মতামত
প্রধান বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে প্রস্তাবিত বিধান: বাস্তবতা ও ভাবনার জটিলতা

হাবিবুর রহমান
অ্যাডভোকেট, ঢাকা বার অ্যাসোসিয়েশন

জাতীয় সংলাপের প্রেক্ষিতে এনসিপি প্রস্তাব করেছে, সংবিধানে একটি বাধ্যতামূলক বিধান রাখা হোক যাতে আপিল বিভাগের সিনিয়র মোস্ট বিচারপতিকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। অন্যদিকে, বিএনপির অবস্থান তুলনামূলকভাবে নমনীয়। তাদের প্রস্তাব, সিনিয়র তিনজন বিচারপতির মধ্য থেকে যেকোনো একজনকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগের বিধান রাখা যেতে পারে।
এই প্রস্তাবগুলোর উৎস খুঁজলে দেখা যায়, এগুলো অনেকটাই অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে সৃষ্ট। একে যদি মানসিক অভিঘাত হিসেবে বিবেচনা করি, তাহলে একে “ব্যাড চাইল্ডহুড ট্রমা” বলা চলে—বা বাংলায় “ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়।” প্রধান বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বেশ কিছু দুঃখজনক ঘটনা আছে—বিশেষ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় এই পদকে ঘিরে সৃষ্টি হওয়া দ্বন্দ্ব ও দ্ব্যর্থতা। এমনকি অতীতে এমন একজন বিচারপতির ঘটনাও ঘটেছে যিনি চারবার সুপারসিডেড হওয়ার পর চূড়ান্তভাবে প্রধান বিচারপতি হন।
প্রশ্ন হলো, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য বা ভারতসহ অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে এই ধরনের কঠোর নিয়ম নেই, সেখানে বাংলাদেশে কেন নতুন করে একটি রিজিড নিয়ম আবিষ্কার করা হবে?
প্রস্তাবিত বাধ্যবাধকতার সম্ভাব্য সমস্যাগুলো নিচে ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হলো:
প্রথমত, যদি সংবিধানে সিনিয়র মোস্ট বিচারপতিকেই প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়ার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়, তবে রাষ্ট্রপতির হাতে থাকা একমাত্র স্বাধীন ক্ষমতাটিও বিলুপ্ত হবে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির হাতে এমনিতেই কার্যকর স্বাধীন ক্ষমতা সীমিত, সেখানে বিচারপতি নিয়োগেও বাধ্যতামূলক বিধান থাকলে প্রেসিডেন্টের সাংবিধানিক ভূমিকাই অর্থহীন হয়ে পড়বে।
দ্বিতীয়ত, অতীতে বিচারপতি মানিকের মতো বিতর্কিত ব্যক্তিরা নানা পথ ঘুরে আপিল বিভাগ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছেন। রাষ্ট্রপতির হাতে বিকল্প চয়েস না থাকলে এই ধরনের বিতর্কিত ব্যক্তিরা হয়তো প্রধান বিচারপতির মতো গুরুত্বপূর্ণ পদেও আসীন হতে পারেন। যদি কোনো সিনিয়র বিচারপতির সততা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়, অথচ প্রমাণের অভাবে আনুষ্ঠানিক প্রসিডিং না হয়, তখন তাকে প্রধান বিচারপতি করা হলে বিচার বিভাগের নৈতিক কর্তৃত্ব হুমকির মুখে পড়তে পারে।
তৃতীয়ত, যদি কেউ নিশ্চিত থাকে যে তাকে প্রধান বিচারপতি বানানো হবেই, তবে সে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করে নির্বাহী বা আইন বিভাগের উপর ওভাররিচ বা জুডিশিয়াল ওভারঅ্যাক্টিভিজম করতে পারে। এর ফলে শৃঙ্খলা ও ভারসাম্য বিনষ্ট হতে পারে, এবং এই অবস্থায় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে না।
চতুর্থত, কোনো রাজনৈতিক দল যদি ক্ষমতায় থেকে নিজেদের অনুগত বিচারপতিদের আপিল বিভাগে উন্নীত করে, তাহলে পরবর্তী সরকারের আমলে সেই বিচারপতিদের অবস্থান একটি বাধা হিসেবে দাঁড়াতে পারে। বিচার বিভাগ তখন কার্যত রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে প্রশাসনিক অচলাবস্থার কারণ হতে পারে।
পঞ্চমত, রাজনৈতিক সুপারসেশন ঠেকানোর উদ্দেশ্যেই যে এই প্রস্তাব, সেটি বোঝা যায়। কিন্তু বাস্তবে এই রিজিড নিয়মই যেন আত্মঘাতী প্রমাণ না হয়। কারণ, রাজনৈতিক দলগুলো যদি জানে যে আপিল বিভাগের বিচারকরা একদিন না একদিন প্রধান বিচারপতি হবেনই, তাহলে তারা আগে থেকেই ‘লয়্যাল’ বা অনুগত বিচারকদের খুঁজে আপিল বিভাগে বসাতে চাইবে। এতে স্বাধীনমনা, বুদ্ধিদীপ্ত ও সাহসী বিচারকদের সংখ্যা কমে যেতে পারে।
