মতামত

প্রেস সচিবের বক্তব্যে বাকস্বাধীনতা, মব কালচার ও সাংবাদিকতার দ্বন্দ্ব: পাঠবিশ্লেষণ

আসিফ বিন আলী
আসিফ বিন আলী
শিক্ষক ও স্বাধীন সাংবাদিক
২০২৫ জুন ২৭ ১৮:৪৫:৪৯

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেস সচিব শফিকুল আলম সম্প্রতি এক দীর্ঘ বক্তব্যে দেশের সাংবাদিকতা, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং সরকারের অবস্থান নিয়ে বিস্তারিত কথা বলেছেন। তাঁর বক্তব্যে যেমন গঠনমূলক পর্যালোচনা করেছেন, ঠিক তেমনি কিছু বিষয়ে স্পষ্টভাবে দায় এড়িয়ে গেছেন। তিনি সাংবাদিকতার সমস্যার বিকল্প ব্যাখ্যা দিয়ে সমস্যার গভীরতাকে আড়াল করেছেন।

প্রেস সচিব সাংবাদিকদের কাজকে “Lazy Journalism” অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন। তাঁর ভাষায়: “খুবই লেজি লেখা, লেজি কথাবার্তা... অনেকেই ব্লেম গেম খেলছে, কেউ কাউকে দোষ দিচ্ছে, আবার কেউ কেউ নোংরামির আশ্রয় নিচ্ছে।” তিনি এখানে এক ধরনের ভাষার কৌশল ব্যবহার করেছেন। তিনি সংবাদমাধ্যমকে “অযোগ্য” ও সাংবাদিকদের কাজকে “সন্দেহজনক” হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। এর মধ্য দিয়ে moral high ground দাবি করেছেন, যেন সরকার সৎ, যুক্তিপূর্ণ, আর সাংবাদিকরা বিভ্রান্তিকর ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এটা অত্যন্ত ক্লাসিক একটি পদ্ধতি, যা ক্ষমতায় থাকা মানুষরা ব্যবহার করেন সাংবাদিকতাকে হেয় করার জন্য। এখন প্রশ্ন থাকে, সাংবাদিকদের ব্যর্থতা যদি সত্যও হয়, রাষ্ট্র কি তাহলে দায়মুক্ত? রাষ্ট্র যদি গত দেড় দশক ধরে মিডিয়ার সহনশীল পরিবেশ না দেয়, গোপন নজরদারি, রাজনৈতিক চাপ ও করপোরেট নিয়ন্ত্রণ না করে, তাহলে এই সাংবাদিকতা এমন হয়ে উঠত কি?

প্রেস সচিব তাঁর বক্তব্যে বলেছেন, সাংবাদিকদের কাজের ব্যাপারে ‘ট্রাস্ট ডেফিসিট’ তৈরি হয়েছে। প্রশ্ন থেকে যায়, প্রেস সচিবের বলা ট্রাস্ট ডেফিসিট এর ব্যর্থতা কার? প্রেস সচিব সঠিকভাবেই বলেছেন, “হাসিনার ১৫ বছরের শাসনে সাংবাদিকতার উপরে একটা ভয়ানক ট্রাস্ট ডেফিসিট তৈরি হয়েছে।” তিনি এটাও দাবি করেন যে, বর্তমান সরকার সেই সংকট থেকে উত্তরণের চেষ্টা করছে। কিন্তু এই বিশ্লেষণটি আংশিক। কারণ সাংবাদিকতার প্রতি আস্থা কমে যাওয়ার প্রধান কারণ শুধু সাংবাদিকদের কাজ নয়, যা প্রেস সচিব বলেছেন, বরং সরকারের গঠিত মিডিয়া কাঠামো, রাজনৈতিক দলগুলোর অনুগত মালিকানার সংস্কৃতি এবং করপোরেট সরকারিক সুবিধা বিনিময়ের মডেলও এতে ভূমিকা রেখেছে। প্রশ্ন থেকে যায়, বর্তমান সরকার কি আসলেই এই মালিকানার সংস্কৃতি এবং করপোরেট ও সরকারি সুবিধা বন্ধ করার জন্য কাজ করেছেন? নাকি তারা নতুন মডেল তৈরি করেছেন? আমরা তো স্পষ্ট দেখতেই পাচ্ছি, এই সরকারে কী পরিমাণ সাংবাদিক অংশ নিয়েছেন। এই অংশগ্রহণ কি জরুরি ছিল?

