সাহসী নতুন বাংলাদেশ: বাহরাইনকে ৭-০ গোলে উড়িয়ে এশিয়ান কাপ বাছাই শুরু নারীদের

র‌্যাংকিংয়ের খাতা বলছিল এক কথা, কিন্তু মাঠে দেখা গেল সম্পূর্ণ ভিন্ন এক গল্প। নাম র‌্যাংকিংয়ে ৩৬ ধাপ এগিয়ে থাকলেও মাঠের খেলায় একেবারে অসহায় আত্মসমর্পণ করল বাহরাইন। আর তাদের এই পরাজয়ের নায়ক হল আত্মবিশ্বাসে ভরপুর, আগ্রাসী ও সংগঠিত এক বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল, যারা যেন নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করলো।

আজ রবিবার, মিয়ানমারের ইয়াংগুনে অনুষ্ঠিত এশিয়ান কাপ নারী বাছাইপর্বের 'সি' গ্রুপের প্রথম ম্যাচে বাহরাইনকে ৭-০ গোলের বিশাল ব্যবধানে পরাজিত করেছে বাংলাদেশ। এই জয় শুধু একটি ম্যাচজয় নয়, এটি একটি বার্তা—বাংলাদেশ নারী দল এখন আর প্রতিপক্ষ দেখে ভয় পায় না, র‌্যাংকিং দেখে পিছিয়ে পড়ে না। তারা জানে কীভাবে আধিপত্য দেখাতে হয়।

দ্রুত লিড, প্রথমার্ধেই পাঁচ গোল

খেলা শুরু হতেই পরিষ্কার হয়ে যায় কোন দল ম্যাচে নিয়ন্ত্রণ নেবে। খেলায় গতি, শৃঙ্খলা ও স্পষ্ট পরিকল্পনা ছিল বাংলাদেশ দলের প্রতিটি চালচিত্রে। ম্যাচের মাত্র ১০ মিনিটেই গোলের খাতা খুলে দেন সামসুন্নাহার সিনিয়র। নিজের অর্ধ থেকে আসা লম্বা পাস নিয়ন্ত্রণে নিয়ে প্রতিপক্ষ ডিফেন্স ভেদ করে দুর্দান্ত শটে বল পাঠিয়ে দেন বাহরাইনের জালে।

এর মাত্র ছয় মিনিট পরেই ব্যবধান বাড়ান ঋতুপর্ণা চাকমা, যিনি সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে সেরা খেলোয়াড় হয়েছিলেন। ডান উইং থেকে একক গতিতে এগিয়ে গিয়ে দূরপাল্লার শটে বল জালে জড়ান।

৪০ মিনিটে স্কোরলাইন দাঁড়ায় ৩-০। জটলার মধ্যে বল পেয়ে যান কোহাতি কিসকু, ডিফেন্ডার চ্যালেঞ্জ দিলেও ঠান্ডা মাথায় লক্ষ্যভেদ করেন তিনি।

এরপর ইনজুরি টাইমে দুই মিনিটের ব্যবধানে জোড়া গোল করেন তহুরা খাতুন, যিনি জাতীয় দলের অভিজ্ঞ ফরোয়ার্ডদের অন্যতম। ফলে প্রথমার্ধেই বাংলাদেশ ৫-০ গোলে এগিয়ে যায় এবং মূলত সেখানেই ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যায়।

দ্বিতীয়ার্ধে নিয়ন্ত্রিত ফুটবল, তবে গোলের ধারা অব্যাহত

দ্বিতীয়ার্ধে বাংলাদেশ কিছুটা ধীরগতির ফুটবল খেললেও আক্রমণের ধার কমেনি। ম্যাচের ৬০ মিনিটে একটি আত্মঘাতী গোল করে বসে বাহরাইনের ডিফেন্ডার, যেটি স্কোরলাইন দাঁড় করায় ৬-০ তে।

শেষ পেরেকটি ঠুকে দেন মুনকি আক্তার, ৭৪ মিনিটে বক্সের ভেতর থেকে নেওয়া শটে গোল করে এই ঐতিহাসিক জয়টিকে পূর্ণতা দেন।

মাঠের বাইরের চ্যালেঞ্জও জয়

ম্যাচটির গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে তোলে এটি বিদেশের মাটিতে, বিশেষ করে মিয়ানমারের মতো আবহাওয়াগত ও পরিবেশগত দিক থেকে কঠিন একটি জায়গায় অনুষ্ঠিত হওয়া। ম্যাচের আগে শারীরিক মানিয়ে নেওয়া, নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়ানো এবং ট্যাকটিক্যাল ট্রেনিং—সব মিলিয়ে এই ম্যাচ ছিল বাংলাদেশ দলের জন্য একটি কঠিন পরীক্ষা। এবং তারা সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে অনবদ্যভাবে।

ম্যাচ পরিসংখ্যান (বাংলাদেশ বনাম বাহরাইন)

গোল: বাংলাদেশ ৭ – ০ বাহরাইন

প্রথমার্ধে গোল: ৫টি

দ্বিতীয়ার্ধে গোল: ২টি (১ আত্মঘাতী)

গোলদাতা: সামসুন্নাহার সিনিয়র (১), ঋতুপর্ণা (১), কোহাতি (১), তহুরা (২), মুনকি (১), বাহরাইন আত্মঘাতী (১)

দখল: বাংলাদেশ – 65%, বাহরাইন – 35% (প্রেস রিপোর্ট অনুযায়ী)

এগিয়ে চলা পথ: গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হবার আশা

এই ম্যাচে বড় ব্যবধানে জয় বাংলাদেশের জন্য শুধুই আত্মবিশ্বাস বাড়ায়নি, বাছাইপর্বে গোল পার্থক্যও বাড়িয়েছে, যা পরবর্তী ধাপে যেতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। একই গ্রুপে রয়েছে মিয়ানমার ও লাওস, যাদের সঙ্গেও সামনে ম্যাচ রয়েছে।

এই জয়ে বাংলাদেশের নারী দল তাদের টেকনিক্যাল উন্নয়ন, স্কাউটিং, অনুশীলন পদ্ধতি ও কোচিং ব্যবস্থার উন্নতির পরিষ্কার প্রমাণ দিল।

বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল আর আগের জায়গায় নেই। তারা এখন র‌্যাংকিং নয়, মাঠের খেলায় নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে বিশ্বাসী। এই দল আত্মবিশ্বাসী, গতিময় এবং সবচেয়ে বড় কথা—একটি নির্ভার এবং সংঘবদ্ধ ইউনিট। বাহরাইনের বিপক্ষে এই ৭-০ গোলের জয় তাই শুধু তিন পয়েন্টের নয়, বরং একটি অঘোষিত বার্তা: "বাংলাদেশ এখন কাউকে ভয় পায় না।"