ইরান ইসরাইলের যুদ্ধ

ড্রাগন নয়, ‘ফাত্তাহ’: ইরানের গর্ব, বিশ্বের আতঙ্ক

বিশ্ব ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুন ২০ ১১:৫৪:১২
ড্রাগন নয়, ‘ফাত্তাহ’: ইরানের গর্ব, বিশ্বের আতঙ্ক

রাতের আকাশ হঠাৎ যেন জ্বলে উঠল আগুনের শিখায়। মহাকাশের গহ্বর ছুঁড়ে ছুটে চলা একটি বস্তু, যার গতি শব্দের চেয়ে পনেরো গুণ বেশি। দৃশ্যটি দেখে কেউ বলেছে উল্কাপিণ্ড, কেউ দাবি করেছে গ্রহাণু। কেউ বা মজা করে লিখেছে, “এ বুঝি কোনও ড্রাগন উড়ছে আকাশে!” কিন্তু বাস্তবে, এটি ছিল ইরানের তৈরি হাইপারসনিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র—‘ফাত্তাহ’।

শব্দের চেয়ে পনেরো গুণ দ্রুতগতির এই অস্ত্রের নাম এসেছে আরবি শব্দ ‘ফাত্তাহ’ থেকে, যার অর্থ ‘বিজয়ী’। এই নামেই যেন ইঙ্গিত রয়েছে ইরানের মনোভাব ও কৌশলের, যা শুধু প্রতিরক্ষা নয়—এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক চাপও সৃষ্টি করছে বৈশ্বিক প্রতিপক্ষের ওপর।

২০২৩ সালের জুনে ‘ফাত্তাহ’-কে প্রথমবার প্রকাশ্যে আনে ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস (IRGC)। কিন্তু এটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসে সম্প্রতি, যখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয় ক্ষেপণাস্ত্রটির হাইপারসনিক গতিতে আকাশ চিরে ছুটে চলার ভিডিও। এক্স (সাবেক টুইটার), ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুক, ইউটিউব—সবখানে এই ভিডিও মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে। কেউ লিখেছেন, “এ যেন আগুন দিয়ে আকাশে লেখা কোনো ভবিষ্যতের বার্তা।” আবার কেউ বলেছে, “এটা কি এলিয়েনের আগমন?”

কিন্তু বাস্তবতা আরও বিস্ময়কর। ‘ফাত্তাহ’ এমন একটি অস্ত্র, যা শব্দের গতির চেয়ে ১৫ গুণ দ্রুত—প্রায় ১৮,৫০০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা। শুধু গতি নয়, এটিকে থামানোও প্রায় অসম্ভব। কারণ এটি মাঝপথে দিক পরিবর্তনের ক্ষমতা রাখে। এই ‘ম্যানুভারেবল হাইপারসনিক গ্লাইড ভেহিকল’ প্রযুক্তি এমনই ভয়ংকর, যা বিশ্বের বর্তমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে কার্যত অকার্যকর করে দেয়। ইরান দাবি করেছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্যাট্রিয়ট, ইসরায়েলের আয়রন ডোম কিংবা অ্যারো সিস্টেম—কোনোটিই ফাত্তাহকে থামাতে পারবে না।

সলিড ফুয়েল প্রযুক্তিতে নির্মিত এই ক্ষেপণাস্ত্র ক্ষণিক প্রস্তুতিতে ছোঁড়া সম্ভব এবং দীর্ঘ সময় ধরে ব্যবহারযোগ্য অবস্থায় সংরক্ষণ করা যায়। এর অবয়ব এবং কার্যক্ষমতা দেখে অনেকে একে রাশিয়ার ‘কিনজাল’ বা চীনের ‘ডিএফ-১৭’ ক্ষেপণাস্ত্রের সঙ্গে তুলনা করছেন। তবে ইরান বলছে, এটি শতভাগ দেশীয় প্রযুক্তির ফসল—যা তাদের প্রযুক্তিগত স্বনির্ভরতার মাইলফলক।

