ময়, সংশয়, এবং গভীর বোধ। বিশেষ করে জুডাসের ছায়াময় মুখ ও বাকিদের প্রতিক্রিয়া আজও বিশ্বজুড়ে আলোচনার বিষয় হয়ে আছে। এই চিত্রকর্ম কেবল এক শিল্প নয়, এক সমুদ্রযাত্রার দরজা—যেখানে প্রতিটি তুলির আঁচড়ে ফুটে ওঠে বিশ্বাস, ভাঙন ও বিদায়ের কান্না।

‘দি লাস্ট সাপার’ তাই একদিকে পাসোভার উৎসবের ঐতিহাসিক তাৎপর্য বহন করে, অন্যদিকে হয়ে ওঠে আত্মত্যাগের নিদর্শন। এই একটি ভোজেই মিলেমিশে যায় দুই ধর্ম, দুই পথ—ইহুদি ও খ্রিস্টান। একদিকে দাসত্ব থেকে শারীরিক মুক্তি, অন্যদিকে ঈশ্বরের পরিকল্পনায় যিশুর আত্মিক পরিণতি—এই দুই ধারা এসে মিলিত হয় একটি টেবিলের চারপাশে।

আজকের এই বিশ্বে, যেখানে ঘৃণা, বিভক্তি ও আত্মস্বার্থের প্রাচুর্য দেখা যায়, ‘দি লাস্ট সাপার’ আমাদের শেখায় এক অনন্য পাঠ। শারীরিক মুক্তি তখনই অর্থবহ হয়, যখন তা মেলে মানসিক ও নৈতিক উচ্চতায়। এবং বিশ্বাসঘাতকতা কখনো কখনো আসে সবচেয়ে কাছের মানুষদের হাত থেকেই। এই নৈশভোজ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আত্মত্যাগ, করুণা ও ঈশ্বরের প্রতি নিঃশর্ত আস্থা—এই তিনই মানুষকে পৌঁছে দেয় প্রকৃত মুক্তির পথে।

তাই, ‘দি লাস্ট সাপার’ কেবল একটি ছবি নয়—এটি ইতিহাস, ধর্ম এবং মানবিক চেতনার এমন এক সংযোগবিন্দু, যেখানে একরাত্রির খাবার হয়ে ওঠে এক চিরন্তন আলো, যা যুগে যুগে মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেয়—সবচেয়ে গভীর সত্যগুলো কখনও কখনও রচিত হয় নীরব টেবিলের চারপাশে।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

স্টারমারের নীরবতা: কূটনৈতিক শিষ্টাচার বনাম রাজনৈতিক সংকোচ

স্টারমারের নীরবতা: কূটনৈতিক শিষ্টাচার বনাম রাজনৈতিক সংকোচ

একজন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ, সামাজিক ব্যবসার পথপ্রদর্শক এবং গণতান্ত্রিক উত্তরণের নেতৃত্বদানকারী রাষ্ট্রনায়ক—এই তিনটি পরিচয়ই এখন সমভাবে প্রযোজ্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের... বিস্তারিত