ষষ্ঠত, প্রধান বিচারপতির পদটি কেবল বিচারিক নয়—এটি একটি উচ্চ প্রশাসনিক পদ। একজন বিচারক হতে পারেন অত্যন্ত গুণী ও দক্ষ, কিন্তু তার প্রশাসনিক দক্ষতা বা নেতৃত্বগুণ যদি দুর্বল হয়, তাহলে বিচার বিভাগের কার্যক্রম বিশৃঙ্খলার দিকে যেতে পারে।
অতএব, প্রধান বিচারপতি নিয়োগে সিনিয়রিটি ও অভিজ্ঞতা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য, তবে মেধা (merit), সততা (honesty) এবং প্রশাসনিক দক্ষতার (administrative skill) সঙ্গে কখনোই আপস করা উচিত নয়।
বিশ্বের কোথাও রিজিড রুলস নেই যে সিনিয়র মোস্ট বিচারপতিকে বাধ্যতামূলকভাবে প্রধান বিচারপতি করতে হবে। অধিকাংশ গণতান্ত্রিক দেশেই এটি একটি ‘আনরিটেন কনভেনশন’ হিসেবে বিদ্যমান, যেখানে সিনিয়র বিচারপতিকেই প্রধান বিচারপতি করা হয়। বাংলাদেশের জন্যও এই ধরনের কনভেনশন অনুসরণ করাই দীর্ঘমেয়াদে অধিকতর যুক্তিসঙ্গত ও কার্যকর হতে পারে।
উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হিসেবে, যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের বিচার বিভাগ অত্যন্ত শক্তিশালী হলেও, সেখানে চিফ জাস্টিস হিসেবে নিয়োগ পেতে হলে সুপ্রিম কোর্টের বর্তমান বিচারপতি হওয়ার প্রয়োজন নেই। ২০০৫ সালে জন রবার্টসকে চিফ জাস্টিস করা হয়, যিনি তখন একটি সার্কিট কোর্টের বিচারক ছিলেন। তুলনামূলকভাবে, এটি যেন ঢাকা বা চট্টগ্রামের জেলা ও দায়রা জজকে সরাসরি প্রধান বিচারপতি পদে উন্নীত করার মতো।
অন্যদিকে, ইতিহাসে বিচার বিভাগের ক্ষমতা সুসংহত করার জন্য সবচেয়ে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন সাবেক মার্কিন চিফ জাস্টিস জন মার্শাল। তার ঐতিহাসিক রায়ের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট সংবিধান ব্যাখ্যার একক কর্তৃত্ব অর্জন করে, এবং জুডিশিয়াল রিভিউ-এর মাধ্যমে পার্লামেন্টের আইন বাতিল করার ক্ষমতা লাভ করে। অথচ জন মার্শাল চিফ জাস্টিস হওয়ার আগে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অব স্টেট—এ যেন এক পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে সরাসরি প্রধান বিচারপতির পদে বসিয়ে দেওয়ার মতো সিদ্ধান্ত।
সব মিলিয়ে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষা ও বিচারপতি নিয়োগ প্রক্রিয়াকে যথাসম্ভব পেশাদার, যুক্তিনির্ভর এবং ভবিষ্যতমুখী রাখাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। কোনো কঠোর বা অপ্রয়োজনীয় বিধান নয়, বরং সংবিধান ও রীতিনীতি রক্ষায় ন্যূনতম রাজনৈতিক সদিচ্ছাই এখানে সবচেয়ে বড় গ্যারান্টি।
পাঠকের মতামত:
আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ
- ভবিষ্যতের গণতন্ত্র না পুরাতনের পুনরাবৃত্তি? ইউনুস-তারেক সাক্ষাৎ পর্যালোচনা
- শেয়ারবাজারে এল বড় সুখবর!
- জুলাই চার্টার ও জাতীয় ঐকমত্য: জামায়াতের অনুপস্থিতি কতটা যুক্তিসঙ্গত?
- স্টারমারের নীরবতা: কূটনৈতিক শিষ্টাচার বনাম রাজনৈতিক সংকোচ
- রিজার্ভের দাপট: বিদ্যুৎ খাতের ১৪ কোম্পানি বিনিয়োগের নতুন ঠিকানা
- ইউনূস-তারেক ঐতিহাসিক ও সফল বৈঠক: সংস্কার, একতা ও ন্যায়বিচার— এই তিন স্তম্ভে গড়ে উঠুক নতুন বাংলাদেশ
- উৎসব: ঈদের পর্দায় অনবদ্য এক উদযাপন
- মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ভূ-রাজনৈতিক আধিপত্যের নতুন কৌশল: চীন ও রাশিয়া কী করবে?
- তিন মাসেই যে ১০ বেসরকারি ব্যাংকে ৩২ হাজার কোটি টাকার আমানত বৃদ্ধি!
- লন্ডনে তারেক-ইউনূসের বৈঠকের পরে পর পর ২টি স্ট্যাটাসে কি বললেন পিনাকী?
- তুরস্ক, সৌদি, ইরান-পাকিস্তানের হাতে ‘ইসলামিক আর্মি’ গঠন! কি হতে যাচ্ছে?
- ইসরায়েলে ইরানি মিসাইল, নিহত অন্তত ৭
- ইসরায়েল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে রাশিয়ার সতর্কবার্তা
- ২৮ জুন ঢাকায় জনতার ঢল: সোহরাওয়ার্দী উদ্যান হবে মহাসমুদ্র!
- নির্বাচিত নারী, অলঙ্কার নয়: গণতন্ত্রে নারীর শক্তির সন্ধান