ঘুম আসছে না? ৯টি সহজ অভ্যাসেই মিলবে গভীর ঘুম

জীবনযাপন ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুন ২৯ ০৯:৫৬:৫০
ঘুম আসছে না? ৯টি সহজ অভ্যাসেই মিলবে গভীর ঘুম

ঘুম আমাদের জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ। এটি যেমন আরামের জন্য প্রয়োজন, তেমনি এটি শরীর ও মনের পুনর্গঠনের প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াও বটে। প্রতিদিন গড়ে ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা ঘুম না হলে শরীরের অভ্যন্তরীণ কার্যপ্রণালী, হরমোন নিঃসরণ, স্মৃতিশক্তি, আবেগীয় ভারসাম্য এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করে।

যেকোনো বয়সেই ভালো ঘুম আমাদের মানসিক স্থিতি, একাগ্রতা, সৃজনশীলতা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে। পক্ষান্তরে ঘুমের ঘাটতি দীর্ঘমেয়াদে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, স্থূলতা ও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। তাই ভালো ঘুম শুধু একটি দৈনন্দিন অভ্যাস নয়, বরং সুস্থ জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ।

১. ঘুমের নির্দিষ্ট রুটিন গড়ে তোলা

শরীরের সার্কেডিয়ান রিদম বা জৈব ঘড়ি একটি নির্দিষ্ট ছন্দে কাজ করে, যা আলো ও অন্ধকারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আমাদের ঘুম ও জাগরণের সময় নির্ধারণ করে। প্রতিদিন একই সময় ঘুমাতে যাওয়া এবং একই সময়ে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস শরীরের ঘড়িকে স্থিতিশীল করে তোলে।

অনিয়মিত রুটিন, বিশেষ করে ছুটির দিনে বেশি রাত করে ঘুমানো ও দেরি করে ওঠার ফলে ঘুমের ছন্দ বিঘ্নিত হয়, যা রাতের ঘুমে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই প্রতিদিন একই রুটিন বজায় রাখার চেষ্টা করতে হবে।

২. ইলেকট্রনিক ডিভাইস থেকে দূরে থাকুন

স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, ট্যাবলেট বা টিভির মতো ডিভাইসগুলো থেকে নির্গত ব্লু লাইট (নীল আলো) মেলাটোনিন হরমোনের নিঃসরণে ব্যাঘাত ঘটায়। এই হরমোন আমাদের ঘুম–জাগরণ চক্র নিয়ন্ত্রণে রাখে।

রাতের বেলা এসব ডিভাইস ব্যবহার করলে শরীর বুঝতে পারে না যে এখন বিশ্রামের সময়। ফলে ঘুম দেরিতে আসে এবং গভীর ঘুমের পরিমাণ কমে যায়। তাই শোবার অন্তত ৩০-৬০ মিনিট আগে সব স্ক্রিন বন্ধ করে দেওয়া, ফোন বিছানার বাইরে রাখা বা ‘ডু নট ডিস্টার্ব’ মোডে রাখা অত্যন্ত কার্যকর।

৩. নিয়মিত ব্যায়াম অভ্যাস করুন

নিয়মিত ব্যায়াম শরীরের স্ট্রেস হরমোন কমিয়ে দেয় এবং ঘুমের মান উন্নত করে। দিনে মাত্র ৩০ মিনিট হাঁটা, হালকা দৌড়ানো বা সাইক্লিং করলে রাতে সহজে ঘুম আসে। সূর্যালোকের সংস্পর্শে থাকলে মেলাটোনিন নিঃসরণ সহজ হয়, তাই সকাল বা বিকেলে বাইরে ব্যায়াম করাই সবচেয়ে ভালো।

তবে রাতের দিকে ভারী ব্যায়াম না করাই ভালো। কারণ এতে দেহের উত্তেজনা ও তাপমাত্রা বেড়ে ঘুমে বিঘ্ন ঘটে। রাতে হালকা যোগব্যায়াম বা স্ট্রেচিং ভালো বিকল্প হতে পারে।

৪. ক্যাফেইন ও অন্যান্য উদ্দীপক উপাদান এড়িয়ে চলুন

ক্যাফেইন একটি শক্তিশালী স্নায়ু উদ্দীপক। এটি কফি, চা, চকোলেট, কিছু সফট ড্রিংক এবং ওষুধে পাওয়া যায়। ক্যাফেইন গ্রহণের পর ৩ থেকে ৭ ঘণ্টা পর্যন্ত এটি শরীরে সক্রিয় থাকে, এমনকি কারো ক্ষেত্রে ১০ ঘণ্টাও।

যাদের ঘুমের সমস্যা আছে, তাদের বিকেল ৩টার পর থেকে ক্যাফেইন পরিহার করাই শ্রেয়। বিকল্প হিসেবে হারবাল চা, উষ্ণ দুধ বা ক্যাফেইনমুক্ত পানীয় গ্রহণ করা যেতে পারে।

৫. ঘুমের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করুন

ঘুমের ঘর যেন শান্ত, শীতল, অন্ধকার এবং পরিষ্কার হয়, সেদিকে নজর দেওয়া উচিত। ঘরের তাপমাত্রা আদর্শভাবে ২০ থেকে ২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে ঘুমে সহায়ক হয়। নরম এবং আরামদায়ক বিছানা, বালিশ ও বিছানার চাদর ঘুমকে আরামদায়ক করে তোলে।