নিজের বক্তব্যেই প্রেস সচিব স্বীকার করেন: “আগে আমরা দেখেছি, ডিজিএফআই, ডিবি... পর্যন্ত সাংবাদিকদের কাজে হস্তক্ষেপ করতো। সাংবাদিকদের দাস বানানো হতো। যারা দাস সাংবাদিকতা করতেন, তারা আর্থিকভাবে লাভবান হতেন।” এই পরিপ্রেক্ষিতে যদি আজকের সাংবাদিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়, তবে রাষ্ট্র তার কাঠামোগত ভূমিকা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে না। দেখার বিষয় হল, রাষ্ট্র কি এই ডিজিএফআই, ডিবি বা এই ধরনের সংস্থাগুলোকে জবাবদিহিতার মুখে ফেলেছে, না কি শুধু সাংবাদিকদের ট্রাস্ট ডেফিসিট আছে বলেই ক্ষান্ত দিচ্ছে? আপাতত আমরা যা দেখছি তা হল ডিজিএফআই, ডিবির বিরুদ্ধে সরকার তেমন প্রকাশ্য কোনও ব্যবস্থা নিয়েছে বলে দেখা যায় না। কিন্তু ঠিকই সাংবাদিকদের হেয় করে চলেছে।

প্রেস সচিব দাবি করেন, “আমরা প্রশাসনিক কোনও টুল ব্যবহার করছি না... সাংবাদিকদের মুখ বন্ধ করতে।” তবে তিনি যখন ‘মব’ শব্দটি অস্বীকার করে ‘প্রেশার গ্রুপ’ বলেন, তখনই বোঝা যায়, রাষ্ট্র এখন আর সরাসরি সেন্সরশিপ চালায় না, বরং ‘মার্কেট ফোর্স’ বা ‘সামাজিক চাপ’ এর মাধ্যমে তা পরোক্ষভাবে বাস্তবায়ন করে।

গত জুলাইয়ের আন্দোলনের পরে থেকেই আমরা মবের দৌরাত্ম্য দেখেছি। প্রেস সচিব জিজ্ঞাসা করেছেন, মবের সংজ্ঞা কী? মবের সংজ্ঞা হল স্পষ্ট, যখন আপনি সংবাদমাধ্যমের অফিসের সামনে গিয়ে যিয়াফত করবেন, কিংবা নাগরিককে গ্রেপ্তারের নামে গলায় জুতার মালা পরাবেন, কিংবা কারও বাড়িতে ঢুকে গিয়ে “শত্রু” খুঁজে বের করবেন, তাই মব। আমরা দেখেছি মব কীভাবে সংগঠিত হয়েছে, কারা করেছে এবং তারা কীভাবে সরকারের কোনো না কোনো অংশের সমর্থন পেয়েছে। এমনকি ছাত্রনেতাদের অনেকেই এই মবকে সমর্থন করেছেন, ঠিক প্রেস সচিবের ভাষায়, তা হল “প্রেশার গ্রুপ”।

এইসব মব হামলার সময় পুলিশ নিষ্ক্রিয় থেকেছে। ‘অজানা পরিচয়ের লোকেরা’ সক্রিয় থেকেছে। প্রশ্ন হলো, এই প্রেশার গ্রুপগুলোর উৎস কোথায়? তাদের সংগঠন, সংহতি ও প্রতিক্রিয়া কি নিছক স্বতঃস্ফূর্ত? প্রেস সচিব যখন বলেন, “যে ‘মব’ হচ্ছে, সেটা আসলে আগে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া জনগণের প্রতিক্রিয়া”, তখন বিষয়টি আরও উদ্বেগজনক হয়ে ওঠে। কারণ এতে করে রাজনৈতিক সহিংসতা ও গণঅপরাধকে একটি যুক্তিসংগত প্রতিশোধের ভাষায় উপস্থাপন করা হয়।