এই ভয়াবহ ক্ষেপণাস্ত্রের ওয়ারহেড সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু প্রকাশ না করা হলেও ধারণা করা হচ্ছে, এটি প্রচলিত বিস্ফোরকের পাশাপাশি পারমাণবিক অস্ত্র বহনেও সক্ষম। যদিও ইরান আনুষ্ঠানিকভাবে এই সক্ষমতা স্বীকার করেনি, কিন্তু পশ্চিমা বিশ্লেষকরা মনে করছেন—এই দাবিই এখন বিশ্বের উদ্বেগের অন্যতম উৎস।

আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো এই ঘটনার সময়চক্র। যখন মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল-ইরান উত্তেজনা তুঙ্গে, যখন গাজায় বোমা হামলা, পাল্টা হামলা এবং হুমকি-পাল্টা হুমকির মধ্য দিয়ে তেলআবিব-তেহরান সম্পর্ক আরও জটিল হয়ে উঠেছে—ঠিক তখনই ‘ফাত্তাহ’র মহড়াসদৃশ প্রকাশ বিশ্বকে নতুন এক বার্তা দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল এবং ইউরোপের প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা ফাত্তাহকে শুধু প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ নয়, বরং কৌশলগত হুমকি হিসেবেই দেখছেন। কেউ কেউ বলছেন, এই প্রযুক্তি মধ্যপ্রাচ্যের সামরিক ভারসাম্যে বিপুল পরিবর্তন আনতে পারে। এখন পর্যন্ত হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের দৌড়ে রাশিয়া ও চীন এগিয়ে ছিল। এবার তেহরান তাদের কাতারে এসে দাঁড়িয়েছে।

রাশিয়া বা চীন সরাসরি কোনও মন্তব্য না করলেও, বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভূরাজনৈতিকভাবে ইরান এই পরীক্ষার মাধ্যমে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার জবাবই দিয়েছে। তাদের বার্তা স্পষ্ট—তারা কেবলমাত্র রণনীতিতে নয়, প্রযুক্তিতেও স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠছে।

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনেয়ী থেকে শুরু করে আইআরজিসি কমান্ডাররা বারবার বলেছেন, ফাত্তাহ কোনো আগ্রাসনের জন্য নয়, বরং এটি একটি প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা। তবে এই ‘প্রতিরক্ষা’র শক্তি এতটাই ভয়ংকর যে, বিশ্ব আতঙ্কিত না হয়ে পারে না। বিশেষ করে যখন যুদ্ধ পরিস্থিতির দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা একটি অঞ্চলের আকাশে হঠাৎ জ্বলে ওঠে এমন আগুনের রেখা।

ফাত্তাহ এখন কেবল একটি মিসাইল নয়—এটি একটি যুগের প্রতীক। যেখানে যুদ্ধের সংজ্ঞা পাল্টাচ্ছে, প্রতিরক্ষার মাপকাঠি ভেঙে যাচ্ছে, এবং প্রতিপক্ষকে বিভ্রান্ত করার কৌশল হয়ে উঠছে অস্ত্রের অন্যতম প্রধান শক্তি। আর এই নতুন বাস্তবতায় ইরান স্পষ্টতই এক নতুন ভূমিকায় প্রবেশ করেছে।

—আশিক নিউজ ডেস্ক

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

স্টারমারের নীরবতা: কূটনৈতিক শিষ্টাচার বনাম রাজনৈতিক সংকোচ

স্টারমারের নীরবতা: কূটনৈতিক শিষ্টাচার বনাম রাজনৈতিক সংকোচ

একজন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ, সামাজিক ব্যবসার পথপ্রদর্শক এবং গণতান্ত্রিক উত্তরণের নেতৃত্বদানকারী রাষ্ট্রনায়ক—এই তিনটি পরিচয়ই এখন সমভাবে প্রযোজ্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের... বিস্তারিত