মতামত

জুলাই চার্টার ও জাতীয় ঐকমত্য: জামায়াতের অনুপস্থিতি কতটা যুক্তিসঙ্গত?

রাইয়ান হোসেন
রাইয়ান হোসেন
শিক্ষক ও রাজনৈতিক গবেষক
২০২৫ জুন ১৮ ০১:৪৫:১৭

বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যখন নতুন এক অধ্যায় রচিত হচ্ছে—আন্তর্বর্তী সরকারের তত্ত্বাবধানে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যখন ভবিষ্যতের রূপরেখা নির্মাণে সংলাপ-আলোচনায় ব্যস্ত, তখন অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক শক্তি জামায়াতে ইসলামী (জেইআই) আজকের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এ সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক মহলে যেমন প্রশ্ন তুলেছে, তেমনি জাতির জন্য ঐক্যগঠনের যে পরিশ্রম চলছে, তার জন্যও এটি এক অপূর্ণতা হয়ে রইল।

জেইআই তাদের অনুপস্থিতির পেছনে যুক্তি হিসেবে তুলে ধরেছে লন্ডনে অনুষ্ঠিত প্রফেসর ইউনূস ও তারেক রহমানের সাম্প্রতিক সাক্ষাৎ এবং তার পরবর্তীতে প্রকাশিত যৌথ বিবৃতিতে জামায়াতকে উপেক্ষা করা হয়েছে বলে তাদের ক্ষোভ। বিষয়টি তারা রাজনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতির পরিপন্থী বলে আখ্যা দিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই প্রতিক্রিয়ার গভীরে কি কেবল আত্মসম্মানবোধ, নাকি এতে জড়িয়ে আছে ভবিষ্যৎ ক্ষমতা রাজনীতির সূক্ষ্ম কৌশল?

একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, জামায়াতে ইসলামি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি, যাকে বারবারই নির্যাতন, নিষেধাজ্ঞা ও রাজনৈতিক দমন-পীড়নের মুখোমুখি হতে হয়েছে, বিশেষত আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ববাদী শাসনামলে। শেখ হাসিনার ভারত গমনের পর এবং সরকারের পতনের পরে, জেইআই বারবার পরিপক্ব রাজনৈতিক আচরণের পরিচয় দিয়ে জাতির ঐক্য ও স্থিতিশীলতার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। আওয়ামী লীগের পতনের পরবর্তী রাজনৈতিক শূন্যতায়, বিএনপি, জামায়াত ও নবগঠিত এনসিপি—এই তিনটি দল এখন দেশের রাজনৈতিক ভারসাম্যের মূল ভিত্তি। এবং প্রতিটি দলই নিজের অবস্থান অনুযায়ী কৌশল নির্ধারণ করছে, যা গণতন্ত্রের অংশ হিসেবেই স্বীকৃত।

প্রসঙ্গত, অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যকার সম্পর্ক প্রথমদিকে কিছুটা শীতল ছিল। সে সময় অনেকেই জামায়াত-এনসিপি ঘনিষ্ঠতার গুঞ্জন তুলেছিলেন। তবে সেই দৃশ্যপট পাল্টাতে শুরু করে জামায়াতের আমির ড. শফিকুর রহমান যখন খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেন। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি থেকে যায়—এই সাক্ষাৎ কি বাংলাদেশে হয়েছিল? না, বরং এটি বিদেশে, উচ্চপর্যায়ের গোপনীয়তায় আয়োজিত হয়, যেখানে গণমাধ্যমের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। এ বৈঠকের মূল বার্তা ছিল সুস্পষ্ট: বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভাগ্য এখন আর শুধু ঢাকার রাজপথে নয়, বরং আন্তর্জাতিক অঙ্গন বিশেষত লন্ডন থেকেও নির্ধারিত হচ্ছে।