প্রেস সচিব "ভুল সাংবাদিকতা", "লেজি জার্নালিজম", ও "প্রেশার গ্রুপ" ইত্যাদি ফ্রেমিং ব্যবহার করেছেন। এটা মূলত সরকারপক্ষীয় হেজেমনিক ব্যাখ্যা। এই ব্যাখ্যার মাধ্যমে রাষ্ট্র নিজেকে নৈতিক ও যুক্তিসংগত বলে তুলে ধরছে, আর অন্য মতকে অবৈধ বা বিভ্রান্তিকর বলে চিহ্নিত করছে। গ্রামশীয় ফ্রেম ব্যবহার করে বলাই যায়, এখানে প্রেস সচিব বিকল্প সত্য নির্মাণের মাধ্যমে সাংবাদিকতার উপর প্রচ্ছন্ন নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চান। পাশাপাশি, আমরা বলতে পারি প্রেস সচিবের ভাষা ("lazy journalism", "মিথ্যা ভিডিও", "মব নয়, প্রেশার গ্রুপ") একটি ডিসকোর্স নির্মাণ করে। এই ডিসকোর্স ‘ভালো সাংবাদিকতা’ বলতে এমন সাংবাদিকতাকে বোঝায়, যা রাষ্ট্রকে প্রশ্ন করে না, বরং সহযোগিতা করে। প্রেস সচিবের বক্তব্য বিশ্লেষণ করে বলা যায়, তিনি "রেজিম অফ ট্রুথ" (ফুকোর ভাষায়) তৈরি করছেন, যেখানে কিছু তথ্য ‘সত্য’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, আর অন্য তথ্যকে ‘অপসাংবাদিকতা’ বা ষড়যন্ত্র হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। এটা বর্তমান সরকারের একটি ক্লাসিক পদ্ধতি, যার মাধ্যমে তারা নিজেদের ন্যারেটিভ তৈরি করছেন।

প্রেস সচিব বক্তব্যের শেষাংশে দাবি করেন, “বাংলাদেশে সাংবাদিকতার যে স্বাধীনতা আছে, উন্নত বিশ্বেও তেমন নেই।” এ ধরনের তুলনা বিভ্রান্তিকর। কারণ, পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো সাংবাদিককে নিখোঁজ করা, দিনের বেলায় তুলে নেওয়া, কিংবা অজানা ধারায় মামলায় জর্জরিত করার উদাহরণ বিরল। আমাদের দেশে এখন অহরহই সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা খুনের মামলা হচ্ছে। তবে উল্লেখযোগ্য বিষয় যে, বিগত সরকারের মত বর্তমান সরকার কোনভাবেই নিপীড়নের পথ বেছে নেয়নি, এটা আশার কথা। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা উল্লেখযোগ্যভাবে নিশ্চিত হয়েছে। অন্যদিকে আদালত, স্বাধীন নির্বাচন কমিশন এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো সাংবাদিকদের রক্ষায় সক্রিয় থাকে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আমাদের এই প্রতিষ্ঠানগুলো এখন দুর্বল। হয়তো আমরা আশার আলো দেখতে পারি, যদি প্রত্যাশিত সংস্কার সম্ভব হয়।

আমাদের দেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা অনেকাংশেই নির্ভর করে কোন দল ক্ষমতায় আছে। কারণ গত এক দশকে আমরা দেখেছি, কোন দল ক্ষমতায় থাকলে কাদের লেখা ছাপা হয় আর কাদের নিবন্ধন বাতিল হয়। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য যে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার দরকার, তা এখনো সম্ভব হয়নি। তাই হয়তো সরকারের সদিচ্ছা আছে, তবে আমরা কোনোভাবেই বলতে পারি না যে বাংলাদেশের সাংবাদিকতার স্বাধীনতা উন্নত বিশ্বের চেয়ে বেশি। এটা একটি পপুলিস্ট রাজনৈতিক বক্তব্য।

