চীনা নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে কী বলল বিএনপি

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট যেমন বদলেছে, তেমনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বাংলাদেশকে ঘিরে বাড়ছে কৌশলগত আগ্রহ। এমন এক প্রেক্ষাপটে চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা আরও বাড়াতে সক্রিয় হয়েছে দেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল বিএনপি। গত এক বছরে একাধিকবার চীন সফর করে দেশটির কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্কে দৃঢ়তা আনার চেষ্টা করেছে দলটি।

সর্বশেষ ২২ জুন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে দশ সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল চীন সফর করে। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, সেলিমা রহমানসহ নেতৃবৃন্দ এই সফরে অংশ নেন। সফরকালে তারা চীনের পররাষ্ট্র উপমন্ত্রী সান ওয়েইডং, কমিউনিস্ট পার্টির আন্তর্জাতিক বিভাগের মন্ত্রী লিউ জিয়ানচাও ও ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেসের ভাইস চেয়ারম্যান লি হংঝংয়ের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেন।

সফর শেষে ঢাকায় ফিরে বিএনপি মহাসচিব বলেন, “চীন সফর অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছে। পার্টি টু পার্টি সম্পর্ক আরও নিবিড় হয়েছে। রাজনৈতিক, কৌশলগত ও অর্থনৈতিক নানা বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।”

এটি ছিল গত এক বছরে বিএনপির তৃতীয় চীন সফর। এর আগে ২০২৪ সালের নভেম্বরে দলের ভাইস চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান খান রিপনের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল বেইজিং সফর করেছিল। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে আবদুল মঈন খানের নেতৃত্বে বিএনপি ও মিত্র দলের প্রতিনিধি দল চীন সফরে যায়। এসব সফরের মাধ্যমে চীনের সঙ্গে রাজনৈতিক বোঝাপড়া ও অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব গড়ে তোলারই উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপি।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, “চীনের আগ্রহ আমাদের চেয়েও বেশি। বাংলাদেশে তাদের ব্যাপক বিনিয়োগ রয়েছে। তারা চায় সেই ধারাবাহিকতা বজায় থাকুক। আমরা সরকার গঠন করলে যেন কোনো সমস্যা না হয়, তা নিয়েও আলোচনা হয়েছে।”

চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রায় ৪২ বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। চীন বাংলাদেশের অন্যতম বড় উন্নয়ন সহযোগী। এমন প্রেক্ষাপটে কেবল বিএনপি নয়, জামায়াতসহ আরও কিছু রাজনৈতিক দলও আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর চীন সফর করেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, চীন কৌশলগত দিক বিবেচনায় বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন ও জোরদারে সচেষ্ট।

বাংলাদেশে চীনের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমদ বলেন, “এটা শুধু সৌজন্যমূলক সফর নয়। চীন বুঝতে চায়—আওয়ামী লীগ পরবর্তী বাংলাদেশে তাদের কৌশলগত স্বার্থ কতটা সুরক্ষিত থাকবে।”

অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছাড়াও ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও চীনের এই আগ্রহ বিশ্লেষকদের নজর কেড়েছে। সম্প্রতি চীন, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকে নিয়ে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের মধ্য দিয়ে এক ধরনের কৌশলগত মঞ্চ গঠনের আভাস মিলেছে। এ প্রক্রিয়ায় ভারতকে বার্তা দেওয়ার কৌশল থাকতে পারে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ড. সাহাবুল হক বলেন, “আওয়ামী লীগ সরকার থাকাকালে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠতা ছিল। এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। চীন এই অবস্থাকে একটি কৌশলগত সুযোগ হিসেবে দেখছে।”

তবে এই বাস্তবতায় সাবেক কূটনীতিক মুন্সী ফয়েজ আহমদ সতর্ক করে বলেন, “চীন অর্থনৈতিক সহযোগী হলেও, ভৌগোলিক নিরাপত্তার প্রশ্নে ভারতের গুরুত্ব কখনোই উপেক্ষা করা যাবে না। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখতে হবে।”

রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক—তিন ক্ষেত্রেই চীন এখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ একটি পক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। বিএনপি-চীন ঘনিষ্ঠতা যদি এমনই ধারায় এগোয়, তাহলে আগামী দিনে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অবস্থান নতুন মোড় নিতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।