মিরপুরে মেট্রোরেল দুর্ঘটনার ভিডিওর নেপথ্যে যারা

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিও নিয়ে রাজধানীবাসীর মধ্যে উদ্বেগ দেখা দেয়, যেখানে দেখা যায় ঢাকার মিরপুর এলাকায় একটি মেট্রোরেল বগি লাইনচ্যুত হয়ে রেললাইনের নিচে থাকা সড়কে পড়ে যাচ্ছে। ভিডিওটি যেমন ভয়াবহ, তেমনই বাস্তবতার সঙ্গে তার সম্পর্ক নেই। তদন্তে উঠে এসেছে, এটি বাস্তব কোনো ঘটনা নয়, বরং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) প্রযুক্তি ব্যবহার করে সৃষ্ট একটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক ও বিভ্রান্তিকর দৃশ্য।

তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান রিউমার স্ক্যানার তাদের তদন্তে নিশ্চিত করেছে যে, ভিডিওটি AI (Artificial Intelligence) প্রযুক্তি ব্যবহার করে ডিজিটালি নির্মিত। প্রতিষ্ঠানটি রিভার্স ইমেজ সার্চ ও ভিডিও বিশ্লেষণ করে দেখতে পায়, এটি আসলে ‘the.worldai’ নামক ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট থেকে গত ২৩ মার্চ পোস্ট করা একটি এআই-সৃষ্ট ভিডিওর মিরর কপি।

এই ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টটি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন শহরের কল্পিত বিপর্যয়, অবাস্তব ভবন ধস কিংবা রোবট-সজ্জিত ভবিষ্যতের দৃশ্য এআই প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি করে থাকে, যা অনেক সময় বাস্তব বলে বিভ্রান্তি তৈরি করে।

ভিডিওটি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই মেট্রোরেল ব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তা, ও নগর নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ে। তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বাংলাদেশের কোনো মূলধারার সংবাদমাধ্যম, সরকারি সংস্থা বা মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ মিরপুরে লাইনচ্যুতির এমন কোনো ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেনি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভিজ্যুয়াল রিয়ালিজমে দক্ষ এআই প্রযুক্তি এখন এমনভাবে বিভ্রান্তিকর কনটেন্ট তৈরি করতে সক্ষম, যা এক নজরে বাস্তব বলে মনে হতে পারে। এ কারণেই তথ্য যাচাইয়ের চর্চা ও মিডিয়া লিটারেসি এখন গণসচেতনতার অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে।

যদিও 'the.worldai' ও অনুরূপ অ্যাকাউন্টগুলো নিজেদের কনটেন্টে হ্যাশট্যাগ বা বিবরণীতে “AI-generated” বলে উল্লেখ করে থাকে, তবে ভিডিওটি যখন এসব প্রেক্ষাপট ছাড়া শেয়ার হয়, তখন তথ্যবিহীন, ভীতিকর গুজবের জন্ম দেয়।

নগর পরিকল্পনাবিদ ও ডিজিটাল নিরাপত্তা বিশ্লেষক অধ্যাপক মাহবুব আরেফিন বলেন, “একটা ভিডিও যদি বাস্তবের মতো দেখায় এবং কোনো প্রেক্ষাপট ছাড়া ছড়ায়, তাহলে তা সামষ্টিক আতঙ্ক, নীতি-নির্ধারকদের ওপর চাপ, এমনকি জরুরি সেবার ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। আমরা এখন ‘ডিজিটাল দায়িত্ব’ এবং 'তথ্য বিশ্লেষণের’ যুগে ঢুকেছি।”

মেট্রোরেল প্রকল্পের একটি অভ্যন্তরীণ সূত্র জানায়, মিরপুর বা রাজধানীর অন্য কোথাও মেট্রোরেলের কোনো বগি লাইনচ্যুত হয়নি এবং প্রকল্পের সার্বক্ষণিক মনিটরিং ও পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ সচল রয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ভিডিওটি ঘিরে জনমনে যাতে আতঙ্ক না ছড়ায়, সে বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার কথাও জানায়।

এই ঘটনার মাধ্যমে আবারও প্রমাণ হলো এআই প্রযুক্তির অসীম সৃজনশীলতা যেমন আছে, তেমনি আছে তার অপব্যবহারের বিপজ্জনক দিক। সত্য-মিথ্যার ব্যবধান ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে, আর তাই ডিজিটাল যুগে তথ্য যাচাই ছাড়া বিশ্বাস করা এখন নিজের এবং সমাজের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ভবিষ্যতে যে কোনো ভাইরাল কনটেন্ট গ্রহণের আগে সূত্র, প্রসঙ্গ ও প্রমাণ যাচাই করাটাই একমাত্র প্রতিরোধক।

-ইসরাত, নিজস্ব প্রতিবেদক