তুরস্ক কি দক্ষিণ এশিয়ার নতুন খেলোয়াড়? ভারতের জন্য কতটুকু হুমকি?

দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করতে যাচ্ছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোয়ান। পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যকার চলমান উত্তেজনাকে কেন্দ্র করে তুরস্ক ও ইরানের সক্রিয় অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিকে নতুনভাবে চাঙা করে তুলেছে।

সম্প্রতি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ এক গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক সফরে তুরস্ক ও ইরান ঘুরে এসেছেন। এই সফরে তার সঙ্গে ছিলেন সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার। ধারণা করা হচ্ছে, এই সফর শুধুই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক মজবুত করার উদ্দেশ্যে নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের একক আধিপত্যের বিরুদ্ধে মুসলিম দেশগুলোর যৌথ কৌশল নির্ধারণের প্রাথমিক পর্যায়।

রবিবার ইস্তাম্বুলে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফের সঙ্গে এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে বসেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান। বৈঠকে প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল ভারতের সঙ্গে চলমান উত্তেজনা এবং ভবিষ্যৎ প্রতিরক্ষা সহযোগিতা।

তুরস্ক ইতোমধ্যেই পাকিস্তানকে কয়েকশো উন্নত ড্রোন ও অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে বলে দাবি করে ভারত। এছাড়া, ভারতের পক্ষ থেকে অভিযোগ এসেছে যে সাম্প্রতিক সংঘাতকালীন সময়ে তুরস্ক পাকিস্তানে সরাসরি অস্ত্র পরিবহন করেছে সামরিক বিমান ও জাহাজের মাধ্যমে। বিষয়টি নিয়ে নয়াদিল্লি ক্ষোভ প্রকাশ করলেও এরদোয়ান স্পষ্টভাবে পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।

এই বন্ধুত্ব ভারতীয় জনগণের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। ভারতের সামাজিক মাধ্যমে “বয়কট তুরস্ক” প্রচার শুরু হয়েছে, পাশাপাশি কিছু চুক্তিও ভারত বাতিল করেছে তুরস্কের সঙ্গে।

তুরস্ক সফর শেষে শাহবাজ শরীফ উড়ে যান তেহরানে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তিনি। সেখানে তিনি ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইরানের অবস্থানকে সমর্থন জানান এবং পাকিস্তানের সঙ্গে ইরানের “বহুমুখী সম্পর্ক” আরও গভীর করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।

কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই সফর ছিল মূলত ভারতবিরোধী কৌশলে ইরানের সমর্থন নিশ্চিত করার প্রয়াস। একই সঙ্গে ইরানের শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচির প্রতি পাকিস্তানের সমর্থনও উঠে আসে এই বৈঠকে।

তুরস্ক, ইরান ও পাকিস্তান—তিন মুসলিম দেশ আজ দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে কার্যকরী একত্রতা গড়ে তুলেছে, যা ভারতের জন্য কৌশলগতভাবে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এরদোয়ানের নেতৃত্বে তুরস্ক একদিকে যেমন ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, অন্যদিকে দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তানের সঙ্গে সরাসরি অংশীদারত্ব ভারতের ঐতিহ্যগত প্রভাবকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

এছাড়া, তুরস্কের সামরিক শক্তি—বিশেষ করে ড্রোন প্রযুক্তি এবং যুদ্ধ কৌশল—পাকিস্তানকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে, ইরানও ইসলামিক ঐক্যের ব্যানারে ভারতের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে কাশ্মীরসহ একাধিক ইস্যুতে।

এই ভূরাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে ভারতও বসে নেই। নয়াদিল্লি এরই মধ্যে তুরস্কের সঙ্গে কিছু বাণিজ্য ও প্রতিরক্ষা চুক্তি পুনর্বিবেচনা করেছে। পাশাপাশি, আরব উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক আরও জোরদার করতে উদ্যোগী হয়েছে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, দক্ষিণ এশিয়ার বর্তমান ভূরাজনৈতিক চিত্রে “বন্ধু ও প্রতিপক্ষ” নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত হচ্ছে। যেখানে তুরস্ক ও ইরানের সক্রিয় ভূমিকায় পাকিস্তান এক কৌশলগত সুবিধা পেতে যাচ্ছে, সেখানে ভারতের জন্য প্রয়োজন নতুন মিত্রতা ও কৌশলগত ভারসাম্য তৈরি করা।

তুরস্ক, ইরান ও পাকিস্তানের যৌথ কৌশল ভবিষ্যতে দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনতে পারে। ভারতের একক নেতৃত্ব প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে এবং নতুন সমীকরণে দক্ষিণ এশিয়া হতে পারে বৈশ্বিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার নতুন কেন্দ্রবিন্দু। বিশ্ব যখন পরিবর্তনের স্রোতে, দক্ষিণ এশিয়াও তার বাইরে নয়।