প্রেস সচিব দাবি করেন: “আপনি যদি ৪০ মিনিটের মিথ্যা ভিডিও করেন, আমি সেটার জবাব দিতে গেলে বলা হয় আমি আপনাকে ভয় দেখাচ্ছি।” এই বক্তব্য আপাতদৃষ্টিতে যৌক্তিক মনে হলেও বাস্তবে এর বিপরীতে একটি ভয়ংকর প্রবণতা কাজ করে। বলা যায়, এই বক্তব্যের মাধ্যমে প্রেস সচিব এক ধরনের chilled speech environment এর কথা বলছেন। কিন্তু এর ফলে "পাবলিক স্পিয়ার" দুর্বল হয়ে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রেই সাংবাদিকদের ভুল ধরার নামে সরকার সমালোচনাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ হিসেবে ব্যাখ্যা করে। এই প্রবণতা বর্তমান সরকারের মধ্যে বিদ্যমান। প্রশ্ন হলো, সাংবাদিক মিথ্যা বললে তার প্রতিকার কোথায় হবে? আমরা কি আদালতে যাব? নাকি সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাহী ক্ষমতার মাধ্যমে মোকাবিলা করা হবে? এই বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের সমাজে কোনো নির্দিষ্ট রীতি নেই। তাই প্রেস সচিবের মতো ক্ষমতাবান অবস্থান থেকে সাংবাদিকের কাজ নিয়ে জবাব দিলে, তা অনেকেই নির্বাহী ক্ষমতার ব্যবহার বলে মনে করতে পারেন। তবে উল্লেখ্য, প্রেস সচিবের অধিকার আছে তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা রিপোর্টের প্রতিবাদ করার এবং আদালতে যাওয়ার। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আদালতে গেলে আদালত কি নিরপেক্ষভাবে কাজ করবে? কেননা আমাদের পুরো সিস্টেমই তো ক্ষমতাকে সেবা দেয়। তাহলে সমাধান কী?

প্রেস সচিবের পুরো বক্তব্যের মধ্যে একটি বিষয় স্পষ্ট, সরকার ও প্রেস সচিব নিজে একটি নৈতিক উচ্চতা থেকে সাংবাদিকতাকে মূল্যায়ন করছেন। অথচ সেই নৈতিক অবস্থানটি হচ্ছে ক্ষমতাসীন চেয়ারে বসে থাকার ফল। প্রেস সচিব যখন সাংবাদিক ছিলেন, তখন গণমাধ্যমের স্বাধীনতা পক্ষে কাজ করেছেন ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে নিজের লেখাকে প্রতিবাদের হাতিয়ার বানিয়েছেন। এখন তিনি সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে সেই একই স্বাধীনতাকে পরিমিত, নীতিসম্মত এবং নিয়ন্ত্রিত সাংবাদিকতার আদলে দেখতে চান। বাংলাদেশে সাংবাদিকতার সমস্যা আছে, এই কথা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু সমস্যার উৎসে রাষ্ট্র নিজেই যে বড় অংশীদার, সেটিও অস্বীকার করা চলে না। আর সেই রাষ্ট্রের ক্ষমতার প্রতিনিধিত্ব করছেন প্রেস সচিব। তিনি সাংবাদিকতার সংকটকে সরলীকরণ করছেন।

বাস্তবতা হলো, ঢালাওভাবে সরকার বা সাংবাদিককে দায়ী করার পরিবর্তে আমাদের উচিত সাংবাদিকতার সংকটের জটিলতা মেনে নিয়ে, সাংবাদিকতার ভবিষ্যতের জন্য একটি স্বাধীন ও দায়িত্বশীল পরিবেশ নিশ্চিত করা, যাতে সাংবাদিকরা প্রেস সচিবের “প্রেশার গ্রুপ” এর ভয়ে “লেজি সাংবাদিকতা” র পরিবর্তে তথ্যের ভিত্তিতে কথা বলতে পারেন।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