লিভারপুলের আক্রমণভাগের প্রাণভোমরা মোহামেদ সালাহ—দলটির ‘মিশরের রাজা’ হিসেবে পরিচিত। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তাঁর সেই মুকুট যেন একটু বিবর্ণ হয়ে উঠেছে। গোলের সামনে নিষ্প্রভতা আর মাঠে কমে যাওয়া কর্মস্পৃহা নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছেন এই তারকা ফরোয়ার্ড।
শনিবার চেলসির বিপক্ষে ২-১ গোলে পরাজয়ের ম্যাচে সালাহর পারফরম্যান্স ছিল আশানুরূপ নয়। একাধিক সুযোগ হাতছাড়া করেন তিনি, আর রক্ষণভাগে কোনো সহায়তাও দিতে পারেননি। লিগে এ পর্যন্ত সাত ম্যাচে পাঁচটিতেই গোলশূন্য থাকার ফলে লিভারপুলের আক্রমণভাগে স্পষ্ট প্রভাব পড়েছে।
চেলসির বিপক্ষে পরাজয় ছিল লিভারপুলের আট দিনের মধ্যে তৃতীয় হার। এর ফলে শীর্ষস্থানটি এখন চলে গেছে আর্সেনালের দখলে। সালাহ এ মৌসুমে সব মিলিয়ে নয় ম্যাচে করেছেন মাত্র তিন গোল ও তিনটি অ্যাসিস্ট—যা তাঁর মতো খেলোয়াড়ের মানদণ্ডে অনেকটাই গড়পড়তা।
সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, ৩৩ বছর বয়সী সালাহর মাঠে অনাগ্রহের লক্ষণ। চেলসির বিপক্ষে ডানদিক দিয়ে একের পর এক আক্রমণ আসলেও সালাহকে দেখা যায়নি রক্ষণে সাহায্য করতে। তাঁর পাশে খেলতে থাকা ডান-ব্যাক কনর ব্র্যাডলি প্রথমার্ধেই হলুদ কার্ড দেখেন এবং পরের অর্ধে বদলি হন—কারণ ডান প্রান্তের চাপ তিনি একা সামলাতে পারছিলেন না।
শেষ মুহূর্তে চেলসির ব্রাজিলিয়ান তরুণ এস্তেভাও উইলিয়ানের জয়সূচক গোলও আসে সালাহর দিক দিয়েই। চেলসির ফুলব্যাক মার্ক কুকুরেলা বিনা প্রতিরোধে এগিয়ে গিয়ে গোলের পাস দেন। পরে কুকুরেলা জানান, তাদের কোচ এনজো মারের্সকা আগেই বলেছেন সালাহর ফাঁকা জায়গা কাজে লাগাতে, কারণ তিনি সাধারণত রক্ষণে ফিরেন না।
ফর্মহীনতার ধারাবাহিকতা ও পুরনো সাফল্যের ছায়া
গত মৌসুমের শেষ ভাগ থেকেই সালাহর ফর্মে এই পতন দেখা যাচ্ছে। একসময় তিনি ছিলেন লিভারপুলের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য গোলদাতা—৩৮ ম্যাচে ২৯ গোল করে প্রিমিয়ার লিগ গোল্ডেন বুট জেতেন এবং লিভারপুলকে তাদের ২০তম লিগ শিরোপা এনে দেন। কিন্তু গত মার্চে সাউদাম্পটনের বিপক্ষে দুই গোল করার পর থেকেই তাঁর প্রভাব কমতে শুরু করে।
শেষ ১১ ম্যাচে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে সালাহের গোল ছিল মাত্র দুইটি। এরই মধ্যে লিভারপুল বিদায় নেয় চ্যাম্পিয়নস লিগ থেকেও। শিরোপা জয়ের পর সালাহ নিজেই জানিয়েছিলেন, নতুন কোচ আর্নে স্লট তাঁকে রক্ষণে কম কাজের দায়িত্ব দিয়েছেন, যাতে তিনি আক্রমণভাগে বেশি মনোযোগ দিতে পারেন।
তিনি তখন বলেছিলেন, “আমি কোচকে বলেছিলাম, আমাকে ডিফেন্সে একটু বিশ্রাম দিন, আমি গোল আর অ্যাসিস্ট দিয়েই সেটি পুষিয়ে দেব। আমি সেটি করতে পেরেছি।”
কিন্তু এখন সেই কৌশলই লিভারপুলের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনছে। প্রতিপক্ষরা সালাহর ডানদিকের ফাঁকা জায়গা লক্ষ্য করেই আক্রমণ সাজাচ্ছে।
সমালোচনার কেন্দ্রে ‘মিশরের রাজা’
সাবেক ইংল্যান্ড অধিনায়ক ও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের কিংবদন্তি ওয়েইন রুনি বলেছেন, “আমরা জানি সালাহ রক্ষণে তেমন ফিরেন না, কিন্তু চেলসির ম্যাচে তাঁর ডিফেন্ডার বিপদে পড়েছিল, আর সালাহ কেবল তাকিয়ে ছিল। যখন আপনি নিয়মিত গোল করেন, তখন এসব সহ্য করা যায়। কিন্তু এখন তাঁর কাজের মানসিকতা নিয়েই প্রশ্ন উঠছে।”
রুনি আরও বলেন, “দলের সিনিয়র খেলোয়াড়দের উচিত তাঁকে বলা—‘তুমি দলকে সাহায্য করতে হবে’। গত সপ্তাহে সে একটু পথ হারিয়ে ফেলেছে।”
সাবেক লিভারপুল মিডফিল্ডার ড্যানি মারফিও একমত। তাঁর মতে, “সালাহর রক্ষণে অনাগ্রহ এখন লিভারপুলের জন্য বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, বিশেষ করে বড় দলের বিপক্ষে।”
কোচ স্লটের চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ পথচলা
কোচ আর্নে স্লট এখন সালাহকে ফিরিয়ে আনতে সময় চাইছেন। গত সপ্তাহে গালাতাসারায়ের বিপক্ষে চ্যাম্পিয়নস লিগ ম্যাচে সালাহকে প্রথম এক ঘণ্টা বেঞ্চে রাখেন তিনি। পরে স্বীকারও করেন, হয়তো সেই সিদ্ধান্তের কারণেই চেলসির বিপক্ষে সালাহ কিছুটা ধার হারিয়েছিলেন।
স্লট বলেন, “সালাহ মানুষ, মেশিন নয়। প্রত্যেক সুযোগেই গোল হবে না—এটা স্বাভাবিক। ওর মানসিক ও শারীরিক ভারসাম্য ফিরে আসতে একটু সময় লাগবে।”
তবে প্রশ্ন রয়ে যায়—লিভারপুলের ‘মিশরের রাজা’ আবার কবে তাঁর মুকুটের ঔজ্জ্বল্য ফিরে পাবেন? এখন সময়ই বলবে, সালাহ নিজেকে নতুনভাবে প্রমাণ করতে পারেন কি না।
-নাজমুল হাসান