ঘুমের ঘরে মোবাইল ফোন, টিভি, উজ্জ্বল আলো, বড় শব্দ এসবের উপস্থিতি কমিয়ে আনতে হবে। প্রয়োজন হলে ইয়ারপ্লাগ, আই মাস্ক কিংবা ব্ল্যাকআউট পর্দা ব্যবহার করুন। কেউ কেউ হালকা গন্ধযুক্ত অ্যারোমাথেরাপি (যেমন ল্যাভেন্ডার) ব্যবহার করেও ভালো ঘুম পেতে পারেন।

৬. বিছানার ব্যবহার সীমিত রাখুন

মস্তিষ্কের জন্য বিছানা মানেই ঘুম এ সম্পর্কটি তৈরি করে দিতে হবে। কিন্তু যখন আপনি বিছানায় বসে মোবাইল ঘাঁটেন, টিভি দেখেন বা অফিসের কাজ করেন, তখন এই সম্পর্কটি দুর্বল হয়ে যায়। ফলে ঘুম আসতে বিলম্ব হয়।

শুধু ঘুম ও শারীরিক সম্পর্কের জন্যই বিছানা ব্যবহার করা উচিত। বই পড়ার অভ্যাস থাকলে সেটি বিছানায় না করে সোফায় বা পড়ার টেবিলে করার চেষ্টা করুন।

৭. মানসিক চাপ ও উদ্বেগ দূর করার কৌশল শিখুন

চিন্তা ও উদ্বেগ ঘুমকে প্রতিনিয়ত ব্যাহত করে। ঘুমানোর আগে অতিরিক্ত চিন্তা থেকে মন সরিয়ে আনতে কয়েকটি কার্যকর অভ্যাস গড়ে তুলুন। যেমন– দিনের শেষে সব দায়িত্ব ও দুশ্চিন্তা লিখে ফেলা। এভাবে মস্তিষ্ক ‘চিন্তার দায়’ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারে।

রিল্যাক্সেশন কৌশল যেমন ধ্যান (মেডিটেশন), গভীর শ্বাস-প্রশ্বাস, ধীর গতির মিউজিক কিংবা হালকা স্ট্রেচিং এসব ঘুমের আগে চাপমুক্ত থাকতে সাহায্য করে। রাতে স্ক্রিন দেখা এড়িয়ে চলা এবং ঘুমের আগে আত্মজিজ্ঞাসামূলক লেখালেখি (journaling)ও মনকে প্রশমিত করে।

৮. আলো ও অন্ধকারের সঠিক ব্যবহার

সকাল ও দিনের শুরুতে প্রাকৃতিক রোদ শরীরের জৈবঘড়িকে সজাগ করে তোলে। দিনে যত বেশি সময় আপনি আলোতে থাকবেন, শরীরের ঘুম ও জাগরণ চক্র তত ভালো কাজ করবে। তবে রাতের দিকে আলো কমিয়ে আনা জরুরি।

সন্ধ্যার পর ঘরের লাইট ডিম লাইটে বা হলুদ আলোয় পরিবর্তন করুন। মোবাইল, ল্যাপটপে ‘নাইট মোড’ চালু রাখুন। অপ্রয়োজনীয় লাইট, যেমন রান্নাঘর, বারান্দা বা করিডোরের লাইট বন্ধ রাখুন। যারা দিনের বেলায় ঘুমান, তাদের জন্য ব্ল্যাকআউট পর্দা বা চোখ ঢাকার মাস্ক ব্যবহার করা সহায়ক।

৯. শুধু ঘুম পেলে বিছানায় যান

ক্লান্তি বা ঘুম না এলে বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করাটা স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। এটি মস্তিষ্ককে বিছানার সঙ্গে হতাশা ও চাপের সম্পর্ক শেখায়, যা ঘুম আরও কঠিন করে তোলে।

যদি ২০ মিনিটের মধ্যে ঘুম না আসে, তবে বিছানা ছেড়ে হালকা কোনো রিল্যাক্সিং কাজ করুন, যেমন নরম আলোতে বই পড়া, ধ্যান বা হালকা স্ট্রেচিং। ঘুম অনুভব হলে আবার বিছানায় ফিরে যান।

ভালো ঘুম জীবনের গুণগত মান উন্নয়নে অনস্বীকার্য ভূমিকা রাখে। এটি শুধু শারীরিক শক্তি ফিরিয়ে আনে না, বরং মানসিক সুস্থতা ও আবেগীয় ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। যারা ঘুম নিয়ে অবহেলা করেন, তারা নিজের অজান্তেই শারীরিক ও মানসিক বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যান।

তাই ঘুমকে প্রাধান্য দিন, ঘুমের পরিবেশ ঠিক করুন এবং ধাপে ধাপে সঠিক ঘুমের অভ্যাস গড়ে তুলুন। এটি আপনার কর্মক্ষমতা, মন-মেজাজ, সম্পর্ক এবং স্বাস্থ্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদি ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