“সন্দেহে নিঃস্ব সাত পরিবার”: পাবনায় নৈশপ্রহরী ও মুয়াজ্জিন হত্যার পর বিভীষিকাময় প্রতিশোধ

এম এস রহমান
এম এস রহমান
স্টাফ রিপোর্টার, পাবনা
সারাদেশ ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুন ২৫ ১১:৫৪:৪৭
“সন্দেহে নিঃস্ব সাত পরিবার”: পাবনায় নৈশপ্রহরী ও মুয়াজ্জিন হত্যার পর বিভীষিকাময় প্রতিশোধ

পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার বৃদ্ধ মরিচ গ্রামে নৈশপ্রহরী ও মুয়াজ্জিন হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে সন্দেহভাজন হিসেবে চিহ্নিত এক ব্যক্তির পরিবারের উপর নেমে এসেছে নির্মমতা ও সহিংসতার ঝড়। শুধুমাত্র সন্দেহের বশে সাতটি পরিবারের দশটি ঘর ভাঙচুর, লুটপাট এবং আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়। দুই সপ্তাহ ধরে খোলা আকাশের নিচে দিন কাটাচ্ছেন এসব পরিবারের সদস্যরা—ক্ষুধা, দুঃখ ও নিরাপত্তাহীনতায় দগ্ধ তাদের জীবন। ভুক্তভোগীরা বলছেন, আসল খুনিদের গ্রেপ্তারের পর প্রমাণ হয়েছে সন্দেহের পেছনে কোনো ভিত্তি ছিল না। কিন্তু এত বড় ক্ষতির দায় নেবে কে?

গত ৯ জুন রাতে চন্ডিপুর সিকেবি আলিম মাদ্রাসার নৈশপ্রহরী ও মুয়াজ্জিন ওসমান গণি মোল্লা (৬২) কে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। হত্যাকাণ্ডের পরদিন সকালে স্থানীয়রা সন্দেহভাজন হিসেবে একই গ্রামের শাহাদত হোসেনকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। এরপরই স্থানীয় এক ব্যক্তি, সাইদুর রহমান, মসজিদের মাইকে ঘোষণা দেন—“শাহাদতের বাড়ি জ্বালিয়ে দাও।” এই ঘোষণার পর উত্তেজিত গ্রামবাসী একযোগে হামলা চালায়। শাহাদতসহ তার ছয় ভাই ও এক বোনের পরিবারের দশটি ঘর লুটপাট করে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।

ক্ষতিগ্রস্তরা জানান, বাড়ির আসবাবপত্র, স্বর্ণালঙ্কার, চাল, ফসল, নগদ টাকা, এমনকি গবাদিপশু পর্যন্ত কিছুই রক্ষা হয়নি। যাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তাঁদের অনেকেই তখন বাড়িতে ছিলেন না। কেউ কেউ প্রাণ বাঁচাতে শুধু শরীরের কাপড়টুকু নিয়ে পালিয়ে যান। পরে ফায়ার সার্ভিস এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে, কিন্তু ততক্ষণে ধ্বংস হয়ে গেছে সবকিছু।

পুলিশ তদন্তে নামে এবং দ্রুত সময়ের মধ্যে হত্যার প্রকৃত দুই অভিযুক্ত কিশোর—হাবিব (১৪) ও আহমদ উল্লাহ (১৫)—কে গ্রেপ্তার করে। আদালতে তারা ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় যে মাদকের টাকার জন্য তারা ওসমান গণিকে খুন করেছে। এরপর সন্দেহভাজন শাহাদত হোসেনকে ছেড়ে দেয় পুলিশ।

তবে তখন পর্যন্ত যা ক্ষতি হওয়ার, তা হয়ে গেছে। সাতটি পরিবারের ঘরবাড়ি ও সহায়-সম্পদ পুড়ে ছাই। রবিউল করিম নামের এক ভুক্তভোগী জানান, “সেদিন এক কাপড়ে আমরা প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছি। এখন খোলা আকাশের নিচে ঘুমাই। প্রায় এক কোটি টাকার সম্পদ গেছে। কে নেবে এই ক্ষতির দায়?”

মালয়েশিয়া প্রবাসী নুরুল ইসলাম ও আব্দুস সোবাহানদের পরিবারও হামলার শিকার হয়েছেন। তাঁদের স্ত্রীরা বলছেন, রাত কাটাচ্ছেন একেক দিন একেকজনের বাড়িতে। খাবার জোটে না। সহায়তা বলতে প্রশাসনের দেওয়া এক বাণ্ডিল টিন ও ছয় হাজার টাকা। লাইলী খাতুন বলেন, “আমার ভাই জড়িত না—তা প্রমাণ হয়েছে। তবুও কেন আমাদের পুড়িয়ে মারা হলো?”

ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর পক্ষে রবিউল করিম গত ১৮ জুন ১৩ জনকে নামীয় ও ৩০–৩৫ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলা করেন। পুলিশ ১৯ জুন তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে: সাইদুর রহমান, আনোয়ার হোসেন ও শাহীন হোসেন। পুলিশের ভাষ্যমতে, অন্যদের ধরতে অভিযান চলছে।

ভাঙ্গুড়া থানার ওসি মোঃ শফিকুল ইসলাম বলেন, “হত্যাকাণ্ডে মূল দুই আসামি গ্রেপ্তার হয়েছে এবং তারা আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছে। সন্দেহভাজন শাহাদত নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। আর ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের মামলায় তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।”

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোছাঃ নাজমুন নাহার জানান, “ক্ষতিগ্রস্তদের প্রাথমিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে—টিন, শুকনো খাবার ও নগদ অর্থ। নতুন অর্থবছরে আরও সহযোগিতার চেষ্টা থাকবে।”

তবে মানবিক সহায়তা যা দেওয়া হয়েছে, তা কোনোভাবেই যথেষ্ট নয় বলে মনে করছে গ্রামবাসী। তারা সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিত্তবান ও মানবিক সংগঠনগুলোর কাছে সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছে। কেউ সাহায্য পাঠাতে চাইলে ভুক্তভোগী পরিবারের পক্ষ থেকে রবিউল করিম (মোবাইল: ০১৭৩৬-৬৭৭২১০)-এর সঙ্গে যোগাযোগ করার অনুরোধ জানানো হয়েছে।

এই ঘটনা আবারও প্রশ্ন তোলে—কোনো অপরাধে সন্দেহ হলেই কি গণপিটুনি, ঘর পুড়িয়ে দেওয়া এবং নিঃস্ব করে দেওয়া ন্যায্য হয়ে যায়? আইনের চোখে নির্দোষ প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও একটি পরিবারের সব হারিয়ে পথে বসে যাওয়ার ক্ষত কি কখনও পূরণ হয়? উত্তর খুঁজছে বৃদ্ধ মরিচ গ্রামের নির্যাতিত মানুষগুলো।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

আমেরযত কাহিনি

আমেরযত কাহিনি

নিজস্ব প্রতিবেদক: স্বাদ, গন্ধ ও পুষ্টিগুণে পরিপূর্ণ ‘আম’ শুধু একটি ফল নয়, বরং এটি ইতিহাস, সংস্কৃতি ও অর্থনীতিতে গভীরভাবে প্রোথিত এক... বিস্তারিত