এ বাস্তবতায় আসে ইউনূস-তারেক সাক্ষাৎ। অনেক বিতর্কের জন্ম দেওয়া এই সাক্ষাৎ, ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমঝোতার একটি সূচনা। এটি ছিল সময়োপযোগী, প্রয়োজনীয় এবং দেশের দীর্ঘস্থায়ী স্থিতিশীলতার সম্ভাব্য ভিত্তি। স্বভাবতই, যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বৈঠকের ক্ষেত্রে একটি যৌথ বিবৃতি কাম্য, যাতে গুজব, ভুল ব্যাখ্যা কিংবা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচার ঠেকানো যায়। কিন্তু যেভাবে কিছু রাজনৈতিক দল এ বৈঠককে ঘিরে ক্ষোভ প্রকাশ করছে, তাতে রাজনৈতিক পরিণতিবোধের ঘাটতি স্পষ্ট। এমনকি তারা এই সভার খবর জানার পরও তার পূর্বেই মুখর ছিল, যা ইঙ্গিত দেয়—এখানে আপত্তির চেয়েও হয়তো ছিল অস্বস্তি ও অনিশ্চয়তার প্রতিক্রিয়া।

আমরা একটি ব্যতিক্রমী সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, যেখানে বহু রাজনৈতিক রীতিনীতির পুনর্বিন্যাস ঘটছে। অতএব, এমন কিছু ঘটনা ঘটবেই, যা হবে অভূতপূর্ব। সেটিকে বুঝতে না পারা, কিংবা তা থেকে দূরে থাকা—একটি দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দলের জন্য কাম্য নয়।

জামায়াতে ইসলামী যদি মনে করে যে অন্তর্বর্তী সরকার কোনো পক্ষপাতদুষ্ট অবস্থান নিচ্ছে বা তাদের যথাযথভাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি, তাহলে তা লিখিতভাবে প্রধান উপদেষ্টার কাছে উপস্থাপন করা যেত। কিন্তু ‘জুলাই চার্টার’-এর মতো একটি ঐতিহাসিক, ভবিষ্যতমুখী দলিলের পরামর্শসভা থেকে পুরোপুরি অনুপস্থিত থাকা রাজনৈতিক অগ্রাধিকার নয়, বরং একটি অকালপ্রসূ প্রতিক্রিয়া।

জুলাই চার্টার কেবল অন্তর্বর্তী সরকারের দলিল নয়—এটি হচ্ছে একটি রোডম্যাপ, যা বাংলাদেশের নতুন যাত্রাপথের মানচিত্র। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার বিপ্লব যে পরিবর্তনের সম্ভাবনার দ্বার খুলেছিল, এই চার্টার সেই স্বপ্নের গঠনমূলক রূপ। এবং যে কোনো রাজনৈতিক দল এই রূপরেখা থেকে নিজেকে দূরে রাখলে, তা ঐ আন্দোলনের চেতনার প্রতিও এক ধরনের অসম্মান।

এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে অন্যান্য প্রধান রাজনৈতিক দলও হয়তো অন্তর্বর্তী সরকারের সব পদক্ষেপে সন্তুষ্ট নয়। কিন্তু তা বলে সম্পূর্ণ আলোচনা পর্ব বর্জন করা দায়িত্বশীল রাজনৈতিক চর্চার পরিপন্থী। ভিন্নমত থাকা স্বাভাবিক, তবে জাতির সম্ভাব্য ভবিষ্যতকে বিতর্কিত করে তোলাটা অমার্জনীয়। কারণ এই চার্টারই সম্ভবত বাংলাদেশের জন্য ‘Version 2.0’-এর দিকনির্দেশক হয়ে উঠতে পারে।

-

লেখক রাইয়ান হোসেন ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি,বাংলাদেশ (আইইউবি) এর গ্লোবাল স্টাডিজ ও গভার্নেন্স বিভাগে লেকচারার হিসেবে নিযুক্ত। তবে তিনি বর্তমানে যুক্তরাজ্যের নটিংহাম ইউনিভার্সিটিতে "রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক" নিয়ে পিএইচডি করছেন। ইমেইল:[email protected]

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

স্টারমারের নীরবতা: কূটনৈতিক শিষ্টাচার বনাম রাজনৈতিক সংকোচ

স্টারমারের নীরবতা: কূটনৈতিক শিষ্টাচার বনাম রাজনৈতিক সংকোচ

একজন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ, সামাজিক ব্যবসার পথপ্রদর্শক এবং গণতান্ত্রিক উত্তরণের নেতৃত্বদানকারী রাষ্ট্রনায়ক—এই তিনটি পরিচয়ই এখন সমভাবে প্রযোজ্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের... বিস্তারিত