যুদ্ধবিগ্রহেও মুমিনের অন্তর শান্ত কেন?

ধর্ম ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুন ২০ ১২:১৬:৩৩
যুদ্ধবিগ্রহেও মুমিনের অন্তর শান্ত কেন?

আধুনিক জীবনের জটিলতা, প্রতিযোগিতা আর ক্রমবর্ধমান চাহিদার দৌড়ে মানুষ এক অদ্ভুত অস্থিরতার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। উপার্জনের প্রতিযোগিতা, পার্থিব ভোগ-বিলাসের প্রতি অতিরিক্ত আকর্ষণ, আর অনিয়ন্ত্রিত অপচয়—এসবই মানুষের মানসিক ভারসাম্যকে ভেঙে দিচ্ছে। এর ফলস্বরূপ সমাজজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে ভয়, উদ্বেগ ও হতাশার কালো ছায়া। যুদ্ধবিগ্রহ ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এই অস্থিরতা আরও গভীর করে তুলছে। অথচ একজন প্রকৃত মুমিন এই সময়েও অবিচল থাকে। তার অন্তর থাকে শান্ত, মন থাকে স্থির, কারণ সে জানে—তার একমাত্র ভরসা আল্লাহ।

পার্থিব অজানা শঙ্কার বিপরীতে ইসলাম একজন মুমিনকে আত্মিক দৃঢ়তা অর্জনের জন্য কিছু নির্দিষ্ট পথ দেখায়। এর প্রথম ধাপ হলো আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করা। যারা আল্লাহকে ভয় করে, তাঁর নির্দেশ পালন করে এবং সৎকাজে লিপ্ত থাকে, আল্লাহ তাদের সঙ্গে থাকেন। এই সঙ্গ একজন মুমিনকে ভয়হীন করে তোলে, আত্মবিশ্বাসে পরিপূর্ণ করে। কেননা যে ব্যক্তি জানে তার পাশে সবসময় সর্বশক্তিমান এক অভিভাবক রয়েছেন, তার জন্য শত্রু বা শঙ্কা—কোনোটিই বড় কিছু নয়।

যখন একজন মুমিন বিশ্বাস করে যে তার জীবনের প্রতিটি বিষয় আল্লাহর ইচ্ছায় নির্ধারিত, তখন তার মাঝে ধৈর্যের গুণাবলি জন্ম নেয়। সে অপেক্ষা করে আল্লাহর রহমতের, জানে—রিজিক, সুস্থতা কিংবা সফলতা, সবই আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত সময়েই আসে। রাসুল (সা.) বলেছেন, আল্লাহ নিজেই বলেন, ‘আমি তেমনই, যেরকম বান্দা আমার সম্পর্কে ধারণা রাখে।’ এই হাদিস মুমিনকে আশাবাদী হতে শেখায়।

বিশ্বাসের এই শক্তিময় দৃষ্টান্ত দেখা যায় হাজেরা (আ.)-এর জীবনে। যখন ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর নির্দেশে স্ত্রী হাজেরা ও শিশু ইসমাঈলকে নির্জন মরুভূমিতে রেখে যান, সেখানে কোনো পানি, খাদ্য বা মানুষের অস্তিত্ব ছিল না। এই অবস্থায় তিনি আল্লাহর আদেশে নিশ্চুপভাবে ফিরে যান। তখন হাজেরা (আ.) জানতে চেয়েছিলেন, ‘এটি কি আল্লাহর আদেশ?’—জবাবে ইবরাহিম (আ.) বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ’। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘তাহলে নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদের অবহেলা করবেন না।’ এই এক বাক্যের বিশ্বাস আজও মুসলিম হৃদয়ে ঈমানের উৎস হিসেবে জীবন্ত। আর আল্লাহ তাঁর জন্য উপহার দিলেন জমজমের পবিত্র ঝরনা, যা অদ্যাবধি অক্ষয় প্রবাহে বিশ্বের কোটি মানুষকে তৃষ্ণা নিবারণের সুযোগ দিচ্ছে।

পার্থিব ভয় ও অস্থিরতা থেকে মুক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আশ্রয় হলো নামাজ। এটি শুধু ইবাদত নয়, বরং একধরনের আত্মিক সংযোগ যা একজন মানুষকে আল্লাহর কাছাকাছি নিয়ে যায়। যখনই রাসুল (সা.) কোনো বিপদে পড়তেন, দুশ্চিন্তা ঘিরে ধরত, তখন তিনি নামাজে দাঁড়িয়ে যেতেন। কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো।’ এই আয়াত একজন মুমিনের জীবনের পথচলায় অবিচল থাকার মূলমন্ত্র।

আল্লাহর অসীম দয়ার স্মরণ করাও একজন মুমিনকে ভয়হীন রাখে। কোরআনে বলা হয়েছে, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের ভুলত্রুটির উপযুক্ত শাস্তি যদি দিতেন, তবে এই দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যেত। কিন্তু তিনি ধৈর্যশীল, ক্ষমাশীল ও রিজিকদাতা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর চেয়ে কেউ বেশি ধৈর্যশীল নন। মানুষ তাঁকে অনেক কষ্ট দেয়, তবুও তিনি তাদের সুস্থ রাখেন, রিজিক দেন।’ এই রহমতের অনুভূতি একজন মুমিনের হৃদয়কে প্রশান্তিতে ভরিয়ে তোলে।

আল্লাহর প্রতি নির্ভরতা যে শুধু বিশ্বাস নয়, বরং জীবনের এক শক্তিশালী বাস্তবতা—তাও স্মরণ রাখা জরুরি। তিনি বলেন, ‘আমি আমার রাসুলদের এবং যারা ঈমান এনেছে, তাদের রক্ষা করি। এভাবেই মুমিনদের রক্ষা করা আমার দায়িত্ব।’ মুমিন জানে, দুনিয়ার কোনো কিছুই আল্লাহর অনুমতি ছাড়া তার কোনো ক্ষতি করতে পারে না। এই আত্মিক চেতনা পার্থিব ভয় থেকে মুক্তির চাবিকাঠি।

এই বিশ্বাসই একজন মুমিনকে আলাদা করে তোলে—সে ভেঙে পড়ে না, বিচলিত হয় না, বরং ধৈর্য ধরে সময়ের অপেক্ষায় থাকে। সে জানে, যিনি পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, তিনিই তার সমস্যা সমাধানেরও মালিক। তাই সে চেয়ে থাকে শুধু আল্লাহর দয়ার দিকে। ভয় ও অস্থিরতার এই সময়ে তাই আমাদের প্রয়োজন এই পরম বিশ্বাসের দিকে ফিরে যাওয়া, যেখানে প্রত্যেক আতঙ্কের জবাব একটিই—“আমরা তোমারই ইবাদত করি, তোমারই সাহায্য চাই।”

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

স্টারমারের নীরবতা: কূটনৈতিক শিষ্টাচার বনাম রাজনৈতিক সংকোচ

স্টারমারের নীরবতা: কূটনৈতিক শিষ্টাচার বনাম রাজনৈতিক সংকোচ

একজন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ, সামাজিক ব্যবসার পথপ্রদর্শক এবং গণতান্ত্রিক উত্তরণের নেতৃত্বদানকারী রাষ্ট্রনায়ক—এই তিনটি পরিচয়ই এখন সমভাবে প্রযোজ্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের... বিস্তারিত