দুদকের জালে এবার আওয়ামী ‘ডিগবাজি নেতা’

একসময় জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য, পরে বিএনপির উপজেলা চেয়ারম্যান, সর্বশেষ আওয়ামী লীগ নেতা এভাবেই বারবার রাজনৈতিক দল বদলে ক্ষমতার শীর্ষে টিকে থেকে বিপুল অবৈধ সম্পদের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন নুর মোহাম্মদ মণ্ডল। আজ সেই সাম্রাজ্য ভেঙে পড়তে শুরু করেছে।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা মামলায় আয় বহির্ভূত অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে বৃহস্পতিবার রংপুরের সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালত তাকে জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন।
আদালতে জামিনের আবেদন করলে বিচারক ফজলে খোদা মো. নাজির আবেদন নামঞ্জুর করেন এবং তার বিপুল সম্পত্তি ও আর্থিক সম্পদ ক্রোকের আদেশ দেন।
তিন দলের রাজনীতি, তিনবার উপজেলা চেয়ারম্যান, দুইবার এমপি সর্বশেষ কাঠগড়ায়নুর মোহাম্মদ মণ্ডলের রাজনৈতিক জীবন যেন বাংলাদেশের সুবিধাবাদী রাজনীতির এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি।
- প্রথমে জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে হাতেখড়ি, তিনি দুইবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
- পরে বিএনপির ছায়ায় উপজেলা চেয়ারম্যান হন।
- সর্বশেষ আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে আবার উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
রাজনৈতিকভাবে বারবার রঙ বদলে স্থানীয় প্রশাসন ও দলীয় প্রভাব কাজে লাগিয়ে গড়ে তুলেছেন বিপুল বিত্তবৈভব যার মধ্যে অন্যতম ‘আনন্দনগর’ নামে একটি বিতর্কিত বিনোদন পার্ক।
দুদকের রংপুর সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপ-সহকারী পরিচালক রুবেল হোসেন জানান, পীরগঞ্জে ৩১৩০.৭৩ একর জমির ওপর আনন্দনগর নামে একটি পিকনিক স্পট ও বাণিজ্যিক বিনোদন কেন্দ্র গড়ে তোলেন নুর মোহাম্মদ মণ্ডল, যার বড় একটি অংশ বন বিভাগের জমি।
তদন্তে উঠে এসেছে, তিনি স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে বনভূমি দখল করে সেখানে পার্ক, কৃত্রিম লেক, রিসোর্ট, রেস্টুরেন্ট ও ব্যবসায়িক স্থাপনা গড়ে তোলেন।
এই বিনোদন পার্কটি দীর্ঘদিন ধরে ‘আনন্দনগর’ নামে পরিচিত এবং স্থানীয় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠলেও এর প্রকৃত মালিকানা ও জমির দখল নিয়ে বারবার বিতর্ক তৈরি হয়।
দুদক আরও জানিয়েছে, নুর মোহাম্মদ মণ্ডলের নামে আটটি ব্যাংক হিসাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ গচ্ছিত রয়েছে, যার কোনও বৈধ উৎস তিনি দেখাতে পারেননি।এছাড়াও স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের মধ্যে রয়েছে ফ্ল্যাট, জমি, যানবাহন, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, যার মোট মূল্য প্রায় ৯ কোটি টাকা।
২০২০ সালে দুদক তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে সম্পদের তথ্য গোপন ও জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে। তদন্ত চলাকালে তার বিরুদ্ধে একাধিক অস্থাবর সম্পদের গোপন তথ্য বেরিয়ে আসে, যা তার দাখিলকৃত আয়কর নথির সঙ্গে মেলেনি।
