ভোটেও নিষিদ্ধ, কোন পথে রাজনীতি?

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক ঐতিহাসিক ও বিতর্কিত মোড় নিতে যাচ্ছে—সাম্প্রতিক সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আওয়ামী লীগের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত। এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে দলটি আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী দিতে পারবে না। নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন বাতিল হওয়ার ঝুঁতিও এখন সামনে।

সরকারি এই সিদ্ধান্তকে ঘিরে নির্বাচন কমিশন (ইসি) এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মাঝে শুরু হয়েছে জোর আলোচনার ঢেউ। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন জানান, “সরকারি গেজেট হাতে পাওয়ার পর কমিশন এই বিষয়ে আলোচনায় বসবে এবং নির্বাচন সংক্রান্ত পদক্ষেপ নির্ধারণ করবে।” তিনি বলেন, “বর্তমান বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা মাথায় রেখেই আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”

আইনি কাঠামোর বিশ্লেষণ

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (RPO), ১৯৭২ অনুযায়ী সরকার কর্তৃক কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হলে নির্বাচন কমিশন সেই দলের নিবন্ধন বাতিল করতে পারে। যদিও এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে নিবন্ধন বাতিল করা হয়নি, তবে দলটির নামের পাশে ‘কার্যক্রম স্থগিত’ চিহ্ন যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল।

নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য বেগম জেসমিন টুলি বলেন, “নিবন্ধিত দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হলে তারা কোনো সুবিধা পাবে না—নির্বাচনে প্রতীক, প্রার্থী মনোনয়ন বা ভোটার তালিকা কিছুই নয়।” একইভাবে, ড. বদিউল আলম মজুমদার মনে করেন, “আওয়ামী লীগ পুরোপুরি নির্বাচনী মাঠ থেকে ছিটকে পড়তে যাচ্ছে।”

সন্ত্রাসবিরোধী আইন সংশোধন: রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের পথ প্রশস্ত

বর্তমান আইনে রাজনৈতিক দল হিসেবে কোনো সত্তার কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সুস্পষ্ট বিধান না থাকায় সরকার ‘সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯’ সংশোধন করে একটি নতুন অধ্যাদেশ জারি করেছে। এ অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, সন্ত্রাসী কার্যক্রমে যুক্ত ব্যক্তি বা দলকে সরকারি গেজেটের মাধ্যমে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা যাবে এবং অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের প্রচারও বন্ধ করা যাবে।

এ প্রসঙ্গে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, “জুলাই অভ্যুত্থান, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার এবং দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার স্বার্থে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।”

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া: সরকারের আত্মবিশ্বাস

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছেন, “আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তে কোনো নেতিবাচক আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া আশা করছি না। বরং পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে মানবতাবিরোধী কার্যকলাপের জন্য এমন অনেক দল নিষিদ্ধ হয়েছে।”

তিনি জার্মানির নাৎসি পার্টি, ইতালির ফ্যাসিস্ট পার্টি, স্পেন এবং বেলজিয়ামের বিচ্ছিন্নতাবাদী দলগুলোর উদাহরণ টেনে বলেন, “বিশ্ব এমন দলকে ঘৃণা করে যারা গণতন্ত্রের নামে জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।”

জুলাই অভ্যুত্থান ও জনপ্রতিক্রিয়া

আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের ঘোষণার পরও ‘জুলাই অভ্যুত্থান’ অংশগ্রহণকারীদের অনেকেই পুরোপুরি সন্তুষ্ট নন। তারা শাহবাগে অবস্থান নিয়ে ‘জুলাই সুরক্ষা আইন’ প্রণয়ন, ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন। নিহত ও আহতদের পরিবার থেকে স্থায়ী নিষেধাজ্ঞার দাবি উঠে এসেছে।

এক নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা

আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধকরণ দেশের রাজনীতিতে একটি টার্নিং পয়েন্ট—সমর্থকদের কাছে এটি নিপীড়ন, আর সমালোচকদের কাছে বিচার ও জবাবদিহির প্রতীক। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি একদিকে দেশের শাসনব্যবস্থাকে নতুন কাঠামোতে রূপ দিতে পারে, অন্যদিকে বিদ্যমান মতপার্থক্যকে আরও গভীর করতে পারে।

এখন প্রশ্ন হলো, এই নিষেধাজ্ঞা দীর্ঘস্থায়ী হবে, নাকি বিচার সম্পন্ন হওয়ার পর দলটি ফের রাজনীতিতে ফিরবে? এই উত্তরের জন্য পুরো জাতিকে অপেক্ষা করতে হবে।