নুর মোহাম্মদ মণ্ডল ছিলেন একাধিকবার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। তাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় রাজনৈতিক বলয় ও প্রশাসনের কিছু অংশের মধ্যে অজানা আতঙ্ক ও প্রভাব বিস্তার ছিল দীর্ঘদিন ধরে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, বন বিভাগের কর্মকর্তারা জমি পুনরুদ্ধারে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হন তার রাজনৈতিক প্রভাব ও ক্ষমতার প্রাচীরে আটকে গিয়ে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মণ্ডলের বিরুদ্ধে আদালতের সিদ্ধান্ত দৃষ্টান্তমূলক হলে ভবিষ্যতে এমন সুবিধাবাদী রাজনৈতিক চক্রগুলো নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। কারণ, তিনটি জাতীয় দলের ছায়ায় গড়ে ওঠা তার সাম্রাজ্য কোনো একক ব্যর্থতার ফল নয়, বরং ব্যবস্থাগত দুর্বলতা ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার একটি জটিল মিশেল।
দুদকের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, মামলার পরবর্তী ধাপে তদারকিমূলক অনুসন্ধান ও রাষ্ট্রের মালিকানাধীন জমির পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া শুরু করা হবে।
বন বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “এটা শুধু একটি ব্যক্তির দুর্নীতি নয়, এটা পুরো একটি ব্যবস্থার ব্যর্থতা। আমরা দীর্ঘদিন ধরে জমি উদ্ধারের চেষ্টা করেছি কিন্তু ব্যর্থ হয়েছি।”
নুর মোহাম্মদ মণ্ডল ছিলেন ‘ডিগবাজি নেতা’ নামে পরিচিত দলবদলের জন্য নয়, বরং সেই দৃষ্টান্তহীন অনিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রতীক হিসেবে।
আজ তার বিরুদ্ধে আইননির্ভর ব্যবস্থা ও সম্পদ বাজেয়াপ্তির নির্দেশ রাষ্ট্রের পক্ষে এক সাহসী অগ্রগতি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে যদি তা বাস্তবায়ন হয় নিরপেক্ষভাবে ও সম্পূর্ণ স্বচ্ছতার সঙ্গে।
-রফিক, নিজস্ব প্রতিবেদক
পাঠকের মতামত:
আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ
- ভবিষ্যতের গণতন্ত্র না পুরাতনের পুনরাবৃত্তি? ইউনুস-তারেক সাক্ষাৎ পর্যালোচনা
- জুলাই চার্টার ও জাতীয় ঐকমত্য: জামায়াতের অনুপস্থিতি কতটা যুক্তিসঙ্গত?
- বিশ্ববিদ্যালয় সংকট, বাজেট বৈষম্য ও শিক্ষায় ন্যায্যতার দাবি
- ইউনূস-তারেক ঐতিহাসিক ও সফল বৈঠক: সংস্কার, একতা ও ন্যায়বিচার— এই তিন স্তম্ভে গড়ে উঠুক নতুন বাংলাদেশ
- উৎসব: ঈদের পর্দায় অনবদ্য এক উদযাপন
- Clash of Civilizations: মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধের নতুন রূপরেখা
- চলমান সংঘাতে ইসরায়েলের ১০টি বড় ক্ষতি
- মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ভূ-রাজনৈতিক আধিপত্যের নতুন কৌশল: চীন ও রাশিয়া কী করবে?
- জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে মুখোমুখি বিশ্ব শক্তিগুলো
- ইসরায়েলে ইরানি মিসাইল, নিহত অন্তত ৭
- তুরস্ক, সৌদি, ইরান-পাকিস্তানের হাতে ‘ইসলামিক আর্মি’ গঠন! কি হতে যাচ্ছে?
- ভোক্তার কষ্ট বুঝছে সরকার:বাণিজ্য উপদেষ্টা
- ২৮ জুন ঢাকায় জনতার ঢল: সোহরাওয়ার্দী উদ্যান হবে মহাসমুদ্র!
- এবার পাকিস্তানকে হামলার হুমকি দিল ইসরায়েল
- ইসরায়েল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে রাশিয়ার সতর্কবার্তা